Advertisement
০৫ মে ২০২৪

খু দ কুঁ ড়ো

উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে।’ কিন্তু আমি যার কথা বলছি, তিনি মাত্র ছ’বার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হয়েছিলেন। যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ সেই চল্লিশের দশকে, ম্যাট্রিকে এক বিষয়ে ফেল হলেই ফেল। কম্পার্টমেন্টাল বা সাপ্লিমেন্টারির ব্যবস্থা ছিল না। ধ্রুবদা ক’টি বিষয়ে ফেল হতেন, তা আমি জানি না। তবে তাঁর মুখেই শুনতাম, ইংরিজিতে তাঁর দুর্মর দুর্বলতা।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে।’ কিন্তু আমি যার কথা বলছি, তিনি মাত্র ছ’বার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হয়েছিলেন। যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ সেই চল্লিশের দশকে, ম্যাট্রিকে এক বিষয়ে ফেল হলেই ফেল। কম্পার্টমেন্টাল বা সাপ্লিমেন্টারির ব্যবস্থা ছিল না। ধ্রুবদা ক’টি বিষয়ে ফেল হতেন, তা আমি জানি না। তবে তাঁর মুখেই শুনতাম, ইংরিজিতে তাঁর দুর্মর দুর্বলতা। দেশ স্বাধীন হয়েছে, ইংরেজ চলে গেছে, কিন্তু ইংরিজিটা কেন রয়ে গেছে এই নিয়ে ধ্রুবদার বিবিধ জ্বালাময়ী ভাষণ আমি শুনেছি। হ্যাঁ, ধ্রুবদা প্রায়ই ভাষণ দিতেন। যত দূর জানি তিনি কোনও পার্টি-টার্টি করতেন না। আলিপুরদুয়ার জংশন তখন সবে গড়ে ওঠা একটা রেল শহর। শহর না বলে কলোনি বলাই ভাল। রাস্তাঘাট হয়নি, বাজারহাট বসেনি, তেমন জনসমাগমও হয়নি। তখন মাইকের প্রচলন ছিল না, মঞ্চ তৈরি করার রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু ধ্রুবদার বক্তৃতা দেওয়ার নেশা ছিল। সামাজিক বৈষম্যের যে কোনও ইস্যুতেই তিনি একটা টুল জোগাড় করে তার ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতেন। অনেকে শুনত এবং অনেকে হাসাহাসিও করত।

মানুষটি বেঁটে, মোটাসোটা, ঝাঁকড়া চুল এবং বোকাসোকা পরোপকারী ভালমানুষ গোছের। মুখে সর্বদা সরল হাসি। কার মড়া পোড়াতে হবে, কার জন্য ডাক্তার ডাকতে হবে, কোন বউদির জর্দা এনে দিতে হবে, কোন মাসিমার বাজার করে দিতে হবে, ধ্রুবদা এক পায়ে খাড়া। মাথা ছিল না বটে, কিন্তু পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে ধ্রুবদা গাঁকগাঁক করে পড়তেন, সারা পাড়া জানান দিয়ে। পড়া মানে টেনে মুখস্থ করা। বিশেষ করে ইংরিজি। তখন এম সেনের ইংরিজি নোটবইয়ের খুব চল ছিল। ধ্রুবদা সেই মানেবইটি আদ্যোপান্ত মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মুশকিল হল, লিখতে গিয়ে কোনও জায়গায় আটকে গেলে বানিয়ে ম্যানেজ করতে পারতেন না। হয়তো মাঝখানে একটা শব্দ ভুলে গেছেন, তা হলে বাকিটা আর মনে পড়বে না। ওই শব্দটা ধরিয়ে দিলেই বাকিটা ফের গড়গড় করে লিখে যেতে পারবেন। তাই প্রায় বছরেই পরীক্ষায় বসে ধ্রুবদা কোনও জায়গায় আটকে গেলেই আশেপাশের ছেলেদের ধাক্কা দিয়ে বলতেন, দাদা আপনি কি এম সেন?... ও দাদা, আপনি কি এম সেন? লোকে বিরক্ত হত।

ধ্রুবদার একমাত্র শত্রু ছিলেন পোস্টমাস্টার কালিদাসবাবু। তাঁদের একটা চিঠি ভুল ঠিকানায় ডেলিভারি হওয়ায় ধ্রুবদা গিয়ে কালিদাসবাবুর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন, ‘আপনারা কি ইংরিজি জানেন না নাকি? পরিষ্কার ঠিকানা লেখা রয়েছে, তবু ভুল ঠিকানায় চিঠি যাবে কেন?’ এক কথায়-দু’কথায় ঝগড়া লেগে যাওয়ায় কালিদাসবাবু রেগে গিয়ে বলেন, যা যা মুখ্যু কোথাকার! ম্যাট্রিকে তো পাঁচ বার ডাব্বা খেয়েচিস, এসেছে ইংরিজি শেখাতে!

ধ্রুবদার দুর্বলতম জায়গায় আঘাত। সে বার সত্যিই পঞ্চম বার তিনি ফেল করেছিলেন। কিন্তু সমান তেজে বলেছিলেন, আপনি তো পাবলিক সারভেন্ট! আপনি আমার জুতো পালিশ করুন। এর ফলে কালিদাসবাবু তেড়ে এসে ধ্রুবদাকে ‘যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা’ বলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন।

সেই রাগে ধ্রুবদা কালিদাসবাবুর বিরুদ্ধে একটা গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। প্রায়ই রেল কোয়ার্টারের অস্থায়ী সেই পোস্ট অফিসের উলটো দিকের মাঠে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ডাক বিভাগের দুর্নীতি ফাঁস করে বক্তৃতা দিতেন, পোস্ট অফিসের লোকেরা ঠিকমত চিঠি বিলি করে না, পার্সেল হাপিশ করে দেয়। লেটারবক্সে চিঠি পড়ে থাকে, ক্লিয়ারেন্স হয় না, এই সব। দু-চার জন শুনত দাঁড়িয়ে, গুরুত্ব দিত না। কালিদাসবাবুও শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলতেন, ওরে মুখ্যু, পোস্ট অফিস বানান করতে পারিস? ধ্রুবদাও সমান তেজে জবাব দিলেন, আপনি তো টুকে পাশ করেছেন! দুজনে ধুন্ধুমার লেগে গেল ফের। ধ্রুবদা আর কালিদাসবাবুর বিবাদের কথা বেশ চাউর হয়ে গিয়েছিল।

পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! আর ঘটে বলেই আমাদের একঘেয়ে স্তিমিত জীবনের ‘আবার খাব’ সন্দেশের মতো একই ছাঁচে-ঢালা দিন-যাপনের মধ্যে নতুন বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে। জীবন সহনীয় হয়। অঘটনটা ঘটল দু’বছর বাদে। সে বার ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, ধ্রুবদা সপ্তম বারের বার থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন।

এই সংবাদে সারা আলিপুরদুয়ার জংশনে হইচই পড়ে গেল। হাটে-মাঠে-বাজারে লোকের মুখে মুখে একটাই কথা, ধ্রুব ম্যাট্রিক পাশ করেছে! সে বার আলিপুরদুয়ারের একটি ছেলে ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ডও করেছিল। কিন্তু তাকে নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাল না। সন্ধের পর ধ্রুবদাকে নিয়ে মিছিল বেরিয়ে পড়ল। সবার সামনে গ্যাঁদা ফুলের মালা গলায় হাস্যমুখে ধ্রুবদা, তাঁর মুখের কাছে এক জন হ্যাজাক তুলে ধরে আছে। আর ধ্রুবদা হাত জোড় করে পাবলিকের অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। বিশেষ করে পোস্ট অফিসের সামনে জনা পঞ্চাশেকের সেই জনতা ‘ধ্রুব তপাদার জিন্দাবাদ, ধ্রুব তপাদার জিন্দাবাদ’ ধ্বনিও দিল ঘন ঘন। কালিদাসবাবুর বাড়ি সে দিন নিষ্প্রদীপ ছিল।

ধ্রুবদা সেখানেই থামলেন না। কাছাকাছি কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে আই এ ক্লাসে অ্যাডমিশন নিয়ে এলেন। প্রবীণ কেপুবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ধ্রুব, তুমি আরও পড়বে না কি?’ ধ্রুবদা বললেন, পড়ব না মানে? ম্যাট্রিকে পাশ করেছি, এখন কি আর থামা যায়?

বাস্তবিক ওই ম্যাট্রিকটাই বোধহয় ছিল ওঁর স্টাম্বলিং ব্লক। ওটা পেরিয়েই উনি রাজপথের সন্ধান পেলেন বোধহয়। তত দিনে আমরা আলিপুরদুয়ার ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে গিয়েছি। হাওয়ায় খবর পেয়েছিলাম, ধ্রুবদা ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ, ডিস্টিংশনে বি এ পাশ করে কলকাতায় এম এ পড়তে গেছেন। তার পর আর খবর জানি না।

বেশ কয়েক বছর পর, যখন আমি একটা স্কুলে মাস্টারি করি, তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে একটা ইংরেজি গ্রামার বই পাঠ্য ছিল। লেখকের নাম প্রফেসর ডক্টর ডি তপাদার। আমি অবশ্য খোঁজ করে দেখতে যাইনি যে, এই অধ্যাপক ডক্টর ডি তপাদার লোকটি আসলে কে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shirshendu mukhopadhyay shirshendu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE