Advertisement
E-Paper

তাঁর বিষাদ লোককে টানত

কো চবিহার কোনও দিনই তেমন রমরমা শহর ছিল না। কিন্তু একটা করদ রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ছিল খুবই পরিচ্ছন্ন, পরিকল্পিত, সুন্দর, ছবির মতো শহর। অনেকগুলো দিঘি ছিল, পামগাছের সারি ছিল, আর হাসপাতাল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ বা হোস্টেলের চমৎকার স্থাপত্য, শহরে পা দিলেই চার দিকটা দেখে স্বতঃস্ফূর্ত মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটত মানুষের, ‘বাহ্!’ হ্যাঁ, তখনকার কোচবিহার, অর্থাৎ স্বাধীনতার কয়েক বছর পর, উদ্বাস্তু-আগমন সত্ত্বেও ছিল একটি অন্য রকম শহর।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

কো চবিহার কোনও দিনই তেমন রমরমা শহর ছিল না। কিন্তু একটা করদ রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ছিল খুবই পরিচ্ছন্ন, পরিকল্পিত, সুন্দর, ছবির মতো শহর। অনেকগুলো দিঘি ছিল, পামগাছের সারি ছিল, আর হাসপাতাল থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ বা হোস্টেলের চমৎকার স্থাপত্য, শহরে পা দিলেই চার দিকটা দেখে স্বতঃস্ফূর্ত মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটত মানুষের, ‘বাহ্!’ হ্যাঁ, তখনকার কোচবিহার, অর্থাৎ স্বাধীনতার কয়েক বছর পর, উদ্বাস্তু-আগমন সত্ত্বেও ছিল একটি অন্য রকম শহর। সব রাস্তা সোজা ও সটান, রাস্তার ধারে সযত্নে লাগানো মহার্ঘ গাছ, পার্ক, মন্দির। নিয়মিত ঝাঁটপাট এবং পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা চালু ছিল তখনও। আর রাস্তার ধারে ধারে গজিয়ে ওঠা দোকানপাটও ছিল না।
বাবার বদলির চাকরির দরুন লেখাপড়া মার খাচ্ছিল বলে ১৯৫১ সাল নাগাদ আমাকে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে ক্লাস টেন-এ ভর্তি করে দেওয়া হয়। আস্তানা স্কুলের হোস্টেল। আমাদের দৈনন্দিন জিনিসপত্র কিনতে যেতে হত বাজারে। ছোট বাজার, দোকানপাট খুব বেশি নয়। সাবান, টুথপেস্ট বা ব্রাশ, তেল, দিস্তা কাগজ, পেনের কালি, এ সব কিনতে বাজারেই যেতে হত। তখন অনেকেরই নস্যির নেশা ছিল। বাজারে একটা ছোট স্টেশনারি দোকান ছিল। এক জন রোগা, বিষণ্ণ চেহারার শান্ত যুবক দোকান চালাতেন। সবাই বলত বুড়োদা। বুড়োদার বিশিষ্টতা ছিল এটুকুই যে, খুব কম কথার মানুষ, লাজুক, নির্বিরোধী এবং বোধহয় একটু ভিতু টাইপেরও। অন্য সব দোকান ছেড়ে সব ছেলেই ওই বুড়োদার দোকানেই কেন হানা দিতাম, তা কে জানে! তবে লোকটির একটা অদ্ভুত শান্ত, অপ্রতিরোধী আকর্ষণ ছিল। কিন্তু সেটা কেন, তা আজও ভেবে পাই না। তিনি যে আমাদের সঙ্গে খুব একটা গল্প-টল্প করতেন, এমনও নয়। তবে গিয়ে দাঁড়ালে একটু হাসির আভা ফুটত মুখে, কোনও জিনিস কিনে তা ফেরত দিতে গেলে বিনা প্রশ্নে, অখুশি না হয়ে ফেরত নিয়ে পয়সা দিয়ে দিতেন। কোনও খদ্দেরের সঙ্গে কোনও দিন তাঁর কোনও বাগ্‌বিতণ্ডা হয়নি।
অনেক সময় জলখাবার খেতে মাখন-পাউরুটি কিনে আনতাম। তখন দিশি মাখন পাওয়া যেত না। মাখন আসত অস্ট্রেলিয়া থেকে, কৌটোজাত হয়ে। তাতে তৈরির তারিখ বা এক্সপায়ারি ডেট লেখার বালাই ছিল না। জাহাজে করে আসা মাখনের কৌটো খুলে কখনও কটু গন্ধ পেয়ে সেই কৌটোই বুড়োদাকে ফেরত দিতে নিয়ে গেছি। বুড়োদা বিনা প্রশ্নে ফেরত নিয়েছেন, তাতে তাঁর কত গচ্চা গেছে তা-ও আমাদের বলতেন না কখনও।

অন্য সব দোকানে দু’পয়সার নস্যি কিনলে একটুখানি দিত। বুড়োদা অনেকটা দিতেন, কৌটো ভরে যেত। তার মানে এই নয় যে, উনি নিজের ক্ষতি করে আমাদের মন রাখতেন। দোকানের বিক্রি এতটাই বেশি ছিল যে, অন্য সব দোকানদার তাঁকে রীতিমত হিংসে করত। ধীরে ধীরে দোকানের যে বেশ উন্নতি হচ্ছিল, তা আমরা বেশ বুঝতে পারতাম। আর শুধু ছাত্ররাই তো নয়, তাঁর খদ্দের ছিল সারা শহরেই।

যত দূর মনে আছে, দোকানটার নাম ছিল মনোহারি বিপণি। দোকানের উন্নতি হল বটে, কিন্তু বুড়োদার মুখের বিষণ্ণতাটি গেল না। তাঁর স্নিগ্ধ চোখ দুটিতেও এক গভীর বিষাদ দেখতে পেতাম। মুখের হাসিটিতেও তার ছোঁয়া ছিল। অনেক ভেবেছি, বুড়োদার প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণের কারণ কি ওই বিষাদ? হবে হয়তো। না হলে আর কী-ই বা হতে পারে? যাঁর প্রগল্ভতা নেই, স্মার্টনেস বা আদিখ্যেতা নেই, পাকা দোকানদারের পেশাদারিত্ব নেই, তিনি এত জনপ্রিয় হন কী ভাবে?

কোচবিহারে স্কুল-কলেজ মিলিয়ে আমি বছর চারেক ছিলাম। ওই চার বছর আমি এবং আমরা সবাই বুড়োদার দোকান ছাড়া অন্য কোনও দোকান থেকে কিছু কিনতে যেতাম না। শেষে এমন দাঁড়াল যে, দোকানে সন্ধেবেলা রীতিমত লাইন পড়ে যেত।

জীবনে আমি নানা জায়গায় নানা দোকানদার দেখেছি। কিন্তু বুড়োদার কথা এত দিন পরেও এত স্পষ্ট করে কেন মনে পড়ে, ভেবে পাই না। কয়েক হাজার দোকানদারের ক’জনকেই বা স্মরণে রাখা যায়?

এক শীতের সন্ধেবেলা কী একটা কিনতে বুড়োদার দোকানে গেছি। কোচবিহারের কনকনে শীতে সেই সন্ধেবেলা বুড়োদার দোকানে আর কোনও খদ্দের ছিল না। বুড়োদা বোধহয় বই-টই কিছু একটা পড়ছিলেন। আমাকে দেখে একটু হাসলেন। এ কথা-সে কথার পর আমি বললাম, ‘বুড়োদা, আপনি কেন আর একটু বড় দোকান করছেন না? এইটুকু একরত্তি দোকানে এত ভিড় সামলান কী করে?’ হাসিমুখেই বুড়োদা বললেন, ‘দোকান তো আমার নয় ভাই।’ আমি হাঁ, ‘আপনার নয়?’ ‘না তো, আমি তো কর্মচারী। সামান্য বেতন পাই।’ আমি প্রায় আঁতকে উঠে বললাম, ‘সে কী? তবে কার দোকান?’ ‘তিনি অন্য জায়গায় থাকেন।’ হতাশায় মনটা ভরে গেল। চোখে প্রায় জল। কত কাল আগে কোচবিহার ছেড়েছি। জানি না, বুড়োদার নিজের দোকান কখনও হয়েছিল কি না।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy