Advertisement
E-Paper

চেষ্টার ফল

ছোটমামা চলে যাবার পর আর কালক্ষেপ করল না লিটন। বইপত্র, কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল রুটিন তৈরি করতে। নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ের মূল্যের কথা মাথায় রেখে তৈরি হবে রুটিন। লিটনের মায়ের তো বিশ্বাসই হয় না।

শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১৫
ছবি: দেবাশীষ দেব।

ছবি: দেবাশীষ দেব।

ছোটমামা চলে যাবার পর আর কালক্ষেপ করল না লিটন। বইপত্র, কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল রুটিন তৈরি করতে। নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ের মূল্যের কথা মাথায় রেখে তৈরি হবে রুটিন। লিটনের মায়ের তো বিশ্বাসই হয় না। রাত ন’টা বাজে। এখন ছেলের হঠাত্‌ এত মনোযোগ পড়ায়! নিশ্চয়ই ছোটমামার ভোকাল টনিকে কাজ হয়েছে, ভাবলেন লিটনের মা। ছেলেকে কিছু জিজ্ঞেস করার জো নেই। মা বিরক্ত কোরো না, এ বার আমাকে আশি পারসেন্ট তুলতেই হবে। সে কী রে, তুই তো কোনও দিনই সিক্সটি পারসেন্টের বেশি নম্বর পাস না। এ বার আবার আশি পারসেন্ট পাবার জন্য ক্ষেপে গেলি কেন? মা-র কথায় মুচকি হেসে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে লিটন।

রুটিনে যেমন অঙ্ক, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ইংরাজি সহ সমস্ত বিষয়ের সময় নির্দিষ্ট হল, তেমনি তাতে উল্লেখ করা হল ঘুমের সময়, টিভি দেখার সময়, খেলার সময়, খাওয়ার সময় এমনকী চান করার সময় পর্যন্ত। ছোটমামা বলেছেন, শুধু রুটিন তৈরি করলে হবে না সেটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনে চলতে হবে। শুধু পড়লে হবে না, পড়ার পাশাপাশি খেলাধূলা এবং শরীরের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি। লিটন ঠিক করল পর দিন সকাল থেকেই এই রুটিন কার্যকর হবে। ছুটির পরেই পরীক্ষা। হাফ ইয়ারলির থেকে কুড়ি পারসেন্ট নম্বর বাড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক পরিশ্রম করতে হবে। শ্রেয়া, রাঘব, রাজীবদের মতো স্ট্যান্ড না করলেও চলবে। ছোটমামা বলেছেন, স্ট্যান্ড করাটা কোনও বড় কথা নয়, আসল হল পারসেন্টেজ। আরও বলেছেন, সমস্ত বিষয়ের পড়ার জন্য সময় নির্দিষ্ট করলেই চলবে না, মন দিয়ে পড়তে হবে। তা হলেই সাফল্য দরজায় এসে কড়া নাড়বে। ছোটমামার উপদেশকে শিরোধার্য করে রুটিন অনুযায়ী চলার জন্য শপথ নিল লিটন।

নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া, ঘুম, খেলার পাশাপাশি অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস সহ সমস্ত বিষয়ের যত্ন নিল লিটন। সমস্ত সিলেবাস দু’বার করে রিভাইজ করা হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল। একটুও সময় নষ্ট করেনি লিটন। মোটমাট অ্যানুয়াল পরীক্ষার প্রিপারেশন বেশ ভালই লিটনের। এখন আশি শতাংশ নম্বর পেয়ে নাইনে উঠতে পারলেই কেল্লা ফতে! ভাবতে ভাবতে লিটনের বাবা ঘরে ঢুকে দেখলেন, আনন্দে লিটনের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, ঠোঁটের কোণে একচিলতে মিষ্টি হাসি। ছেলের এই অবস্থা দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। একা একা উদাসীন বসে ছেলে হাসছে, এ তো ভাল কথা নয়। চিন্তিত হয়ে তিনি লিটনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোর? একা একা হাসছিস? কী চিন্তা করছিস? লিটন অস্ফুটে বলল, আশি পারসেন্ট হবে তো বাবা? এই কথায় তিনি আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছেলেটা কি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ল নাকি? এখন কী হবে উপায়? সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা। পাশের ঘরে গিয়ে লিটনের মাকে একহাত নিলেন তিনি। কে তোমাকে বলেছিল ছেলেটাকে অত চাপ দিতে। সারা দিন ওর পিছনে তোমার চিত্‌কার না করলে বুঝি ভাত হজম হয় না? এখন পরীক্ষার টেনশনে ছেলেটা ভুল বকতে শুরু করেছে। তখন পাশের ঘর থেকে লিটন এসে হাজির। না বাবা, পরীক্ষায় আমি ঠিক আশি পারসেন্ট নম্বর তুলবই। আমি যে ছোটমামাকে কথা দিয়েছি। আমাকে একটু সাহায্য করবে বাবা? অবাক হয়ে লিটনের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, সাহায্য? হ্যাঁ বাবা, পরীক্ষার আর মাত্র ক’টা দিন বাকি। তুমি যদি রোজ অফিস থেকে ফিরে একটা করে বিষয়ের পরীক্ষা নাও, তা হলে আমি বুঝতে পারি কোন বিষয়ে আমাকে আরও জোর দিতে হবে। ছেলের প্রস্তাবে বাবা রাজি হয়ে যান।

অফিস থেকে ফিরেই লিটনের বাবা ছেলের পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রতিটি বিষয়েই লিটন বেশ ভাল ফল করতে লাগল। বিশেষ করে অঙ্কে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন বিষয়ের দুর্বল জায়গাগুলো বাবার কাছে ভাল করে বুঝে নিল লিটন। পরীক্ষার ঠিক আগের দিন রাতে লিটন মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কাল থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু। আশি পারসেন্ট নম্বর নিয়ে ক্লাস নাইনে উঠতে পারব তো মা? কেন, আশি পারসেন্ট না পেলেই বা কী এসে যায়। মায়ের এই কথায় লিটন বলল, এমন কথা প্লিজ বলো না মা। আমার সব প্ল্যান তা হলে মাটি হয়ে যাবে। ছোটমামাকে কথা দিয়েছি। শুরু হল লিটনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। পরীক্ষার ক’দিন লিটনের মা লিটনকে হালকা খাবার দিলেন যাতে পরীক্ষার সময় ছেলের শরীরটা ঠিক থাকে। ছেলের পড়ার উত্‌সাহে রোজই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেন লিটনের বাবা। লিটনের বাবা অঙ্কের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অঙ্ক পরীক্ষার আগে তাকে অনেক বেশি তত্‌পর মনে হল। দিন পনেরো চলল পরীক্ষা। স্বাভাবিক ভাবে অন্য বারের চেয়ে পরীক্ষা অনেকটাই ভাল হল লিটনের।

এখন লিটনের সামনে অনেকটা ফাঁকা সময়। কিন্তু পড়ার অভ্যেস কিছুতেই ত্যাগ করতে পারছে না। ফেলুদা, শার্লক হোমস, হ্যারি পটার নিমেষের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। খেলাধুলো করে, টিভি দেখেও সময় যেন আর কাটতেই চায় না। এখনও রেজাল্ট বেরোতে প্রায় উনিশ-কুড়ি দিন বাকি। হঠাত্‌ লিটনের মনে পড়ে সুমনদার কথা। সুমন এ বার ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠবে। সময় নষ্ট না করে লিটন সোজা সুমনের বাড়ি গিয়ে ওর নাইনের অঙ্ক বইটা এনে বাবার হাতে দিয়ে বলে, বাবা তুমি আমায় ক্লাস নাইনের অঙ্ক শেখাও। রেজাল্টের আগে দেখা গেল, জ্যামিতি বাদে ক্লাস নাইনের সব অঙ্কই প্রায় শেষ।

ও দিকে দিন তিনেক আগে ছোটমামা লিটনের মাকে ফোন করে লিটনের রেজাল্ট কবে বেরোবে সেটা জেনে নিয়েছেন। তাতে লিটনের টেনশন দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। আশি পারসেন্ট না হলে এত চেষ্টা সব মাঠে মারা যাবে। কিন্তু ভেবে আর কী হবে? ঘুম থেকে উঠে দেখে মা পুজো দিয়ে ফিরলেন। লিটনের মাথায় ফুল ঠেকিয়ে বললেন, চিন্তা করিস না, রেজাল্ট ভালই হবে। তোর বাবা আজ রেজাল্ট আনতে তোর সঙ্গে স্কুলে যাবে।

লিটনের বাবা ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গেটের বাইরে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় গোমড়া মুখে রেজাল্ট হাতে স্কুল থেকে বেরিয়ে এল লিটন। লিটনকে ঘিরে বন্ধুদের উল্লাসের সঙ্গে লিটনের ম্লান মুখটাকে মেলাতে পারলেন না লিটনের বাবা। তাই কোনও কথা না বলে লিটনের হাত থেকে রেজাল্টটা নিয়ে খুলে দেখলেন। শতকরা ঊনআশি শতাংশ নম্বর পেয়ে লিটন পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। উল্লাসে ফেটে পড়লেন লিটনের বাবা। ছেলেকে সকলের সামনে আদর করে বললেন, কী হয়েছে তোর? মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতন করে আছিস কেন? চোখে জল ভরে আসে লিটনের। এত দিনের পরিশ্রম আমার সব জলে গেল বাবা। আশি পারসেন্ট হল না। ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাবা বললেন, তাতে কী হয়েছে? তুই থার্ড হয়েছিস। অঙ্কে একশোয় একশো। আর তুই কী চাস বল? আমি খুব খুশি হয়েছি।

লিটনের রেজাল্ট ঘিরে বাড়িতে মহাসমারোহ। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধব সবাইকে ফোনে, এস এম এস-এ জানানো হল রেজাল্টের খবর। কিন্তু ছেলে মনমরা হয়ে ঘরের এককোণে বসে গল্পের বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে। রিকশার হর্নের শব্দ শুনে নড়েচড়ে বসল লিটন। নিশ্চয়ই ছোটমামা এসেছেন। এবং ঠিক তাই, ছোটমামা আর ছোটমামি রিকশা থেকে নামলেন। সঙ্গে একটা লাল রঙের বাইসাইকেল। ছ্যাঁত্‌ করে উঠল লিটনের বুকটা। ছোটমামাকে কি ভুল খবর দিল মা? কথা ছিল আশি পারসেন্ট পেলে ছোটমামা সাইকেল কিনে দেবে। নিমেষের মধ্যে সাইকেলটা কাঁধে করে ঘরে ঢুকে একগাল হেসে শেক হ্যান্ড করার জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, কনগ্র্যাচুলেশন। এই নাও তোমার সাইকেল। সাইকেলটা পেয়ে মহাখুশি লিটন। সমস্ত খুশি ভেতরে চেপে রেখে ছোটমামার হাতে রেজাল্টটা দিয়ে বলল, আমি কিন্তু আশি পারসেন্ট পাইনি, ছোটমামা। ছোটমামা আদর করে বললেন, তুই যে চেষ্টাটা করেছিস সেটাই যথেষ্ট। চেষ্টার কোনও বিকল্প হয় না রে। অ্যানুয়াল পরীক্ষায় উনিশ পারসেন্ট নম্বর বাড়ানো মুখের কথা নয়। তোর এই রেজাল্টে আমি গর্বিত। এই চেষ্টাটা যেন চিরকাল থাকে। চেষ্টা থাকলে ফল আপনাআপনিই পাবি। ধরা গলায় লিটন বলল, আমি আবার চেষ্টা করব, ছোটমামা।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy