Advertisement
E-Paper

কানের কাছে ফিসফিস

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়আবার একটা ভূতের গল্প লিখতে হল। না লিখে উপায় ছিল না। দিনরাত কানের কাছে ঘ্যান-ঘ্যান প্যান-প্যান শুনতে কার ভাল লাগে? তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলাম। খেতে যাচ্ছি, শুতে যাচ্ছি, আড্ডা মারতে যাচ্ছি, সিনেমা দেখতে যাচ্ছি যখন যেখানেই যাই, কানের কাছে কেবল ফিসফিস, ‘কী হল দাদা?

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

আবার একটা ভূতের গল্প লিখতে হল। না লিখে উপায় ছিল না। দিনরাত কানের কাছে ঘ্যান-ঘ্যান প্যান-প্যান শুনতে কার ভাল লাগে? তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলাম। খেতে যাচ্ছি, শুতে যাচ্ছি, আড্ডা মারতে যাচ্ছি, সিনেমা দেখতে যাচ্ছি যখন যেখানেই যাই, কানের কাছে কেবল ফিসফিস, ‘কী হল দাদা? ভুলে গেলেন নাকি আমাদের?’

আমি বলি, ভুলব কেন? লিখলাম তো এতগুলো গল্প। আর তা ছাড়া শুধু ভূত নিয়ে লিখলেই চলবে? মাতাল, গোঁয়ার, চোর, ডাকাত, গোয়েন্দা এরা আছে না? এরা কী দোষ করল?

তবু শোনে না। ইনিয়ে-বিনিয়ে সেই এক কথা ভূতের গল্প চাই। সমাজে ওদের প্রতিষ্ঠা দরকার। আবার কখনও কখনও ভয় দেখায় না লিখলে ঘাড় মটকে দেবে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ঘাড় মটকাবার সাধ্য যে ওদের নেই, তা ভাল করেই জানি।

আমার বেপরোয়া ভাব দেখে আবার অনুনয়-বিনয় শুরু হয়। শেষে বিরক্ত হয়ে বলি, আচ্ছা বাবা আচ্ছা। লিখছি। বেশি ঝামেলা কোরো না তো।

‘বাঁচালেন দাদা’, গদগদ হয়ে বলে ওরা, ‘বেশ জমিয়ে একটু লিখুন দেখি, যাতে লোকের তাক লেগে যায়। আমরাও যে একেবারে ফ্যালনা নই, বুঝুক এক বার।’

ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় একটা শুঁটকো মতো ভূত বলে ওঠে, ‘আপনি ভাববেন না দাদা। আপনার সমস্ত কাজ আমরা করে দেব। আপনি শুধু লিখে যান।’

‘ঠিকই তো। আমরা থাকতে দাদার চিন্তা কী’, মামদো ভূত বলে, ‘কী করতে হবে বলুন। আপনার জন্য আমাদের জান হাজির।’

‘বাজে কথা বলিস না। তোর জান আছে যে হাজির থাকবে? জান খুইয়েই তো মামদো হয়েছিস’, স্কন্ধকাটা তড়পায়।

‘তুই আর বেশি কথা বলিস না। তোর তো মাথাই নেই’, মামদোও ছাড়বার পাত্র নয়।

‘আঃ! তোমরা দেখছি নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া করে মরবে’, চেঁচিয়ে ওঠে বেম্মদত্যি। তার পর কানে পৈতেটা জড়িয়ে সে বলে, ‘আপনি কারও কথা কান দেবেন না দাদা। আমি কথা দিচ্ছি, আপনার যা কাজ আছে, আমাদের বলবেন। সব আমরা করে দেব।’

সত্যিই তাই। আমার কাজকম্মো কিছুই করতে হয় না তার পর থেকে। সেটা বুঝলাম এক দিন মায়ের কাছ থেকে রেশন কার্ড চাইতে গিয়ে। মা চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘তোর কি ভিমরতি হয়েছে সঞ্জু? কালকেই তো আমার কাছ থেকে কার্ড আর টাকা নিয়ে গিয়ে রেশন নিয়ে এলি। আজ আবার রেশন কার্ড চাইছিস যে বড়?’ মা কেমন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকেন। বুঝতে চেষ্টা করেন ছেলের মাথায় কোনও গণ্ডগোল হল কি না।

সেই থেকে বাজার যাওয়া, ধোপা বাড়িতে কাপড়-জামা দিতে যাওয়া, ইলেকট্রিকের বিল, ফোনের বিল জমা করতে যাওয়া ইত্যাদি কিছুই আমায় করতে হয় না। বেশ আছি। শুধু মাঝে মাঝে কানের কাছে ফিসফিস করলে বলি, ‘হচ্ছে হচ্ছে। অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সময় লাগবে। এ কি মাটি কোপানো নাকি? কোদাল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেই হল? ওরা বলে, ‘ঠিক আছে দাদা, ঠিক আছে। আপনি ধীরেসুস্থে লিখুন। তবে দেখবেন, গল্পখানা যেন বেশ জম্পেশ হয়। লোকে যেন বলে, হ্যাঁ, একখানা গল্প বটে।

কিন্তু ইদানীং হয়েছে কী, জুতসই কোনও প্লট মাথায় খেলছে না। দু’এক বার বসেও ছিলাম কাগজ-কলম নিয়ে। কিন্তু এক লাইনও লেখা এগোয়নি। মাঝে মাঝে এ রকম হয়। মাথাটা কেমন জ্যাম হয়ে যায়। কিছুই বেরোতে চায় না। ভাবলাম, যাই, মাথায় একটু ঠান্ডা হাওয়া লাগিয়ে আসি। তাতে যদি কিছু হয়।

লেকের ধারে হাঁটছি। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। বেরোবার সময় মা ফরমাশ দিয়ে দিলেন পিসিমার বাড়ি গিয়ে দুটো বড় বড় কাঁঠাল রাখা আছে, নিয়ে আসার জন্য। বোঝো অবস্থা। মা তো বলেই খালাস। পিসিমার বাড়ি কি এখানে? দুটো বাস পালটে যেতে হবে সেই কোন ধ্যাধেড়ে গোবিন্দপুরে। কিছুতেই মাকে বোঝাতে পারলাম না যে, কাঁঠাল অতি অসার বস্তু। বাড়িতে থাকলে বিশ্রী গন্ধে বাড়ি ছেয়ে যায়। রাজ্যের মাছি এসে ভনভন করে। কিন্তু মা-র ওই এক কথা। পিসিমার গাছের কাঁঠাল। আদর করে দিচ্ছেন। না নিলে কষ্ট পাবেন। কিন্তু আমার কষ্টের কথা আর কে বোঝে? ভেবেছিলাম লেকের ঠান্ডা হাওয়ায় মাথাটা একটু জুড়োবো। তা নয়, এখন ছোট কাঁঠাল আনতে।

এই সব সাতসতেরো যখন ভাবছি, তখন কানের কাছে আবার ফিসফাস আওয়াজ, ‘কী দাদা, প্লট ভাবছেন বুঝি?’ দুত্তোর প্লট! রাগ হয়ে গেল ভীষণ। চেঁচিয়ে বললাম, ‘তোমাদের ওই এক কথা ছাড়া আর কি কোনও কথা নেই?’

আমার চেঁচানি শুনে ফিসফাস বন্ধ। মনে হয় ঘাবড়ে গিয়েছে। কিন্তু সে আর কত ক্ষণের জন্য? কিছু ক্ষণ পরেই আবার ফিসফাস আওয়াজ, ‘দাদা, রাগ করছেন কেন? বলুন না কী করতে হবে?’

তাই তো! আমি এত ভাবছি কেন? এদের দিয়েই তো কাঁঠাল দুটো নিয়ে আসা যায়। গম্ভীর মুখে বললাম, ‘একটা কাজ করো তো ন্যায়রত্ন লেনের চার নম্বর বাড়িতে দুটো কাঁঠাল রাখা আছে। ও দুটো আমাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে রেখে আসতে হবে। পারবে?’

বলা মাত্র সব ভোঁ ভাঁ। বুঝলাম কাজটা মনঃপূত হয়নি। তাই সটকেছে। হয়তো এ কাজটা একটু ভারীই হয়ে গেছে ওদের পক্ষে। এ তো আর বিল জমা দেওয়া নয়। ভালই হল। এ বার থেকে যখন গল্প নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে আসবে, তখন ভারী ভারী কিছু কাজ গছিয়ে দিলেই হবে। পালাতে আর পথ পাবে না।

কাঁঠাল আনানো হল না বটে, তবে মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল। দিনরাত ঘ্যানঘ্যান ফিসফাসের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। মনের খুশিতে ভাবলাম, আজ নয়, কাল ভোর ভোর বেরিয়ে কাঁঠাল দুটো নিয়ে আসা যাবেখন। তখন বাসও ফাঁকা পাওয়া যাবে। বয়ে আনতে অসুবিধা হবে না।

মাথায় খানিক হাওয়া লাগিয়ে সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফিরতেই মা হাঁ হাঁ করে এলেন, ‘কী ব্যাপার বল তো, সঞ্জু? দিদি ফোনে কী বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘দিদি’ অর্থাত্‌ আমার পিসিমা।

কী বলছেন পিসিমা?

‘তুই দুপুর দুপুর কখন বেরিয়ে কাঁঠাল দুটো নিয়ে এসেছিস টের পাইনি। আমার একটু চোখ লেগেছিল। ঘুম ভাঙল দিদির ফোনে। বলছেন, যে কাঁঠাল দুটো তিনি নিয়ে আসতে বলেছিলেন, ও দুটো রান্নাঘরে রেখেছিলেন, খুঁজে পাচ্ছেন না। আমিও অবাক! শেষে দেখি কাঁঠাল দুটো আমাদের বারান্দায় রাখা। অত বড় কাঁঠাল দুটো তুই ওদের বাড়ি থেকে নিয়ে এলি, আর ওরা টের পর্যন্ত পেলে না? এ তো অদ্ভুত ব্যাপার!’

আমি বলি, কাজটা যখন হয়েই গেছে, তখন অত ভাবার কী আছে?

‘সে কথা নয়। আমার কথা হল, ওঁদের বলে আসা উচিত ছিল। এ তো একটা ভদ্রতা। আর তোকেও বলিহারি, পিসিমার বাড়ি গেলি, অথচ পিসিমার সঙ্গে দেখা করে এলি না একবারটি?’

কী আর বলব, চুপ করে রইলাম। মাকে তো আর আসল কথা বলা যায় না।

‘কী জানি বাবা, তোদের ব্যাপারস্যাপার বোঝা দায়’, বেশ রাগী গলায় মা বললেন।

আমি আর কী করি সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরে চলে এলাম। অগত্যা। এ বার তো লিখতেই হবে গল্পটা। আর তো কোনও উপায় নেই। কাগজ-কলম বার করে সবে বসেছি, এমন সময় কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজ, ‘দাদা হল গল্পটা?’

rabibarer anandamela ranjan bandopadhay kaner kache fisfis
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy