এ কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় যে, উৎপলকুমার বসু নমো-নমো করে সাহিত্য অাকাদেমি পাবেন মৃত্যুর আগের বছর, ফুস করে ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়ার পর পাবেন উৎকট নীরবতা, জনপ্রিয়তায় বিশুদ্ধ গোল্লা। এ-ও কোনও গোপন তথ্য নয় যে বাঙালি উৎপল বলতে মেরেকেটে দত্ত বুঝেছে, সে-ও লোকটা হেবি হাসির রোল করত বলে। লোকে কল্লোল থেকে যেমন শুধু ‘চলছে চলবে’ নিয়েছে, তেমনই উৎপলকুমার বসু শুনলে ক’দিন পর ‘চ্যাটার্জি তো অফস্পিন করত, এ সুভাষ বোসের কেউ হয় না কি, বসু যখন?’ বলে প্রশ্ন ছুড়বে।
এ রকমই হওয়ার কথা, কারণ রাজত্বটাই কুয়োর ব্যাঙের। একে তো বাংলা ভাষাটাই থার্ডক্লাস, ওতে লিখে নোবেল বা বুকার কিস্যু পাওয়া যায় না। তার ওপর লোকাল পুরস্কারের বাজারও বাড়ন্ত। সিরিয়ালের নওজওয়ানরা বাইশ বছরেই কিছু একটা পেয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু বাংলা লিখে দাঁত পড়ে এবং চুল উঠে অথর্ব হওয়ার আগে প্রাইজ পাওয়া নিষিদ্ধ। পঞ্চাশ বছর বয়সে এক-আধটা তরুণ লেখকের তকমা অবশ্য জুটলেও জুটতে পারে, তাই কম্পিটিশান-সাকসেসে অধ্যবসায়ী কবিরা তিরিশ থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে চলেছেন। ‘প্রিপারেশন কী রকম?’ জিজ্ঞাসিলে, বছর-বছর মাথা ঝাঁকিয়ে, যেন কলেজের তরুণীটি, ‘খুব খারাপ, এ বছরও ভাল রেজাল্ট হল না’ বলে বিলাপ করছেন। এঁদো পুকুরপাড়ে এক চিলতে জায়গা নিয়ে চুলোচুলি নাগাড়ে। নামজাদারা একে অন্যকে ঘ্যাঁক করে কামড়াচ্ছেন, বড়দারা ‘নমো কর’ বলে সমানে একে-তাকে দাবড়াচ্ছেন। নমোর লাইনেও গুঁতোগুঁতির চূড়ান্ত। এ ওর পা মাড়াচ্ছে, সে তাকে খিমচে দিচ্ছে, খেউড়ে আমোদিত জগৎ, বিশ্বময় এঁদো কলতলার কলরব। নজরে পড়তে হবে বলে বেঁটেরা পি-আর’এর ঘাড়ে চড়ে হাইট বাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। উঠতিরা দু’লাইন মনে এল কি এল না, ফেসবুকে উগরে দিয়ে তিনশো তেত্রিশটা লাইক আর ঢাকঢোল সহ ‘আমার কবিতাটা দেখুন’ বলে উচ্চকিত।
এখানে এ রকমই হওয়ার কথা। এই মাইক-ফোঁকা জমায়েতে অন্ধকারের কথ্যভাষা শুনলে লোকে হয় চুপসে যাবে কিংবা খিমচে দেবে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এ-ও কোনও অজানা কথা নয়: এই চড়া দাগের মেগাসিরিয়ালের মধ্যিখানে আদ্যন্ত নাগরিক সাট্লটির জায়গা ফিনিশ। এই গ্রাম্যতার কার্নিভালে সান্ধভাষা নো-নো, দুজন মানুষের অভ্র ও তামা খোঁজার প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ি বহুত বোরিং, ন্যারেটিভের গহনে এক চিলতে নিষ্পাপ বেবি-ফেস ফিচলেমির সূক্ষ্মতা সম্পূর্ণ আনফিট। ফলে এ-ও কোনও আপতিক ঘটনা নয়— তাঁর গল্পের পক্ষীরাজের মতোই কলকাতার বুকে বিচ্ছিরি ছায়া বুলিয়ে চুপচাপ উড়ে যাবেন উৎপলকুমার বসু। এক বার নয়, দু-দু’বার। এবং প্রথম বারের মতোই, এ বারও সেই নির্বাসনযাত্রা নিয়ে কেউ বিচলিত হবে না, কারণ, মন না মানলেও সে দিন বৃষ্টি নয়, শহরে চলবে ভোটলুঠের যাত্রাপালা।
bsaikat@gmail.com