Advertisement
E-Paper

ডেকোরাম রেখে হনুমান তাড়ান

সাহেব একটা কথা ছিল।’ লেনিন গোপাল প্রায় ফিসফিস করেই বলল। শুনে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। সরকারি ব্যাংকে ‘মিডল ম্যানেজমেন্ট’ অবধি অফিসারদের নামের সঙ্গে ‘দা’ লাগিয়ে বলাটাই দস্তুর। ‘সাহেব’ ডাক মানেই মতলব আছে। ‘কী কথা?’ গলায় অল্প মধু লাগাই। ‘বুলেট কইছে, আমার পেটি পাওয়া আটকাবে।’

বিকাশ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫

সাহেব একটা কথা ছিল।’ লেনিন গোপাল প্রায় ফিসফিস করেই বলল। শুনে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। সরকারি ব্যাংকে ‘মিডল ম্যানেজমেন্ট’ অবধি অফিসারদের নামের সঙ্গে ‘দা’ লাগিয়ে বলাটাই দস্তুর। ‘সাহেব’ ডাক মানেই মতলব আছে।

‘কী কথা?’ গলায় অল্প মধু লাগাই।

‘বুলেট কইছে, আমার পেটি পাওয়া আটকাবে।’

বুলেট অর্থাৎ বুলেট গোপাল। অফিসে দুজন গোপাল। যে বুলেট মোটরসাইকেল চালিয়ে অফিসে আসে সে বুলেট গোপাল। আর এর মাথায় লেনিনের মতো টাক তাই লেনিন গোপাল। ব্যাংকে এ রকম নাম দেওয়া খুব প্রচলিত। তবে তা নিয়ে বলার আগে আমার পোস্ট সম্পর্কে একটু বলে নিই।

ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে ঢুকে আমি পাঁড় কেরানি হয়েছিলাম। বেশ কিছু কাল পর অফিসার হই। এই গল্পের সময়টা আমি ম্যানেজার ‘এ অ্যান্ড এস’, যার পুরোটা হল ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস’। বেশ সম্ভ্রম জাগানো উপাধি। আসলে কাজ হল বাথরুম পরিষ্কার রাখার বন্দোবস্ত থেকে, স্টাফ বনাম স্টাফ, স্টাফ বনাম কাস্টমার ঝগড়া সামলানো ছুঁয়ে প্রতি কাজের দিনের সন্ধ্যায় ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে আর অডিটর এলে তাঁদের তৈল মর্দন করা। হায়ার ম্যানেজমেন্টের কেউ এলেও হেঁ হেঁ, অ্যাসোসিয়েশনের কেষ্টবিষ্টু কেউ এলেও হেঁ হে।ঁ সবচেয়ে অসুবিধার জায়গা হল স্টাফ আর কাস্টমারের ঝগড়া সামলানো। এমন দ্ব্যর্থব্যঞ্জক ভাষায় কথা বলতে হবে যে স্বয়ং কবি ভারতচন্দ্রও হেরে যাবেন।

নাম দেওয়ার কথা হচ্ছিল। আমাদের কলকাতা উত্তরের এক শাখায় চার জন গৌতম ছিল। তাই চেনাচিনির সুবিধের জন্য, আর্মড গার্ড হল ‘বন্দুক গৌতম’, ব্যাংকের টিমে ক্রিকেট খেলত বলে এক জন ‘ক্রিকেট গৌতম’, যে ক্লিয়ারিং দেখত সে ‘ক্লিয়ারিং গৌতম’ আর চতুর্থ জন ‘ফাদার গৌতম’। তার নাম ছিল আশিস, সকলে ‘লগা’ বলে ডাকত, আমার কাছে তাই নিয়ে নালিশ করায় আমি তার নাম দিয়েছিলাম ফাদার গৌতম, কারণ তার ছেলের নাম গৌতম। একটি ব্রাঞ্চে দুজন দীপকের এক জন বিহারে কাজ করার সময় গুলি খেয়েছিল, তাই তার নাম হল ‘গুলি দীপক’, আর অন্য জন সব সময় পলিথিন ব্যাগ নিয়ে অফিসে আসত, তাই সে ছিল ‘পলিথিন দীপক’।

যা হোক, লেনিন গোপালকে বললাম, আমি দেখছি। প্রথমে ভেবেছিলাম, অন্য একটা ব্রাঞ্চে আমার দেওয়া প্রেসক্রিপশন এখানেও দেব। সেটা হল, শ্যামল নামে এক জন স্টাফ প্রায়ই সুখেন বলে এক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করত। ‘ও আমার পেছনে লাগে, কাগজ পাকিয়ে ছোড়ে, ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে।’ একেবারে স্কুলের ছেলেদের মতো। আমি ওকে বলেছিলাম, ‘সুখেন যখন বাথরুমে যাবে, আপনিও ওর পেছন পেছন যাবেন। সেখানে কেউ না থাকলে হয় ওর পেটে ঘুসি মারবেন, না হলে ও যখন জলবিয়োগ করবে, দেবেন এক ধাক্কা! কিছু হলে আমি দেখে নেব।’ শ্যামল বিরস মুখে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু লেনিন গোপালকে সে উপদেশ দিলে সে সত্যি সত্যি মেরে দিয়ে এসে বলবে ‘সাহেব, দিসি একখান।’ আর অন্যদের বলবে ‘সাহেব বলেসে তাই করসি।’

বুলেট বলেছিল, লেনিনের পেটি পাওয়া আটকাবে। ব্যাংকে ‘পেটি’ একটা চালু ব্যাপার। মানে কোথাও ব্যাংকের কাজে যাওয়ার জন্য নগদ টাকা। মূলত সাব-স্টাফরাই ‘পেটি’র হকদার। এমনও দেখা যায়, ছ’তলা বাড়ির এক তলায় ব্রাঞ্চ, সেখান থেকে ওপরের কোনও তলায় গিয়ে মিনিবাসের ভাড়া নিচ্ছে। শ্যামল-সুখেনদের ব্রাঞ্চে প্রথম দিন গেলে পীযূষদা যখন আমায় সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন, এক জন গোবেচারা সাব-স্টাফকে দেখিয়ে বললেন, এ হল পেটি মধু, একে একটু দেখো। যা বলবে সব করে দেবে, শুধু ওই পেটিটা একটু...

‘এ অ্যান্ড এস’ হলে সাব-স্টাফদের একটু শাঁসে-জলে রাখতে হয়, তারাও ভয়-ভক্তি করে। কখনও আবার অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। এক ব্রাঞ্চে এক দিন ঢুকে দেখি বেশ খানিকটা জায়গা জল থইথই। লেডিস টয়লেট থেকে জল বাইরে আসছিল। সাফাই কর্মচারী দাঁড়িয়ে ছিল, আমাকে দেখেই বলল, দেখুন সাহেব, ‘কী সব ফেলসে কমোডের ভেতর।’ দু’তিন দিন আগে আমাকে দুজন ভদ্রমহিলা স্টাফ নতুন-আসা আর এক মহিলা সম্পর্কে বলেছিলেন যে তিনি উলটোপালটা জিনিসপত্র ফেলে কক্ষনও ঠিকমত ফ্লাশ করেন না। আমার যথাবিধি উত্তর ছিল, দেখছি। তার পর এই অবস্থা। ‘কী হচ্ছে কী? বিকাশদা কি দেখবেন?’ এক জন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসেছিলেন। আমি মিনমিন করে বলেছিলাম, সাফাইয়ের লোকটাকে বলুন, পেটি হয়ে যাবে।

আমার ওপর এ অত্যাচারের শোধ তুলেছিলাম ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে। বাংলাদেশ থেকে বারো কিলোমিটার দূরে সে ব্রাঞ্চে এক দিন ভরদুপুরে হনুমান ঢুকে পড়েছিল। তাকে দেখে সেখানকার ‘এ অ্যান্ড এস’ চেয়ার ছেড়ে ক্যাশের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়েছিলেন। সব্বার চেঁচামেচিতে হনুমান বার দুই দাঁত খিঁচিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। তার পর আমি ‘এ অ্যান্ড এস’কে ডেকে বলি, ‘আপনি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দায়িত্বে, কোথায় হনুমান আপনি নিজে তাড়াবেন, তা না ক্যাশের ভেতর চলে গেলেন!’ ভদ্রলোক তুতলে বললেন, ‘আ... আমি কী করব?’ ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ডেকোরাম বজায় রেখে চেঁচাবেন’, আমার উত্তর।

তবে এমনিতে ব্যাংক কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কিন্তু খুব সুন্দর। কারও বাড়ির বিপদে তো বটেই, ক্যাশে কাজ করে কেউ বেশি টাকা পেমেন্ট করে ফেললে, সকলে দৌড়োদৌড়ি তো করেনই, নিজেরা চাঁদা করে সেই টাকা দেন। আমার কেরানি থাকার সময় এক বার আর এক জনের সঙ্গে ‘ডাবল হ্যান্ড পেমেন্ট’ করে দু’হাজার টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম। অনেক স্টাফ আর রিক্রিয়েশন ক্লাবের ফান্ড তার অনেকটাই শেয়ার করেছিল।

তখন আমি ৪৪৩.২০ পয়সায় ঢুকে ৬১২.৬০ পয়সা মাইনে পাই। আর লোকে বলত, ঠিকই বলত, ব্যাংকের চাকরি রাজার চাকরি।

mallikabikash@yahoo.co.in

rabibasariya anandabazar bikash mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy