লাল জরি পাড় সস্তা সিল্কের শাড়ি যে অমন চিকন চিকন মোহময় হয়ে উঠতে পারে, সে মেয়েকে না দেখলে বিশ্বাস যেতাম না। কাটোয়া থেকে বাসে করে বর্ধমান ফিরছিলাম। বন্যার পর রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে ছইছত্তকার। টায়ার জবাব দিয়েছে কিছু ক্ষণ। অতঃপর আমরা চায়ের সন্ধানে। যেমনটা চাইলেই পাওয়া যায়, গাঁয়ের দিকে তেমন একটা বাজার মতো পাওয়া গেল। চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকানির হাঁকডাক, পড়ে আসা বিকেল, প্লাস্টিকের প্যাকেটের বেখেয়াল উড়ে বেড়ানো, আমাদের হাতে চায়ের গেলাস, আর ভেসে আসা মৃদু চটপটির শব্দ। না ঢাক না ঢোল, ছোট তালবাদ্য ঢিমে তালে দুলিয়ে দেওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। শব্দ বেড়ে এল। ধুনোর গন্ধ এল নাকে। আবছায়া থেকে স্পষ্ট হল এক দল পুরুষ-মহিলা। সবাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে ঠাকুরের নামগানে। গান কম, নাম বেশি।
মাঝে সেই মোহিনী। চোখ নেশারু, রং চিকচিকে গম, শরীরী ডাক ভয়ংকর। মা দুলছেন, ভক্তরা দুলছে, বাজার দুলছে, চোখ দুলছে সবার। মায়ের ভর হয়েছে গো। গাছের নীচের একটা বাঁধানো চাতাল মতো জায়গায় মা বসলেন। দু-এক জন গিয়ে ঢক করে প্রণাম। তারা পেল প্রসাদি ফুল আর বাতাসা। এক বয়স্ক মহিলা চেপে ধরে রয়েছেন সেই মোহিনীকে। হঠাৎই দেখি মোহিনী বেশ জোরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘আমি যাব না গো, যাব না।’ সঙ্গে সঙ্গে চটপটির বাজনা জোর হল, ধুনোর ধোঁয়া মাতিয়ে দিল বিকেলের আলো। আমি ঠিক দেখলাম বয়স্ক মহিলা গাছের দিকে মুখ ফিরিয়ে কী যেন একটা গিলিয়ে দিলেন মোহিনীকে। ব্যস, আবার সেই মাতোয়ারা মেজাজ, আবার ঢিমে তালে চটপটি, আবছা আবছা ধুনো, আবার পড়ে আসা বিকেলের মরে আসা আলো।
আমার খুব ভয় করল। তখন বুঝতে শিখেছি দেবদাসীর মানে। তা হলে কি এই মেয়েও? ভাবতে গিয়েও থরথরিয়ে উঠলাম। সত্যি বলতে কী, সিনেমা ছাড়া এমন দৃশ্য দেখিনি। আর আমি যা ভাবছি, ভুলও তো হতে পারে। হয়তো মেয়েটাই প্রকৃতিস্থ নয়। আমার কেন ভয় করছে? আমার তো সঙ্গে মা আছে। আমি তো একটু পরে বাসে করে চলে যাব। তবু পাকিয়ে এল ভেতরটা। যদি ওর কিছু হয়! খারাপ কিছু হবে না কি? যদি ওকে হাপিশ করে দেয়? যদি ওর সঙ্গে নিতান্তই খারাপ কিছু হয়? ওর সঙ্গে কি খারাপ কিছু প্রায়ই হয়ে থাকে? তাই যেতে চাইছে না?
প্রশ্নগুলো এমন দলা পাকাতে থাকল যে গেলাসের চা ঠান্ডা হয়ে গেল। কনডাক্টর এসে তাড়া দিল, টায়ার ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমি পাথরের মতো বসেই রয়েছি। দলটা মেয়েটাকে নিয়ে উঠল, পাশের একটা মেঠো রাস্তায় নামল। কার বাড়িতে কী সব পুজো আছে, সেখানে চলেছেন মা। আশীর্বাদ দেবেন। ওঁর ধ্যান খুব শক্তিশালী। যার জন্য যা চেয়ে দেন, সেটাই নাকি ফলে।
তা-ই যদি হয়, তা হলে মেয়েটা কাঁদল কেন? ওর কীসের ভয়? ও কারুর জন্য কিছু চায়, না কি ওকেই চায় সবাই? ও আশীর্বাদ দেয়, না কি অন্যকে তুষ্ট করে জীবনটা আশীর্বাদ হিসেবে নিতে হয়।
মনকে স্তোক দিলাম, এ সব হয়তো কিছুই নয়। আমার অবান্তর ভাবনা। কিন্তু মনের কু প্রায়ই ঠিক কথা ডাকে। ওর মারকাটারি রূপ যে অন্য ভাষা বলছে, বেশ বুঝতে পারছিলাম। তার কী হয়েছিল আমি জানি না। কিন্তু পড়ন্ত বিকেল যে মোহময়ী রূপের সঙ্গে মিশে ভয়ংকর হতে পারে, সেই বুঝলাম।
amisanchari@gmail.com