আমায় রাখীজি বলেছিলেন, কারও দু’গালে এক সঙ্গে টোল পড়তে পারে না, এক বার এক দিকে পড়ে তো অন্য বার অন্য দিকে পড়ে। আমি মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু দিন আগে একটা লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছিল রিংকু, মানে শর্মিলা ঠাকুর। দেখি, একসঙ্গে দু’গালেই টোল পড়ছে ওর! চিনি তো সেই অপুর সংসারের পোস্টার থেকে। কিন্তু আলাপ অনেক পরে।
মোহন স্টুডিয়োতে ওকে দেখতাম তনুজা-র সঙ্গে দেখা করতে আসত। ভীষণ বন্ধু ছিল ওরা। মানে গলায়-গলায়। তনুজা তখন বিমলদার একটা ছবিতে অভিনয় করছিল, সেই সেটেই দেখা করতে আসত রিংকু। অবশ্য তখন ওকে আমার রিংকু বলে ডাকার হিম্মত ছিল না। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। আর ও ডাকসাইটে নায়িকা। কাঁধে একটা লেদার ব্যাগ ঝুলিয়ে খুব স্টাইলিশ ভঙ্গিমায় হেঁটে আসত। ওকে দেখেই আমার মনে হত, এর সঙ্গে নিশ্চয়ই ঝরঝরিয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। খুব টেনশন হত। কিন্তু তার পর দেখলাম, একদমই তা নয়। বাংলা বলত, আর কী সুন্দর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলত, গোটা বাঙালি জাতটাকেই আরও বেশি করে ভালবেসে ফেলতে ইচ্ছে করত তখন! তবে ওর মধ্যে গ্ল্যামারের সঙ্গে একটা গ্র্যাভিটি ছিল, যেটা ওকে সবার চেয়ে আলাদা করে রাখত। অপুর সংসার দেখে তো আর বুঝিনি যে রিংকু অসম্ভব বুদ্ধিমতী, শার্প এক জন মহিলা। অমন লীলায়িত ভঙ্গির সঙ্গে যে এমন ক্ষুরধার বুদ্ধি সহাবস্থান করতে পারে, রিংকুকে না দেখলে বুঝতাম না হয়তো।
অনেক দিন ধরেই ইচ্ছে ছিল, ওর সঙ্গে একটা সিনেমা করব। যখন ‘খুশবু’ ছবিটা করছি, একটা ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করার আর্জি নিয়ে ওর কাছে গেলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম বাসু ভট্টাচার্যকে, বাসু ওর খুব বন্ধু ছিল। রিংকু আবদার শুনে, গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্সটা করে দিল। এ বার তো আমার ফেরত দেওয়ার পালা। ‘মৌসম’ সিনেমাটা করার জন্য অনুরোধ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে রাজি। সেই প্রথম রিংকুর সঙ্গে আমার আলাপ জমে উঠল। তখনই জানতে পারলাম, ও পাগলের মতো শাম্মি কপূরের ফ্যান। কলকাতায় কলেজ কেটে শাম্মী কপূরের সিনেমা দেখতে যেত। আর বম্বে এসে প্রথম সিনেমাই কিনা স্বপ্নের রাজপুত্তুরের সঙ্গে!
‘মৌসম’ সিনেমায় ওর ডাবল রোল ছিল। মা আর মেয়ের। মা শান্ত, নরম, আর মেয়ে তেজি যৌনকর্মী। প্রথম দিনের শুটিং-এর তোড়জোড় চলছে, হঠাৎ সাউন্ড-রেকর্ডিস্ট ঈশাভাই এসে বললেন, ‘রিংকুর ডায়ালগ নিয়ে একটু অস্বস্তি হচ্ছে। তুমি ওটা যদি একটু পাল্টে দাও।’ ওর ডায়লগটা ছিল, ‘দেখো সাব, যো বোলোগে করুংগি, আপকে সাথ রহুংগি... লেকিন আপকে ইয়ারোঁকে সাথ নেহি সোউংগি...’ খুব স্পষ্ট ভাবে যৌনতার ডিলিং হচ্ছে কাস্টমার, মানে সিনেমায় সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে। আমি রিংকুকে বোঝালাম, ‘দ্যাখো, এই একটা ডায়ালগে তুমি চরিত্রটাকে এস্টাবলিশ করে দিচ্ছ। ফ্র্যাংক, জড়তাহীন একটা মেয়েকে তার পেশাসুদ্ধ ধরে দিচ্ছ। তা না হলে, হিন্দি সিনেমার সেই বস্তাপচা ডায়লগ, ‘ম্যায় বদন নহি বেচতি, আওয়াজ বেচতি হুঁ।’— যত্ত বাজে কথা। বাস্তবে এ সব হয় কি?’ যখন বোঝাচ্ছি, সঞ্জীব ছিল সেখানে। ও হঠাৎ বলল, ‘রিংকু, তুমি কোনও এক্সপ্রেশন ছাড়া এই ডায়ালগটা বলে দাও। দেখবে ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে।’ রিংকু বলল, ‘আপ ভি হরিভাই! এক্সপ্রেশন ছাড়া কথা বলা যায়?’ আর বিশ্বাস করবেন না, সঞ্জীব তক্ষুনি সেটা করে দেখাল। বলল, অন্য কথা ভাবতে ভাবতে বলে দাও। রিংকু ওর সঙ্গে কয়েক বার রিহার্সাল করার পর অপূর্ব শট দিল। এবং বলল, ‘আমি ঠিক এই মুহূর্তে চরিত্রটা জলের মতো পরিষ্কার করে বুঝতে পারলাম।’
সেই সময়টা আমাদের ভারী ভাল কেটেছিল। ‘বাবা’, মানে সইফ, তখন খুব ছোট, আর আমার মেয়ে মেঘনা দু’বছরের। ওরা খেলে বেড়াত সেটে। বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা, আলোচনা সবই একে অপরের সঙ্গে আমরা ভাগ করে নিতাম। সেই থেকেই ওদের পরিবারের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা। টাইগারকে আমি মনসুর বলে ডাকতাম। টাইগার বলত, ‘গুলজার, আমার ঠাকুমার কথা মনে পড়ছে। একমাত্র ঠাকুমাই আমাকে মনসুর বলে ডাকত।’ তবে মনসুর খুব স্ট্রিক্ট বাবা ছিল। আর রিংকুও অসম্ভব ডিসিপ্লিন্ড, কাম অ্যান্ড কমপোজ্ড। কাউকে বকুনিও এমন ভাবে দেবে, যাতে সে অপমানিত বোধ না করে, অথচ ভুলটা বুঝতে পারে।
এর পরে আর একটাই সিনেমা করেছি রিংকুর সঙ্গে। ‘নমকীন’। রিংকু করার আগে চরিত্রটা রেখা করছিল। সেটে একটু দুর্ব্যবহার করার জন্য আমি সিনেমা থেকেই রেখাকে বাদ দিয়ে দিই। কিন্তু শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে, বড় বড় আর্টিস্টের ডেট রয়েছে— ওয়াহিদাজি, শাবানা, সঞ্জীব। আমার তো মাথায় হাত। গেলাম রিংকুর কাছে। বললাম, ‘তোমায় করতেই হবে, কাল থেকেই শুটিং করো।’ রিংকু বলল, ‘অন্তত একটা দিন সময় দাও।’ পরের দিন সকালে বাসুকে নিয়ে আমার বাড়ি এল। বলল, ‘দ্যাখো, রেখা করছিল এটা। আজ থেকে হঠাৎ আমি করতে শুরু করে দিলে আমার সঙ্গে রেখার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। এটা আমি চাই না।’ আমি বললাম, ‘এ নিয়ে ভেবো না। নেহাতই প্রফেশনাল একটা ঝঞ্ঝাট। আমার সঙ্গেই রেখার সম্পর্ক খারাপ হবে না তো তোমার সঙ্গে।’ তবে সে দিনের পর আমার রিংকুর প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। সিনেমা নিয়ে একটা কথাও না জিজ্ঞেস করে ও প্রফেশনটার প্রতি আগে অনুগত থেকেছে, এ মেয়ের আভিজাত্যই আলাদা।
রিংকু সেই বিরল প্রজাতির মানুষ, যারা ‘ডিগনিটি’ শব্দটার মানে ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছে।