Advertisement
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শিল্পী যখন আক্রান্ত

কেন সলিল চৌধুরীর গান গাইলেন, এই নিয়ে তুমুল গন্ডগোল। এক জনের রেকর্ডই বেরোল না, আর এক জনের ডিস্ক ভাঙা হল। কেন সলিল চৌধুরীর গান গাইলেন, এই নিয়ে তুমুল গন্ডগোল। এক জনের রেকর্ডই বেরোল না, আর এক জনের ডিস্ক ভাঙা হল।

কাঠগড়ায়: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র

কাঠগড়ায়: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র

অভীক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া প্রথম রেকর্ডের গানদুটি কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, ছিল আধুনিক গান। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ওই রেকর্ডে নীহারবিন্দু সেনের কথায় ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে কণিকা গেয়েছিলেন ‘ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার’ ও ‘গান নিয়ে মোর খেলা’। রবীন্দ্রনাথ তখন বেঁচে। এ ঘটনায় তিনি একটু দুঃখ পেয়েছিলেন। কণিকার ভাষায়, ‘আমার আধুনিক গানের রেকর্ড বের হওয়ায় দুঃখ পেলেন গুরুদেব।...গুরুদেব দুঃখ পাওয়ায় আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।’ খুবই স্বাভাবিক। যে ছোট্ট মেয়েটার মিষ্টি গান শুনে তাঁকে আশ্রমে টেনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যাঁর পিতৃদত্ত ‘অণিমা’ নাম পালটে ‘কণিকা’ করে দিয়েছিলেন, সেই মেয়েটি প্রথম রেকর্ডে তাঁর গান ছাড়া অন্য গান গাইলে দুঃখ তো পেতেই পারেন কবি। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। কিন্তু সেই জিনিসই ঘটল কবির প্রয়াণের বেশ কয়েক বছর পর।

১৯৫২-৫৩ সাল। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ডিংয়ের জন্যে এসেছেন কলকাতায় এইচএমভি স্টুডিয়োতে। রিহার্সাল রুমে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। মুখোমুখি পরিচয় সেই প্রথম। এর আগে থেকেই সলিলের গান কণিকার ভীষণ প্রিয়। সে দিন কণিকা বলেই ফেললেন, সলিলের গান গাইতে তাঁর খুব ইচ্ছে করে। এ কথা শুনেই সলিল চৌধুরী দিন দুয়েকের মধ্যেই কণিকার জন্যে দুটো গান তৈরি করে ফেললেন। রেকর্ডিংও হয়ে গেল। এর পরেই গন্ডগোলের শুরু।

খবর গেল শান্তিনিকেতনে। কণিকা লিখছেন, ‘সলিলের গান করেছি, এ খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছল যথারীতি। অনেকে আপত্তি করলেন, কেন আমি রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে আবার আধুনিক গান গাইব? রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়লাম কোথায়! সে গান তো আমার সারাজীবনের আশ্রয়। কিন্তু তর্কে আমি কুঁকড়ে যাই। লড়াই চালাতে ইচ্ছে করে না। ফলে আপত্তি মেনে নিলাম। সলিলকে জানালাম, বের করা যাবে না ওই রেকর্ড। দুঃখ পেয়েছিল সলিল। আমিও কম দুঃখ পাইনি।’ শেষে উৎপলা সেনকে দিয়ে রেকর্ডে গাওয়ালেন সলিল চৌধুরী। ১৯৫৩ সালের পুজোয় প্রকাশিত সেই গানদুটি হল ‘প্রান্তরের গান আমার’ এবং ‘আমার কিছু মনের আশা’। কণিকার গলায় গানদুটির আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি পরে। এর কয়েক বছর পরে আবারও দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘পত্র লিখি কাজল মেঘে’ এবং ‘সুরের পথে ঘুরে বেড়ায় আমার মন’ (কথা: শ্যামল গুপ্ত, সুর: মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়)। কিন্তু এই রেকর্ডদুটিও প্রকাশিত হল না, কণিকারই অনুরোধে। কারণ হিসেবে তাঁর প্রথম রেকর্ডকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের দুঃখ পাওয়ার কথা বলেছিলেন কণিকা। সলিল-সংক্রান্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাও হয়তো একই সঙ্গে তাঁর ভেতরে কাজ করেছিল। যদিও কণিকার প্রয়াণের পর একটি অ্যালবামে মানবেন্দ্র-সুরারোপিত গানদুটি সঙ্কলিত হয়।

রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির মনে কণিকার সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন সুচিত্রা মিত্র। আর কী আশ্চর্য, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-সলিল চৌধুরীর এই ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন তিনিও! সুচিত্রা প্রথমে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ না থেকে, নিজেকে মেলে ধরেছিলেন নানান ক্ষেত্রে। যার মধ্যে ছিল ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’-র সঙ্গে যুক্ত হওয়াও। সেখানেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা সলিল চৌধুরীর সঙ্গে।

১৯৫০-এ সলিলের কথায়-সুরে সুচিত্রা রেকর্ডে গাইলেন ‘সেই মেয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার কৃষ্ণকলি পরবর্তী কালে দেশভাগের বলি হয়ে কোন অবস্থায় পৌঁছেছে, তার আন্তরিক চিত্র এঁকেছিলেন সলিল চৌধুরী ‘সেই মেয়ে’ গানে, সুচিত্রা মিত্রের অসামান্য পরিবেশন যাকে পূর্ণতা দিয়েছিল। এ গান নিয়েও কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার উল্লেখ আছে সলিল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা সুচিত্রা মিত্রের ‘পুরনো আখরগুলি’ নামে লেখায়। লিখেছেন, এ গান বেরোনোর পর ‘রবীন্দ্রভক্ত’রা তাঁকে ‘আক্রমণ করলেন’, ‘অপমান করলেন’, তাঁর সামনে গানের ডিস্কটি ভাঙাও হল। কারণ হিসেবে লিখেছেন, ‘আমি কেন এক দাগি কমিউনিস্টের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির parody গাইলাম।’ তাঁর বক্তব্য, ‘আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি— “সেই মেয়ে” কৃষ্ণকলির parody নয়। সলিলের প্রতিভাকে আমি ঠিকই চিনেছিলাম। ওঁরাই চেনেননি।... রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সঙ্গীতপ্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন, এতে আমার সন্দেহ নেই।’

একই লেখায় সুচিত্রা মিত্র উল্লেখ করেছেন কণিকা-সলিল সংযোগের ঘটনার কথাও— কী ভাবে গানদুটির টেস্ট-প্রিন্ট পেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তা বাজারে বেরোতে পারেনি। তিনি আরও বলেছেন, ‘চোখের জলে অর্ধেক মুছে যাওয়া একটি চিঠিতে’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীকে লিখেছিলেন, ‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই।’

অন্য বিষয়গুলি:

Kanika Banerjee Suchitra Mitra Salil Chowdhury Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy