Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
কাঁকড়াবিছে বনাম ধুতরোর বীজ

কী করে খুন করি

পাঁ চুধোপানির গলিতে রাজকুমারী নামে এক মহিলা হঠাৎ খুন হলেন। ভাড়াবাড়ি। বাকি ভাড়াটেরাও মহিলা। দেহোপজীবিনী। পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পড়ল তাদেরই এক জন, ত্রৈলোক্যের ওপরে। বিস্তর নাটকের পরে ত্রৈলোক্য দোষ স্বীকার করল। জানাল, ‘আমি কতকটা ধুতুরার গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম।... আমার পূর্ব্ব বাসস্থান ছিল পাড়াগাঁয়ে।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

পাঁ চুধোপানির গলিতে রাজকুমারী নামে এক মহিলা হঠাৎ খুন হলেন। ভাড়াবাড়ি। বাকি ভাড়াটেরাও মহিলা। দেহোপজীবিনী। পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পড়ল তাদেরই এক জন, ত্রৈলোক্যের ওপরে। বিস্তর নাটকের পরে ত্রৈলোক্য দোষ স্বীকার করল। জানাল, ‘আমি কতকটা ধুতুরার গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম।... আমার পূর্ব্ব বাসস্থান ছিল পাড়াগাঁয়ে। সুতরাং ধুতুরা যে কি জিনিষ, তাহা আমি বেশ জানি। উহার গুণ আমি অবগত আছি এবং কোথায় যে উহা পাওয়া যায়, তাহাও আমার জানিতে বাকী নাই। সেই ধুতুরার বীজ উত্তম রূপে চূর্ণ করে সন্দেশে মিশিয়ে রাজকুমারীকে খাওয়ানো হয়। সেই সঙ্গে তামাকুর পরিবর্ত্তে সিদ্ধি সেজে সেই ধূমও পান করানো হয়।’

বিষাক্ত এই আখ্যানের নাম, ‘শেষ লীলা’। লেখক বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনির আদি পিতা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ‘শেষ লীলা’ ঠিক বানানো গল্প নয়। প্রিয়নাথ পুলিশে চাকরি করতেন। পুলিশ ফাইলের উপাদান থেকেই লেখা শুরু করেন ‘দারোগার দপ্তর’ (১৮৯১)। ধুতরো বিষের প্রয়োগ তখন বেশ বহুল। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত রামাক্ষয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুলিস ও লোকরক্ষা’ বইয়ে দেখছি, কুখ্যাত ঠগীদের একাংশ ধুতুরিয়া ঠগী নামে পরিচিত ছিল। ‘(তাহারা) ধুতূরা ও কুচলিয়ার বীজ প্রভৃতি বিষাক্ত দ্রব্য চূর্ণ নিকটে রাখে। পথিকদিগের সহিত যাইতে যাইতে সুযোগ বুঝিয়া খাদ্যসামগ্রীতে এই চূর্ণ মিশাইয়া দেয়...কখন কখন রূমাল আদি বিষাক্ত দ্রব্য দিয়া লোকজনকে মারিয়া ফেলে।’ ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে শুরু করে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ দেশে বিষের কারবার আর তাই নিয়ে যে কী বিপুল আতঙ্ক, সম্প্রতি ডেভিড আর্নল্ড সে বিষয়ে আস্ত একটি বই লিখেছেন, ‘টক্সিক হিস্ট্রিজ: পয়জন অ্যান্ড পলিউশন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’। ভিক্টোরিয়ার আমল কিন্তু ব্রিটেনেও বিষ-ক্রিয়ার স্বর্ণযুগ! সেই সব বিষবৃক্ষই সাহিত্যের পাতায় অমৃত ফলিয়েছে! ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’-এর (১৮৮৭) সূত্র ধরে শার্লক হোমসের যাত্রাটি যেমন শুরু থেকেই বিষে টইটম্বুর, বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যও তার গোড়ার দিন থেকেই একেবারে বিষময়! তা সে ‘চুম্বনে খুন’ জাতীয় বটতলার উপন্যাসই হোক, আর লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকদের কলমই হোক! বিষের আরকে চুবিয়ে না নিলে অপরাধ-কাহিনির তখন খোশবাই হত না।

সেই আদি পর্বের সবচেয়ে বড় মহীরুহ পাঁচকড়ি দে-র কথাই ধরা যাক। বক্ষঃস্থল আমূল বিদ্ধ করা ছুরিকার পাশাপাশি তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল বিষে। মায়াবী, এবং তার উত্তরকাণ্ড, মনোরমা ও মায়াবিনী, এ ব্যাপারে সেকালের বিজ্ঞাপনী ভাষায় সবচেয়ে ‘লোমাঞ্চকর’। সেখানে ভিলেন ফুলসাহেব এবং জুমেলিয়ার জুটি যেন বিষের গন্ধমাদন। ফুলসাহেব নিজেই বলছে, ‘বেমালুম খুন করিবার একশত আট রকম বিষ আমার হাতে আছে। তমীজউদ্দীনের বাড়ীতে যে বিষ ব্যবহার করিয়াছিলাম, প্রত্যহ খাবার জলের সঙ্গে একবার এক ফোঁটা করিয়া দিলে ঠিক ছয় মাসের মধ্যে মানুষ মরে।... শীঘ্র কাজ শেষ করিতে হইলে রোজ দুই ফোঁটা এমনকি তিন ফোঁটা করিয়া খাওয়ান চলে— তার বেশী দেওয়া চলে না— তাহা হইলে জলটা একটু কষায় বোধ হয়। অরিন্দমকে চুরুটের সঙ্গে যে বিষ দিয়ে হত্যা করিলাম, উহাতে দশ ঘণ্টার মধ্যে যেমন বলবান লোক হউক না কেন— নিশ্চয়ই মরিবে।’

খাওয়ার বিষ, শোঁকার বিষ, শরীর পুড়িয়ে দেওয়া বিষ, বিষের কাঁটা, বিষের শিশি, বিষের লকেট, বিষের শিকড়— কোনও আয়োজন বাদ রাখেননি শ্রীযুক্ত পাঁচকড়িবাবু। জুমেলিয়া যেন কুঁদে কাটা বিষকন্যা, ‘(তাহার) চুম্বনে লঙ্কেশ্বরকে মরিতে দেখিয়া পাঠক আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন না— সে সাপিনী, তাহার নিঃশ্বাস লাগিয়াও শোণিত বিষাক্ত হইয়া উঠে।’ ‘মায়াবী’ গল্পের শেষে ফুলসাহেব মরে যায়। থেকে যায় জুমেলিয়াই। ‘মনোরমা’য় তার মুখেই শুনি, কামরূপের উত্তর-পূর্ব্ব দিকে কাচিম রাজ্যের মেয়ে সে। জাতিতে মিসমি। ফুলসাহেব প্রথমে আরব দেশ থেকে অনেক ঔষধ সংগ্রহ করেছিল। তার পরে জুমেলিয়ার রাজ্যে গিয়ে হরেক মন্ত্র ও দ্রব্যগুণ শিক্ষা করে।

ভিন রাজ্য থেকে গরলবিদ্যা শিখে আসার এই মোটিফ গোয়েন্দা সাহিত্যে অহরহ। কোনান ডয়েল, ডরোথি সেয়ার্স বা আগাথা ক্রিস্টির লেখায় যেমন ট্রপিক্সের কথা ঘুরেফিরে আসবেই, অনেকটা তারই দোসর যেন বাংলা গল্প। হোমস-এর ‘অ্যাডভেঞ্চার অব আ ডায়িং ডিটেকটিভ’ মনে করুন। কালভার্টন স্মিথ সেখানে সুমাত্রা থেকে বিষাক্ত গাছগাছড়ার ব্যবহার জেনে এসেছে। লন্ডনে নিজের ল্যাবরেটরিতে সে সবের চাষ করেছে। সেই বিষ দিয়েই নিজের ভাগ্নে ভিক্টর স্যাভেজকে খুন করেছে, হোমসকেও মারার চেষ্টা করেছে। পাঁচকড়ির ‘নীলবসনা সুন্দরী’তে খুনি মোবারক একই ভাবে কবুল করছে, ‘ইদানীং আমি অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপালে থাকিতাম...নেপালের দক্ষিণপ্রান্তস্থ পর্ব্বতমালায় কাওয়াল জাতি বাস করে।...কাওয়াল জাতিরা এই তীরের ফলা তৈয়ারী করিয়া পক্ষাধিক কাল কোন একটা বিষাক্ত গাছে বিদ্ধ করিয়া রাখিয়া দেয়।... তাহার একটু আঁচড়ে দেহস্থ সমুদয় রক্ত বিষাক্ত হইয়া উঠে!’


‘চিড়িয়াখানা’য় উত্তমকুমারের বাসুকিও গোখরো বা কেউটে নয়, বেবি পাইথন। নির্বিষ।

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘শনিমঙ্গলের রহস্য’তে দেখছি, আততায়ী বোর্নিয়োর আদিবাসীদের কাছ থেকে এক নতুন ধরনের বিষ-অস্ত্র এ রাজ্যে আমদানি করছে। তার নাম সুম্পিটান। গোয়েন্দা জয়ন্ত বলছে, ‘সুম্পিটান হচ্ছে সুদীর্ঘ লাঠির মতোন একটা জিনিস, যার ভিতরটা হচ্ছে ফাঁপা।...তার ভিতরে থাকে সাগুকাঠে তৈরী একটি নয়-দশ ইঞ্চি সূক্ষ্ম শলাকা, আর সেই শলাকায় মাখানো থাকে ‘ইপো’, গাছের তীব্র বিষ।...সজোরে ফুঁ দিলে ভিতরকার শলাকাটি তীর-বেগে বহুদূরে ছুটে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করে।’ বিষে আকীর্ণ কিরীটী সিরিজের ‘হলুদ শয়তান’ গল্পে চিনা ডাক্তার ওয়াং মৃত্যুর আগে জানিয়ে যাচ্ছে, ‘আমি আমার শরীরে বিষ ইঞ্জেকশন দিয়েছি, আর বিশ মিনিটের মধ্যেই আমার মৃত্যু হবে। ওদিকে চেয়ে দেখছ কি, ও পাশের দেওয়ালে রয়েছে ভাস্বর ছত্রাক— এ তারই আলো। আমি নিজে কালচার করে ওই এম্পেরা ছত্রাকের জন্ম দিয়েছি...মরা মাছির গায়ে একরকম সাদা বস্তু জড়িয়ে থাকে, তারই ডিম্বকোষের কালচার থেকে ওই ভাস্বর ছত্রাকের জন্ম...বাঁ দিককার দেওয়ালে দেখ...ওগুলোও নীলবর্ণের অ্যামেনেশিয়া জাতীয় ছত্রাক—ওর ওদিকে আর একটা চেম্বার আছে...আমার তৈরী সবুজ তরল মৃত্যু-বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস...আমার রক্তলোভী লাল মাকড়সা...তারও পরিচয় পেয়েছ Scolopindra গ্রুপে...’

ওয়াং বা কালো ভ্রমরের মতো ডাকসাইটে ডাক্তার-ভিলেনের জনক নীহাররঞ্জন গুপ্ত নিজেও চিকিৎসক। পূর্বসূরি দেবেন্দ্রবিজয়ের মতো গোয়েন্দা কিরীটীও তাই। নিহতের দেহে অ্যাট্রোপিন সালফেট পাওয়া গিয়েছে জানা মাত্র সে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, অ্যাট্রোপিন সালফেটের লিথাল ডোজটা বোধ হয়—এক থেকে দুই গ্রেন—কৃষ্ণা, ঐ আলমারি থেকে ডাঃ ঘোষের ফারমাকোপিয়াটা বের কর তো, ঐ যে লাল মলাটের বইটা...(সুভদ্রা হরণ)।’

পাঠকের মনে পড়বে, কোনান ডয়েল শুধু ওয়াটসনকে ডাক্তার করেননি, নিজেও কিছু দিন ডাক্তারি পড়েছিলেন। আগাথা ক্রিস্টির বিষ-বীক্ষা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নার্স আর ফার্মাসিস্টের কাজ করতে গিয়ে তৈরি। তাঁদের হাতে যে হলাহলের মন্থন, তাতেই অবগাহন করেছেন বঙ্গীয় লেখকরা। এডগার অ্যালান পো থেকে এমিল গাবোরিও, গোগ্রাসে পড়েছেন। অনুবাদ, অনুসরণ, অনুকরণ, হনুকরণ কিছুই বাদ যায়নি। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক রহস্যলহরী বলেকয়েই সেক্সটন ব্লেক সিরিজ থেকে নেওয়া। বিষ সেখানে রীতিমত ঝাঁঝালো। কখনও ব্লেককে বিষাক্ত মদিরা পান করানো হচ্ছে তো কখনও সে কার্বলিক গ্যাসের কুঠুরিতে গিয়ে পড়ছে! তবে বিষের এর চেয়েও চমৎকারী বর্ণনা পাচ্ছি অসমাপ্ত উপন্যাস ‘রহস্যের খাসমহলে’। সেখানে নায়ককে বিষাক্ত কফি খাওয়ানো হয়েছে। কোনও মতে বেঁচে যাওয়ার পরে ডাক্তার কী বলছেন শুনুন—‘আপনার দেহে যে বিষ প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহা ভেরাট্রিণ, সিভেডিন এবং সিভাডিলাইন প্রভৃতির সংমিশ্রণে প্রস্তুত। তাহা দেহে প্রবিষ্ট হইলে...মনে হয় মৃত্যুর আর অধিক বিলম্ব নাই; পূর্ণমাত্রায় জ্ঞান থাকে অথচ সর্ব্বাংগ নুলো হইয়া যায়।...সেরূপ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু সচরাচর দেখিয়ে পাওয়া যায় না। ...কে আপনার দেহে ওই সকল দুর্লভ বিষ প্রয়োগ করিয়াছিল বলিবেন কি? ভৈষজ্য-তত্ত্বে তাহার অভিজ্ঞতা অসাধারণ!’ এতেই শেষ নয়। এর পরে গুপ্ত গহ্বরের মধ্যে আবিষ্কার হবে একটি ছোট শিশি। তার মধ্যে পীতাভ রঙের তরল, গোখরো সাপের বিষ। নরপিশাচ কার্ল কুপার সেই বিষ তার ডান হাতের কোটের ‘কফে’র মধ্যে একটি ‘সূচীমুখ পিচকারী’তেও কিছুটা রেখেছিল। সেটার সাহায্যেই সে নিজেকে শেষ করে।


‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে মগনলাল মেঘরাজ বলেন, ‘বিষ খুব খারাপ জিনিস আমি মনে করি। বিষের চেয়ে অন্য জিনিসে কাম দেয় বেশি!’

বিষের এই শোভাযাত্রা গোয়েন্দা সাহিত্যে জলদি থামার নয়। পরবর্তীতে মাকড়সার রস, বিষকুম্ভ, বিষের ধোঁয়া, মৃত্যুবিষ, বেলেডোনা... বাংলা গল্পের একেবারে শিরোনাম থেকেই বিষবাষ্প ভুরভুর করতে থাকবে। বাস্তবেও কোনও কোনও অপরাধের কাহিনি শুনলে মনে হবে, যেন গোয়েন্দা গল্পের পাতা থেকে নেওয়া। ১৯৩৩ সালের কুখ্যাত পাকুড় হত্যা মামলার কথা মনে করুন। পাকুড়ের রাজপরিবারের ছেলে অমরেন্দ্রকে হাওড়া স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে কে যেন ছুঁচ ফুটিয়ে দিল। অমরেন্দ্র ট্রেনে উঠে আবিষ্কার করলেন ডান হাতে কনুইয়ের উপরে এক ফোঁটা রক্ত আর তার সঙ্গে কী একটা তেল জাতীয় জিনিস। কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যু। পরে জানা গেল, সৎ ভাই বিনয়েন্দ্রের নির্দেশে তাঁর দেহে বিউবনিক প্লেগের জীবাণু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আইকনিক ঘটনা। তার রেফারেন্স টেনেই হেমেন্দ্রকুমারের ‘অন্ধকারের বন্ধু’-তে হেমন্ত বলছে, ‘ভারতবর্ষের সৌভাগ্য যে এ দেশের অপরাধীরা এখনো পাপকাজে বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে শেখেনি। অবশ্য এটা সকলেই জানে যে বিখ্যাত পাকুড় খুনের মামলায় প্রকাশ পেয়েছে; অপরাধীরা হত্যাকার্যে প্লেগের জীবাণু ব্যবহার করে অভাবিত চিন্তাশক্তির পরিচয় দিয়েছে।...অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষেও বৈজ্ঞানিক-অপরাধীর দল ভারী হওয়ার সম্ভাবনা আছে যথেষ্টই।’ তার সঙ্গেই ক্রমে মিশে যাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ছোবল। ব্যোমকেশের কাছে পুলিশ ইনস্পেক্টর পাণ্ডেজি আক্ষেপ করবেন, ‘বিদেশী সিপাহীরা এসে নানা রকম বিজাতীয় বজ্জাতি শিখিয়ে গেছে। কত রকম নেশার জিনিস, কত রকম বিষ যে দেশে ঢুকেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই! এই সেদিন পাটনার এক অতি সাধারণ ছিঁচকে চোরের কাছ থেকে এক শিশি ওষুধ বেরুল, পরীক্ষা করে দেখা গেল সেটা একটা সাংঘাতিক বিষ, দক্ষিণ আমেরিকায় তার জন্মস্থান। ব্যোমকেশ গড়গড়ার নল মুখের নিকট হইতে সরাইয়া অলস কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কী বিষ? কিউরারি?’ (‘বহ্নি-পতংগ’)

পাণ্ডেজি বলে চলেন, এ দেশে বিষ খাইয়ে মারার সংখ্যা খুব কম নয়। কিন্তু নেহাত গণ্যমান্য লোক না হলে বিশেষ হইচই হয় না। আত্মীয়স্বজনরা চাপা দিয়ে দেয়। পুলিশ সব জানতেও পারে না।

কিন্তু দুঁদে গোয়েন্দা তো জানবে! অতএব ব্যোমকেশ কাহিনিতে বিষের আনাগোনা মাঝেমধ্যেই লেগে থাকে। দুর্গরহস্য, অগ্নিবাণ, দুষ্টচক্র...। ‘চিড়িয়াখানা’ গল্পটি এই তালিকায় আলাদা করে বলতে হবে। সেখানে সুনয়না নিকোটিন বিষ দিয়ে মুরারিকে খুন করে। সেই নিকোটিন পানুগোপালের কানের ওষুধে মিশিয়ে তাকেও খুন করা হয়। কিন্তু নিশানাথ সেনকে মারার সময় ডাক্তার ভুজংগধর সে রাস্তা নেয় না। পাছে ডাক্তার হিসেবে তার উপরে সন্দেহ পড়ে, সে জন্য বিষ খাওয়ানো বা ইঞ্জেকশন দেওয়ার ধারকাছ দিয়েই যায় না। বিষের আসল কাজ তখনও বাকি। সেটা শরদিন্দুর ভাষাতেই শোনা যাক— ‘ভুজংগধর বনলক্ষ্মীর কাছে গিয়ে দাঁড়াইলেন। তারপর যে অভিনয় হইল তাহা বাংলাদেশের মঞ্চাভিনয় নয়, হলিউডের সিনেমা। বনলক্ষ্মী উঠিয়া ভুজংগধরের কণ্ঠলগ্না হইল। ভুজংগধর তাহাকে বিপুল আবেগে জড়াইয়া লইয়া তাহার উন্মুক্ত অধরে দীর্ঘ চুম্বন করিলেন। তারপর তাহার মুখখানি দুই হাতের মধ্যে লইয়া স্নেহক্ষরিত স্বরে বলিলেন,— চল এ বার যাওয়া যাক। মৃত্যু আসিল অকস্মাত, বজ্রপাতের মতো। দুজনের মুখের মধ্যে কাচ চিবানোর মতো একটা শব্দ হইল। দুজনে একসঙ্গে পড়িয়া গেল...।’

সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’য় অবশ্য এই সায়ানাইড বা নিকোটিন এপিসোড নেই। উত্তমকুমারের বাসুকিও গোখরো বা কেউটে নয়, বেবি পাইথন। নির্বিষ। আর ফেলুদাতে বিষ বলতে সবেধন নীলমণি ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডু’তে। হিমাদ্রির মৃত্যুর জন্য সেখানেও দায়ী এক চিকিৎসক! ‘...জল দিয়ে কি খুন করা যায়?’ কাঁপতে কাঁপতে তারস্বরে প্রশ্ন করলেন ডঃ দিবাকর। ‘না, জল দিয়ে যায় না, যায় বিষ দিয়ে!’ কপালের শিরা ফুলে উঠেছে ফেলুদার— ‘বিষ, ডঃ দিবাকর, বিষ! স্ট্রিকনীন!

যার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে টেট্যানাসের প্রতিক্রিয়ার কোনো পার্থক্য করা যায় না...।’ সেই আদি অকৃত্রিম স্ট্রিকনিন। আগাথা ক্রিস্টির লেখায় বার বার যার দর্শন মেলে। মিস মার্পল যখন বাংলা ছবিতে রাঙা পিসিমা হলেন, এই স্ট্রিকনিনই সেখানে কাজে এল (শুভ মহরত, ঋতুপর্ণ ঘোষ)। বলিউডি ব্যোমকেশেও গজানন্দ সিকদার স্ট্রিকনিন মেশানো স্যুপ খেয়ে মরল (ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়)।

কিন্তু সব গোয়েন্দা বার বার, ফেলুদা ওই এক বার। ‘বাদশাহী আংটি’তে র‌্যাট্‌ল ‍স্নেক পাবেন, ‘সোনার কেল্লা’য় কাঁকড়া বিছে পাবেন। সামনাসামনি গরল কিন্তু গরহাজির। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে মগনলাল মেঘরাজকে দিয়ে সরাসরি বলিয়েই নেওয়া হয়, ‘বিষ খুব খারাপ জিনিস আমি মনে করি। বিষের চেয়ে অন্য জিনিসে কাম দেয় বেশি!’ মনে হয়, বিষ খাইয়ে মারার ব্যাপারটাকে খানিকটা যেন খাটো করেই দেখছেন মগনলাল। না কি সত্যজিৎ নিজেই? পরিবারের নিকটজন অম্লানবদনে বিষ খাইয়ে কাউকে মেরে ফেলছে, এই চিত্রকল্পের মধ্যে যে হিমশীতল ক্রূরতা আছে, সেটা সম্ভবত তাঁর ব্রাহ্ম মূল্যবোধে ছোটদের গল্পের উপযোগী বলে মনে হয়নি। ফেলুদায় দুষ্টু লোকেরা তাই পারতপক্ষে বিষ ব্যবহার করে না। আর বিষের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে শ্রীমতি ভয়ংকরীদের যে অনুষঙ্গ জড়িয়ে থাকে, ফেলুদার পুরুষ-অধ্যুষিত বিশ্বে তারও ঠাঁই হয় না।

ফেলুদার আবির্ভাব (১৯৬৫) হতে হতে পৃথিবী জুড়ে অপরাধ সাহিত্যে অনেক পট পরিবর্তনও হয়ে গিয়েছে অবশ্য। ঠান্ডা যুদ্ধের পশ্চিম তত দিনে স্পাই-থ্রিলারে ঝুঁকেছে। বিষে রাজনীতির রং লেগে গিয়েছে। ক’দিনের মধ্যেই ভিয়েতনামে এজেন্ট অরেঞ্জ-এর হানাদারি শুরু হবে। পাশাপাশি এ বঙ্গে নারায়ণ সান্যালের কাঁটা বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শবরের মতো কিছু উদাহরণ বাদ দিলে ডিটেকটিভ গল্পের মূল ধারাটা অন্তত ক্রমেই অনেক বেশি করে শিশুসাহিত্যের দরজায় চলে যাবে। বিষদাঁতটি ক্ষইতে থাকবে। জারোয়াদের দ্বীপ ছাড়া সন্তু-কাকাবাবু বা মিতিনমাসিতে কিন্তু বিষ চট করে চোখে পড়ে না। বড়দের জন্য হলেও প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরাশর বর্মাও তেমন বিষধর নয়। ‘বাঁধানো ছবি’র গল্পে বিষ যত না আছে, বিষ নিয়ে ঠাট্টাতামাশা তার চেয়ে বেশি। ছোটদের কিকিরা-কর্নেল-অর্জুনে বিষের গন্ধ মেলে। কিন্তু এক কালে আগাথা ক্রিস্টি যেমন বলতেন— এক শিশি বিষ এনে হাজির করুন, এক্ষুনি একটা গল্প দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি— সেই ক্লাসিকাল ঘনঘোর আবহটি ক্রমেই অন্তর্হিত। পরিণাম? কাহিনি রইল, রহস্যও রইল, কিন্তু বিষল্যকরণী বিরলপ্রায়। বাঙালি এখন এমনিই নীলকণ্ঠ! তার জলে আর্সেনিক, বাতাসে কার্বন, খাবারে কীটনাশক। গল্পের বিষ সেখানে বিলকুল ফেল! বিষে বিষক্ষয় নইলে বলেছে কেন!

jagorib@gmail.com


ঋণস্বীকার: অরিন্দম দাশগুপ্ত

ছবি: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE