Advertisement
E-Paper

একটা [ভয়] কষ্ট লজ্জা

টি উবলাইটটা জ্বলছে। মাঝরাত তো বটেই। ঘুম ভাঙল সাদা ফ্যাটফ্যাটে আলোটা চোখে এসে পড়ল বলেই। আধো চোখ খুলে দুটো খুব চিন্তিত মুখ দেখতে পেলাম। বাবা ও মায়ের। ঘুমের খোসার স্তর ছাড়িয়ে যখন উঠলান, দেখলাম দিদি কী সব বলছে। দিদির জ্বর হয়েছে কাল বিকেল থেকে। এখন ঠোঁট দুটো লাল হয়ে গিয়েছে, ফর্সা মুখটা কেমন বেরং মতো। মা বলে চলেছে বাবাকে, ‘কী হবে গো? এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাই?’ বাবা খুব চিন্তিত।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

টি উবলাইটটা জ্বলছে। মাঝরাত তো বটেই। ঘুম ভাঙল সাদা ফ্যাটফ্যাটে আলোটা চোখে এসে পড়ল বলেই। আধো চোখ খুলে দুটো খুব চিন্তিত মুখ দেখতে পেলাম। বাবা ও মায়ের। ঘুমের খোসার স্তর ছাড়িয়ে যখন উঠলান, দেখলাম দিদি কী সব বলছে। দিদির জ্বর হয়েছে কাল বিকেল থেকে। এখন ঠোঁট দুটো লাল হয়ে গিয়েছে, ফর্সা মুখটা কেমন বেরং মতো। মা বলে চলেছে বাবাকে, ‘কী হবে গো? এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাই?’ বাবা খুব চিন্তিত।
আমি দিদির মুখের কাছে মুখটা নিয়ে গেলাম। শুনি ও বলেই চলেছে, ‘লাউ পাতার আকর্ষ আছে, শিম পাতার আকর্ষ নেই।’ আমি ভারী অবাক হলাম। এ সব তো দিদি জীবনবিজ্ঞানে পড়ে। খুব জ্বরে যে মানুষ ভুল বকে, তা তখন জানতাম না। দিদিই কত ছোট, আর আমি তো আরও ছোট। সবে ও জীবনবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেছে। কাল সকালে ওর উইকলি টেস্ট আছে আমি জানি। কিন্তু রাতে কেন পড়া বলছে, বুঝতে পারছি না। আর মা-বাবাই বা কেন এত ভয় পাচ্ছে। আমি জানি, জ্বর হলে সেরে যায় দু-দিন পর।
দিদির মাথা ধোয়ানো হচ্ছে, গা মোছানো হচ্ছে। কিন্তু ও আবার কিছু ক্ষণ পর একই কথা বলছে। আমার খুব ভয় করল। আমি দিদিকে খুব জোরে ঠেললাম, ‘অ্যাই দিদি, দিদি! ওঠ না। ওঠ।’ হাত ধরে দু-বার টানাটানি করলাম। মা হাঁইহাঁই করে উঠল। আমি দিদির মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লাম। বড় বড় চোখ করে দিদি তাকিয়ে আছে। আবার বলল, ‘লাউ পাতার আকর্ষ আছে, শিম পাতার আকর্ষ নেই।’ আমি হাত দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরলাম। মা ভীষণ বকল আমায়। ফের মাথা ধোয়ানো, থার্মোমিটার, ওষুধ।
আমার স্পষ্ট মনে আছে দিদি আমার দিকে এক বার তাকাল। আমি বললাম, ‘এই তো তুই ঠিক হয়ে গেছিস, এ বার ওঠ না।’ দিদির গায়ে হাত দিলে হাতটা যেন পুড়ে যাচ্ছিল। মা’র কথা না শুনে ফের ঠেললাম, ‘অ্যাই দিদি, দিদি, ওঠ বলছি এ বার!’ এ বার মা হাত ধরে আমায় খাট থেকে নামিয়ে দিল। আশ্চর্য, মা কেন বুঝতে পারছে না যে এটা আমার দিদি নয়! দিদি ঘুমের মধ্যে কথা বলে না। দিদিকে তো ঠিক করে দিতে হবে। ওকে ঘুম থেকে তুলে দিলেই, আমি ডাকলেই, ও আবার আমার দিদি হয়ে যাবে।

এক রাতে কি খামখা লোক বদলে যায়? মা-বাবা কি কিছুই বুঝছে না? আমার বুকের ভেতর গুড়ুম গুড়ুম করতে লাগল। তার পর আবার যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখি বাবা দিদিকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। কোলে ওঠার পক্ষে দিদি যদিও তখন বড়, কিন্তু আমি কিছু মাইন্ড করলাম না। ফের ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালে উঠে দেখি, ডাক্তারবাবু এসেছেন। দিদি প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে রয়েছে। আমায় দেখে একটু হাসল। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘খুব তো জ্বর বাধিয়েছ দেখছি। আজ আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না।’ ডাক্তারবাবুকে মা-বাবা এগিয়ে দিতে গেল।

আমি দিদিকে বললাম, ‘জানিস, তুই কাল সারা রাত বলেছিস— লাউ পাতার আকর্ষ আছে, শিম পাতার আকর্ষ নেই!’ দিদি বলল, ‘ধুর! তা হলে আমার মনে থাকত না?’ অনেক তর্ক করলাম কিন্তু ও কিছুতেই মানল না। মা আসার পর মা’কে সাক্ষী মানলাম। কিন্তু মা আমায় বিট্রে করে বলল, ‘ও কিছু নয়!’

কিন্তু আমি অনেক দিন অবধি জানতাম যে সেই মেয়েটা আমার দিদি ছিল না। অবশ্য বড় হওয়ার বিড়ম্বনা আমায় অসুখ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দেওয়ার পর আমার দিদি আমারই আছে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy