পাড়া-প্রতিবেশী
কাজের মাসি ফুলকিদি। আমাদের পাড়ার শেষে হরিজন পল্লি, সেখানেই তার ছোট্ট ঘর। যে দিন বড়দা দামি পেন্ট নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন, ফুলকিদিকে দেখি ফেরিওয়ালার কাছ থেকে গুঁড়ো রং আর আলপনা আঁকার চিনেকাগজ কিনছে। ছোট্ট ঘরের বারান্দাকে এটাই তার পুজো উপহার!
প্রতিবন্ধী ভিখিরি মাস্তানকে কয়েন না দিয়ে কখনও কাজে যাই না। সে দিন পথে দেখতে পেলাম না! মনটা খচখচ করছিল। এগিয়ে দেখি, ঝালাইয়ের দোকানে মাস্তান বসে। ‘কী রে? এখানে?’ ‘আর বলবেন না! থালাটা একেবারেই চলছিল না। তাই ফুটোগুলো একটু ঝালিয়ে নিচ্ছি। সামনে পুজো না!’
প্রজাপতি
বাংলার শিক্ষক শ্রীধরবাবু প্রকৃতিপ্রেমী। বাগানে প্রজাপতির সংখ্যা যাতে না কমে, কখনও শুঁয়োপোকা মারার জন্য গাছের গোড়ায় আগুন ধরাতে দিতেন না। এই নিয়ে ফি-বছর পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাগানে সত্যিই অনেক প্রজাপতি উড়ত। আজ সেই জন্যই হয়েছে বিপদ! তাঁর আট বছরের মেয়ে তিন্নি বলে কিনা, বাগানে একটা প্রজাপতি দেখেছে; তার ডানার রঙের মতো ফ্রক চাই! বিকেলে দেখি, বাগানে খোঁজ চলছে ফেরার প্রজাপতির। সামনে সামনে তিন্নি, আর অনিতা ম্যাডাম, মানে ওর মা, মোবাইলের ক্যামেরা অন করে পিছু পিছু! প্রজাপতিটাকে পেতেই হবে!
প্রেম
বেণী গত পুজোয় হেব্বি গাঁজা খেয়েছিল। প্যান্ডালের পিছনে খুব হট্টগোলও করেছিল। খবরটা তনিমার কানে গেছে এবং বেণী সম্পর্কে তার ধারণা কোন তলানিতে ঠেকেছে, না বলাই ভাল। বেণী আবার মনে মনে তনিমাতেই অনার্স! তাই সে ভদ্র হওয়ার জন্য সেই যে প্রতিজ্ঞা করল, তার পর এ বছর লিয়ো ক্লাবের সদস্য হয়েছে। এ বার পঞ্চমীর বিকেলে ‘নেশামুক্ত পৃথিবী’ ক্লাবের একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল। কিন্তু সন্ধের খবর, বেণী বামাল গ্রেপ্তার! দু’কিলো ভাং পাতা সুদ্ধ! আসল ব্যাপারটা অন্য। মার্কেটের সমস্ত বেনে-দোকান থেকে বেণী ‘ওই সব’ সংগ্রহ করে ক্লাবের মাঠেই নিয়ে যাচ্ছিল; ‘প্রতীকী’ হিসেবে পোড়ানোর জন্য। পথে ক’জন হাবিলদারের পাল্লায় পড়ে এই হাল! যা হোক, কয়েক ঘণ্টার কারাবরণের খবরে এক জন কিশোরীর চোখের কোণে দু’ফোঁটা জল ঝিলিক দিয়েছিল— এটাই সুখবর!
পাগল
রোজ সকালের আগেই ভরা জবাগাছ লুট হয়ে যেত! এক দিন ঠাম্মা চোরকে হাতেনাতে পাকড়াও করলেন। আর কেউ নয়, পাগলা মাপা! ঠাম্মা বকেঝকে সে বারের মতো মাপ করে বললেন, ‘ফুল নিবি, নে! তবে কিছুটা গাছে রেখে। আর তোলা ফুলের অর্ধেক আমাকে দিয়ে যাবি।’ এই নিয়মটাই বেশ কিছু দিন ধরে চলছিল। সে দিন মহাষষ্ঠী। সকালের দিকে আবার ঠাম্মার চিৎকার, ‘ফের তুই সব ফুল তুলে নিয়েছিস!’ দৌড়ে গেলাম। দেখি, গাছের ডালে মাপা! তার এক হাতে সাজি ভরা জবাফুল, অন্য হাতে সুতো! বলল, ‘আজ্ঞে কত্তা, আমি আসার আগেই কেউ গাছটা ফাঁকা করে গেছে! জানি ঠাকুমা আমাকে ধরবেন। তাই অন্য জায়গা থেকে আনা ফুলগুলো সুতো দিয়ে আবার ডালে বেঁধে দিচ্ছি!’
পুষ্পাঞ্জলি
পাঁচু ক্লাবের বৈঠকে বলেই ফেলল, ‘এ বার পুষ্পাঞ্জলিতে মোবাইল নিষিদ্ধ করে দেওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা করা উচিত!’ সম্পাদক মাথা নাড়লেন, ‘ঠিকই বলেছ! হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলে পুরুতমশাইয়ের মন্ত্রপাঠে ব্যাঘাত হতে পারে।’ পাঁচু বলল, ‘না না দাদা! সে কথা বলছি না! গেল বিশ্বকর্মা পুজোয় আমাদের বাড়িতে পুষ্পাঞ্জলির সময় পাশের বাড়ির অর্পিতা ফুলের সঙ্গে হাতের ভারী মোবাইলটাও ঠাকুরের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল! ডান হাতে ভয়ানক চোট পেয়েছিলেন বিশ্বকর্মা!’
পড়াশোনা
ছোটবেলায় হরিপদ মাস্টারের কাছে হ্যারিকেন নিয়ে সন্ধের দিকে পড়তে যেতাম। পুজোর মুখেই এক দিনের কথা! জানলার পাশে বসা ঘেঁটু ধড়াম করে জানলা বন্ধ করে আউমাউ করে সরে এল! বলল, ‘বাইরে মহিষাসুর!’ আমরা ভড়কে গেলাম! স্যর নিজেই গিয়ে জানলা খুললেন। গোঁ গোঁ গোঁ... ধপাস! আমরা চেঁচিয়ে পাড়া মাত করলাম। আশপাশ থেকে টর্চ হাতে অনেকে দৌড়ে এল। জানলার ও-পারে মহিষাসুর না হলেও একটা রাক্ষস বইকী! তবে সেটা একটা মাটির মূর্তি! রিকশার ওপর রাখা। টায়ার পাংচার হওয়ায় রিকশাওয়ালা ওখানে সাইড করে রেখে দিয়েছে! মূর্তিটা নাকি পাশের পাড়ার অরুণাগ্নি ক্লাবের মঞ্চ সাজাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
পুলিশ
বড়দি আর জামাইবাবু আমাদের পুজোর কেনাকাটা কলকাতা থেকেই করে আনেন। সবাইকে হাতে হাতে দিতেই বাড়িটা যেন হাসিখুশির মেলা! নিতাইকাকু শুধু ছলছল! মা জিজ্ঞেস করলেন, ঠাকুরপো? তোমার কি পছন্দ হয়নি? নিতাইকাকু বললেন, ‘গত ক’বছর ধরেই তো কত নতুন জিনিস পাচ্ছি। কিন্তু পুজোর ষোলো ঘণ্টার লম্বা ডিউটি! পরব কখন?’ থানার মেজো দারোগা নিতাইকাকু। এ পুলিশ-জন্মে তাঁর কোন পুজোয় যে নতুন জামা পরা হবে!
প্রতিমা
আমাদের শহরে সবসুদ্ধ ২৯টা দুর্গাপুজো হয়। ছোটবেলায় স্কুল খুললে বন্ধুরা সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘ক’টা ঠাকুর দেখলি?’ ২৯টার বেশি হতে পারে না জানলেও কেউ বলত ৩০, কেউ ৩২! আমিও বলতাম। দশ বছর ধরে ৩০টা বলে এসেছি। এখন হিসেবটা আমার আট বছরের ছেলে বাবুসোনাই করে। সেও বলে ৩০টা! আসলে সে তার মা’কে খুব ভালবাসে।
পরাক্রম
পুলকদার টিকিধারী বাচ্চাটা ভীষণ দুষ্টু এবং খ্যাপা! লম্বা লম্বা চুল দুলিয়ে তার মাস্তানিতে বাড়ির সবাই কাত! এ বারে ঠিক হয়েছে এ পুজোতেই ওর চুলগুলো মা দুর্গার কাছে মানত দেওয়া হবে। ওদের বাড়িতে ঠাকুর গড়তে মিস্ত্রিদের ভিড়। কারও মোবাইলে আবার মহালয়া বাজছে! এমন সময় টিকিধারীর জোর কান্নার আওয়াজ! মা জানলা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল রে পুলক?’ পুলকদা বললেন, ‘বাধ্য হয়ে হালকা উত্তম মধ্যম দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষণ আগে ওর দাদার খেলনা পাইপগান হাতিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে ঢুকেছিল। সেখানে মহিষাসুরকে লক্ষ্য করে তিন-তিনটে গুলি চালিয়েছে। অসুররাজের দুটো আঙুল উড়ে গেছে! মিস্ত্রিরা ভীষণ বিরক্ত!
srisomnathpradhan@gmail.com