Advertisement
E-Paper

নতুন ভুবন

স্বামী শিবপ্রদানন্দবাতাসে শীতের স্পর্শ নেই। সরস্বতী পুজো হয়ে গেছে। স্কুলের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে পলাশ গাছের সারি। ডালে ডালে এসেছে অজস্র লাল ফুল। যেন পলাশ গাছের সারিতে আগুন লেগেছে। টিফিনের পরের পিরিয়ড ছিল ইতিহাসের ক্লাস। রত্নাদি এইট-বি সেকশনে রাজা অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের কথা আলোচনা করছিলেন। যুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণতি অশোকের মনোজগতে পরিবর্তন এনেছিল। হিংসা ত্যাগ করে অশোক অহিংসা পথ অবলম্বন করেছিলেন।

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩

বাতাসে শীতের স্পর্শ নেই। সরস্বতী পুজো হয়ে গেছে। স্কুলের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে পলাশ গাছের সারি। ডালে ডালে এসেছে অজস্র লাল ফুল। যেন পলাশ গাছের সারিতে আগুন লেগেছে। টিফিনের পরের পিরিয়ড ছিল ইতিহাসের ক্লাস। রত্নাদি এইট-বি সেকশনে রাজা অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের কথা আলোচনা করছিলেন। যুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণতি অশোকের মনোজগতে পরিবর্তন এনেছিল। হিংসা ত্যাগ করে অশোক অহিংসা পথ অবলম্বন করেছিলেন। অন্যান্য ছাত্রীদের সঙ্গে অলি মন দিয়ে ক্লাস শুনছিল। তবে টিফিনের সময় খিচুড়ি খেয়ে একটু ঝিমুনি আসছিল। হঠাৎ ঘণ্টার আওয়াজ শুনে অলির ঝিমুনিটা কেটে গেল। ক্লাস শেষে রত্নাদি শ্রেণিকক্ষ থেকে বাইরে যেতেই আবার যথারীতি গোলমাল শুরু হল। দীপিকা একটু বেশি কথা বলে। তার সঙ্গে আড্ডায় যোগ দেয় বীথি, শর্মিলা, দেবী এবং সুফিয়া।

দীপিকা বলল, ‘দোলের এক দিন আগে স্কুলে স্পোর্টস হবে গেম টিচার বিজয়াদি বলেছেন। আগামিকাল বড়দি নোটিস দেবেন।’ দেবী আর শর্মিলা প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, ‘স্পোর্টসে নাম দেব না। ভাল করে হাঁটতে পারি না, তার পর আবার দৌড়াদৌড়ি করা। ও সবে নেই।’ দীপিকা অলিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী রে, তুই নাম দিবি না?’ অলি সরাসরি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই নাম দিবি কি?’ ‘হ্যাঁ দেব তো’, দীপিকা উত্তর করল। সুফিয়া বলল, ‘ইভেন্ট খুব বেশি নেই। সব মিলিয়ে তিনটে। তবে একশো মিটার দৌড়ে নাম দেব ভাবছি।’ কথাটা বলে সুফিয়া বীথির দিকে তাকাল। বীথির সংক্ষেপ উত্তর, ‘আমিও’। দীপিকা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে অলিকে একটু খোঁচা দিয়ে বলে উঠল, ‘অলি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেয়নি। হয়তো বাড়িতে আলোচনা করে আগামিকাল সিদ্ধান্ত নেবে।’ ক্লাসের বন্ধুরা হেসে উঠল। এমন সময় নন্দিতাদি ক্লাসে প্রবেশ করলেন। অঙ্কের ক্লাস। জ্যামিতির উপপাদ্য নিয়ে মেতে উঠল সবাই। অলি শুধু অন্যমনস্ক। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। করমগাছের ডালে ফিঙে পাখিটা লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা ধরে খাচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে ইতিউতি দেখছে। চঞ্চল ফিঙে পাখিটাকে একমনে দেখছে অলি। নন্দিতাদি তা দেখে পড়ানো থামিয়ে বলে উঠলেন, ‘অলি, জানলা দিয়ে বাইরে না তাকিয়ে বোর্ডের দিকে তাকাও।’ অলি বেশ লজ্জা পেল। জ্যামিতির পাঠে মন দিল সে। ক্লাস যথাসময় শেষ হল। লাস্ট ক্লাসে বিজয়াদি এলেন। স্কুলের স্পোর্টসে ছাত্রীদের নাম দিতে বললেন। অনেকেই নাম দিল। এমনকী মুখচোরা ছাত্রী অলিও।

নিভাননীদেবী বালিকা বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়াপ্রতিযোগিতার আয়োজন পুরোদমে চলছে। তবে ওই বালিকা বিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রী শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী। সক্ষম ছাত্রীদের সংখ্যা তুলনায় অনেক বেশি। তাদের প্রতিযোগিতার বিভাগও আলাদা, যদিও সেই প্রতিযোগিতা একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়। শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হলেও সেই ছাত্রীদের উৎসাহে খামতি নেই। সেই দিনটিকে কেন্দ্র করে সবার আগ্রহ যেন উথলে উঠছে।

রঙিন কাগজে সারা মাঠ সেজে উঠেছে। মৃদু বাতাসে উড়ছে রঙিন কাগজের সারি। মনে হচ্ছে, কয়েক হাজার রং-বেরঙের পাখি ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে অসীমে। নীল আকাশ তাদের ডাকছে। মাঠে পড়েছে সাদা চুনের দাগ। চুনের দাগের রকমফের আছে। লম্বা, গোল, ডিম্বাকৃতি। চুনের দাগের মধ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন। তার বাইরে অনেকটা ফাঁকা জমি। সেই ফাঁকা জমিটা চারিয়ে গেছে একটু উঁচুতে। মাথার উপরে, নীল আকাশে। অলি, বীথি এই সব খুঁটিয়ে দেখছিল। আর তাদের মনের ভিতরে ভিড় করে আসছিল হাজারও চিন্তা। মাঠের সীমানা নির্ধারণের জন্য পুঁতে রাখা হয়েছে পতাকার দণ্ড। সেই এক একটি দণ্ডের মাথায় উড়ছে নানা রঙের পাতাকা। লাল, সবুজ, গেরুয়া, নীল, হলুদ রঙের উড়ন্ত পতাকায় ঝলমল করছে স্কুলের মাঠ। স্পোর্টসের আগের দিন আজ। তাই আয়োজন সম্পূর্ণ করতেই হবে। আমন্ত্রিত অতিথি, অভিভাবকদের জন্য শামিয়ানা টাঙিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্লাসরুমের বেশ কয়েকটা টেবিল, বেঞ্চ শামিয়ানার নীচে সাজানো হয়েছে। টেবিলে সাদা চাদর বিছিয়ে রাখা হবে হরেক রকম প্রাইজ। ছাত্রীর দল হইহই করে সব কাজ করছে। শিক্ষিকারাও তাদের সঙ্গে আছেন। তবে গেম টিচার বিজয়াদির ব্যস্ততা তুঙ্গে। তাঁর নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত নেই।

অলির মাথার চুলে কে যেন পিছন থেকে টান দিল। অলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, দীপিকা মিটিমিটি হাসছে। দীপিকা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী রে! বাড়ি যাবি না? ছুটির ঘণ্টা কখন পড়ে গেছে!’ অলি আর বীথি এতটাই আনমনা ছিল যে তা শুনতে পায়নি। বীথি বলল, ‘ওমা তাই নাকি! এই দেখেছিস অলি, আমরা দু’জনেই শুনতে পাইনি।’ দীপিকা ফোড়ন কাটল, ‘এ বার স্পোর্টসে তোদের দু’জনকে ভাবুকতার জন্য যুগ্ম-পুরস্কার দেওয়া হবে।’ বীথি আর অলি মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল। দীপিকা নিজে কিছুটা বেসামাল হলেও ওদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। ওরা বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে স্কুলের গেট পার হয়ে সাবধানে রাস্তায় নামল। স্কুলের শিক্ষাকর্মী শ্যামলীদি ততক্ষণে বড়দির আর স্কুলের অফিসঘরে তালা লাগিয়ে ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন। প্রায় তখনই একটা অটোরিকশা ওদের পাশে এসে দাঁড়াল। চালক ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লাহাবাজার, খালি গাড়ি।’ সময় নষ্ট না করে তিন জন ছাত্রীকে গাড়িতে তুলে দিয়ে শ্যামলীদি বললেন, ‘তোরা এটাতে চলে যা।’ আমার এখন যাওয়া হবে না। বড়দির বাড়িতে এই ফাইলটা পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরব।’ লাহাবাজার বেশি দূরে নয়। ন’দশ মিনিটের পথ। গাড়িতে উঠে দীপিকা যথারীতি বকবক শুরু করল। অলি আলোচনায় তেমন যোগ দিল না। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা। স্কুলের স্পোর্টসে একশো মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় সে এক জন প্রতিযোগী।

আজ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। ক্লাসের রোলকল হয়ে যাওয়ার পর ছাত্রীরা মাঠে চলল। আজ ছাত্রীদের সংখ্যা অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। স্কুলের বড়দি সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। তা ছাড়া সব ছাত্রীর জন্য আজ আকর্ষণীয় টিফিন প্যাকেট আছে। স্থানীয় বিধায়ক ক্রীড়াপ্রতিযোগিতার সূচনা করে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। স্কুলের মাঠের মাইকে সুচিত্রা মিত্রের গলায় গান বাজছে ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল।’ গোটা মাঠ জুড়ে শুধু কলকল আওয়াজ। হাসির বন্যা। খুশির তুফান। আজ স্কুলে এসেও পড়া নেই। এমন আনন্দের দিন খুব একটা পাওয়া যায় না।

একটার পর একটা ইভেন্ট ঘোষণা হতে থাকল। সে সব শেষ হতেই, অবশেষে এল সেই বিশেষ প্রতিযোগিতা। বিজয়াদি নাম ডাকছেন। অলি শুনতে পেল বিজয়াদি মাইকে ঘোষণা করছেন শর্মিলা, দেবী, সুফিয়া, দীপিকা, জয়া, অলি... তোমরা একশো মিটার দৌড়ের জন্য প্রস্তুত হও। দুরুদুরু বুকে অন্যদের সঙ্গে অলি দৌড় শুরুর জায়গায় দাঁড়াল। বিজয়াদি দৌড় শুরু করার নির্দেশ দিলেন। অলির মনে হল সামনের দিকে লম্বা লম্বা চুনের দাগ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অজানা পথে টলমলে পা রাখল অলি। হেঁটে চলাই তার পক্ষে কষ্টকর। তার পর আবার দৌড় প্রতিযোগিতা! অন্য প্রতিযোগীদেরও একই অবস্থা। তবু মাঠের বাইরে অন্য বন্ধুরা তালি দিয়ে উৎসাহিত করছে। কিন্তু না। অলির পক্ষে সম্ভব হল না। ছুটতে গিয়ে সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। শরীরে তেমন আঘাত লাগেনি। তবে ব্যথা লাগল মনে। বিষাদের অশ্রু যেন তাকে ছাপিয়ে গেল। অন্য বন্ধুরা যারা এগিয়ে যাচ্ছিল তারা সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেউ অলিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল না। মাঠের সমস্ত দর্শক স্তব্ধ হয়ে দেখছে এক অদ্ভুত দৃশ্য। দীপিকা, দেবী, শর্মিলা, সুফিয়া, জয়া... সবাই ফিরে এসে অলিকে ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। তার পর আবার দৌড় শুরু হল। স্তব্ধ মাঠ তালি দিতে ভুলে গিয়েছে। সবার চোখে জল। প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান তুচ্ছ হয়ে গেল। সহযোগিতা নামের প্রতিযোগী তখন সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে। অলিরা চলেছে। বাধা সরিয়ে চলেছে। তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে নতুন ভুবন।

পশ্চিম আকাশে মেঘের আড়ালে সূর্য তার ছড়ানো লাল আবিরে সমস্ত আকাশকে রাঙিয়ে দিয়েছে। যেন মাঠময় ছড়িয়ে যাচ্ছে আশ্চর্য এক দোলা। মাঠের মাইকে তখন খেলা করছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠতরঙ্গ। বাজছে, ‘ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে। অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে...।’

ছবি: সুমন চৌধুরী।

rabibasariyo anandamela swami shibapradananda
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy