Advertisement
E-Paper

ওদেশি কাট এদেশি নকশা

আসানসোলে বড় হয়েছি। বাড়িতে টিভি ছিল না, কোনও ফিল্ম বা ফ্যাশন ম্যাগাজিনও আসত না। তাই ফ্যাশন-জগৎ সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না আমরা। তবু তারই মধ্যেই ওঁর নাম শুনতাম কখনও কখনও। ঋতু কুমার। নাইন বা টেন-এ যখন পড়ি, মাঝেমধ্যেই উঠত ওঁর কথা। তবে তখনও জানি না, এক দিন এই মানুষটা আমার এত প্রিয় হয়ে উঠবেন। সেই দিনটা এল শিগগিরই। আমি যাদবপুরে এমবিএ পড়ার জন্য কলকাতায় এলাম।

অগ্নিমিত্রা পল

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৪

আসানসোলে বড় হয়েছি। বাড়িতে টিভি ছিল না, কোনও ফিল্ম বা ফ্যাশন ম্যাগাজিনও আসত না। তাই ফ্যাশন-জগৎ সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না আমরা। তবু তারই মধ্যেই ওঁর নাম শুনতাম কখনও কখনও। ঋতু কুমার। নাইন বা টেন-এ যখন পড়ি, মাঝেমধ্যেই উঠত ওঁর কথা। তবে তখনও জানি না, এক দিন এই মানুষটা আমার এত প্রিয় হয়ে উঠবেন।
সেই দিনটা এল শিগগিরই। আমি যাদবপুরে এমবিএ পড়ার জন্য কলকাতায় এলাম। ‘বুটিক’ শব্দটার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। শুনলাম একটা বিশেষ ধরনের জামা-কাপড় পাওয়া যায় যে দোকানে, তাকে ‘বুটিক’ বলে। আর তখনই জানলাম, ছোটবেলায় ওই নামটা বার বার এত কানে আসত কেন। ঋতু কুমারই তো সেই মানুষ যিনি ‌ভারতে ‘বুটিক’ সংস্কৃতি এনেছেন। ফ্যাশনের ইতিহাসে সে এক শোরগোল ফেলে দেওয়া ঘটনা। আমি তো পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ওঁর স্টোরও দেখে এলাম। লক্ষ্য করলাম, ভারতীয় প্রিন্ট নিয়ে কত ডিটেলে কাজ করেন তিনি। প্রত্যেকটা কারুকাজ সূক্ষ্ম। আবার দূর থেকেও অবাক হয়ে দেখার মতো। মনে হবে, যেন স্বর্গে বসে বুনে দিয়েছে কেউ!
এমনিতে তো ফ্যাশন ডিজাইনারের দুনিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা রকমের জল্পনা। অনেকেই ভাবেন, পোশাক-শিল্পীরা বুঝি ভিনগ্রহের প্রাণী। হয়তো কোনও কোনও ডিজাইনার হাবে-ভাবে-আচরণে এই ধারণা ছড়িয়ে থাকবে। কিন্তু ঋতু একেবারেই ও রকম ধরাছোঁয়ার বাইরের কেউ নন। এমন এক উঁচু দরের ক্ষণজন্মা শিল্পী, দেশের আইকন, ডিজাইনার-সমাজের মাথার মণি, একটু অন্য স্তরের মানুষ হলে কার কী-ই বা বলার ছিল? কিন্তু ঋতু মানুষটাই যে অন্য। একেবারে মাটিতে গাঁথা তাঁর পা।

অমৃতসরে জন্মেছিলেন উনি। দিল্লির লেডি আরউইন কলেজের ছাত্রী। তার পরেই উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা চলে যান। শিল্পের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে চাইছিলেন। কিন্তু বিয়ে হল কলকাতায়। সে সময়েই হঠাৎ চলে এলেন টেক্সটাইল ডিজাইনিংয়ে। একেবারে কোনও ট্রেনিং ছাড়াই। গভীর শিল্পবোধ আর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল ওঁর। আর ইতিহাস বিষয়ে ছিল অসীম আগ্রহ। এই পেশায় সেটাই হল ওঁর তুরুপের তাস। তার সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন অসামান্য পরিশ্রম। সেই উলুবেড়িয়ার রানিহাটি থেকে খুঁজে খুঁজে কারিগর নিয়ে এসেছিলেন। বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে হাতের কাজ, তাঁতের কাজ, ছাপার কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। শ্রীরামপুরের কলোনি অঞ্চলে গিয়ে হ্যান্ডব্লক প্রিন্ট-এর খুঁটিনাটি বুঝতেন। এমন ছিল ওঁর নিষ্ঠা, আর নতুন কিছু করতে গেলে তার শিকড়টাকে খতিয়ে দেখে নেওয়ার বোধ।

সামান্য সম্বল পুঁজি করে, কুটিরশিল্পীদের ভরসায় ঋতু স্টোর খুললেন রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে। অতীত ভারতের বিলুপ্তপ্রায় শিল্পকে তিনি ফিরিয়ে আনলেন তাঁর পোশাক ভাবনায়, তাঁর প্রিন্ট-এ। সেই মুঘল জমানার জারদৌসি কাজ আবার ব্যবহার করতে শুরু করলেন। কখনও বিয়ের পোশাকে, কখনও পশ্চিমি পোশাকের মধ্যেই এ সব ভারতীয় প্রিন্ট বসিয়ে দিতে লাগলেন। স্লিভলেস টপ বা গাউনের মধ্যে জমকালো ভারতীয় সুতোর কাজ। অর্থাৎ কাটগুলো সব ওদেশি, কিন্তু তার মধ্যে নকশা নিখাদ ভারতীয়। জারদৌসি, ফুলকারি, আড়ি কাজ। দারুণ জমকালো। আগে খুব একটা দেখেনি কেউ এমনটা। তাই বেশ তাড়াতাড়ি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন উনি। কল্পনার অতীত সাফল্য পেলেন। শুরুর দিনটায় ওঁর দোকানে ছিল এক সেট হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টার আর মাত্র দুটো টেবিল। সেখান থেকে কতটা পথ পেরিয়ে এসেছেন ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেবে। এখন সারা দেশে ৩৫টা ফ্যাশন স্টোর ওঁর! দুবাইতেও পৌঁছে গেছে তাঁর বিপণি। কারখানায় কাজ করেন হাজার হাজার মানুষ। কত লোকের রুটিরুজি আসছে সেখান থেকে!

তিনি নিজের পোশাকে ঐশ্বর্য রাই, অনুষ্কাশংকর বা জেমাইমা গোল্ডস্মিথ-এর মতো ব্যক্তিত্বকে সাজিয়েই থেমে যাননি। ইচ্ছে করলেই বলিউডের নায়িকাদের পোশাক নকশায় মন দিতে পারতেন। মুম্বই হয়তো বা বর্তে যেত তাতে। কখনও কখনও তাঁর ডিজাইন করা বিদ্যা বালন-এর পোশাক বা করিনার বিয়ের সারারা (বন্ধু শর্মিলার খানদানি ওয়েডিংওয়্যারটাকে অল্প রিমডেলিং করেই তাঁর ছেলের বউকে সাজিয়েছিলেন ঋতু) দেখে যে রকম হইচই ওঠে টিনসেল টাউনে! কিন্তু সে দিকেও বড় একটা পা দেননি তিনি। বরং আরও অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন নিজের সৃষ্টিশীলতার সীমানা। গ্রামবাংলার ধুঁকতে থাকা শিল্পীরা যাতে একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, তার জন্য ক্রমাগত লড়াই করে গিয়েছেন। তার পর ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘অল ইন্ডিয়া আর্টিজানস অ্যান্ড ক্রাফ্ট ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। সে কাজে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন ফ্যাব ইন্ডিয়া, লায়লা তয়েবজি আর অনোখি’র প্রীতম সিংহদের মতো মানুষ। ঋতুর শিল্পী-জীবন তো বরাবরই দেশি-বিদেশি পুরস্কারে উপচে পড়েছে। তবে বোধহয় সেরা স্বীকৃতি এল ২০১৩ সালে। পদ্মশ্রী পুরস্কার দিয়ে ভারত সরকার সম্মানিত করল তাঁকে।

ঋতুর কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় বুঝি নিরলস সাধনায় ডুবে থাকা কোনও একাগ্র ঋষি-তপস্বীর জীবন। সবটুকু নিংড়ে চারুকলার দেবীর আরাধনা করে যাচ্ছেন। দেশের সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন পুরোটা। সে কথাটাও যেমন সত্যি, তেমনই আর একটা অবাক করা অধ্যায়ও আছে ঋতুর জীবনে। তিনি কিন্তু সংসার করেছেন চুটিয়ে। আশ্চর্য দক্ষতায় সামলে নিয়েছেন পরিবার আর কেরিয়ার। কী অপূর্ব মানুষ তৈরি করেছেন নিজের সন্তানকে! ওঁর ছেলে অশ্বিন সিনেমা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে। তার কাজ তো অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডেও মনোনয়ন পেয়েছে। ছেলের সঙ্গে ‘লেবেল’ নামে নতুন একটা কালেকশনও শুরু করেছেন। অসম্ভব কোমল একটা মায়ের মন রয়েছে ওঁর। অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা যাতে একটু কম দামে ঋতু কুমার ব্র্যান্ড-এর পোশাক পরতে পারে, তারও ব্যবস্থা রেখেছেন নিজের স্টোরে। তার সঙ্গে জিইয়ে রেখেছেন নিজের শখ-আহ্লাদগুলোও। শত কাজের মধ্যেও দেশ-বিদেশি সাহিত্যে নিজের আগ্রহটা বাঁচিয়ে রেখে গেছেন সযত্নে।

খুব মিল পাই আমি নিজের সঙ্গে ঋতু কুমারের। ঋতুর মতোই প্রশিক্ষণ ছাড়াই ডিজাইনিং পেশায় চলে এসেছি। ফ্যাশন-প্রযুক্তির বিশেষ কিছু না জেনেই মাইনের টাকা দিয়ে, খুব অল্প সঞ্চয় নিয়ে পোশাক তৈরি করতে শুরু করেছিলাম আমিও। কিছুটা একই রকম ভাবনা। সেই আনারকলি, শাড়ি নিয়ে কাজ। পশ্চিমি পোশাকের ভাঁজে ভারতীয় সুতোর কাজের ছোঁয়া। এই নিয়েই তো আমার জগৎ। তাই আমার কাছে ঋতু কুমার এক বিশাল অনুপ্রেরণা। সত্তর পেরিয়েও ওঁর এই পরিশ্রম করে চলা দেখে রোজ শিখি আমি। ঠিক ওঁর মতোই মাটি আঁকড়ে বাঁচতে চাই আর সৃষ্টি করে যেতে চাই। আর খুব করে আশায় বুক বাঁধি, নিশ্চয়ই সামনাসামনি আলাপ হবে এক দিন। ওঁকে কত কী যে বলার আছে আমার!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy