Advertisement
E-Paper

পা ন্তা ভা তে...

সাদা ধুতি আর শার্ট পরা একটা ভীষণ লম্বা লোক মার্সিডিজ চালিয়ে বম্বে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ষাটের দশকে এমন কলার-তোলা বাঙালি দেখা যেত না। পয়সাওয়ালা বাঙালিও খুব দেখিনি তখন। তিনি গান গাইতেন, সুরকার ছিলেন আর সিনেমা প্রোডিউস করতেন। লোকটা হেমন্তদা, হেমন্তকুমার, আপনাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ, যখন হিন্দি ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে ‘গঙ্গা আয়ে কহাঁ সে’ গানটি গাইতে এলেন।

গুলজার

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০০:১৫

সাদা ধুতি আর শার্ট পরা একটা ভীষণ লম্বা লোক মার্সিডিজ চালিয়ে বম্বে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ষাটের দশকে এমন কলার-তোলা বাঙালি দেখা যেত না। পয়সাওয়ালা বাঙালিও খুব দেখিনি তখন। তিনি গান গাইতেন, সুরকার ছিলেন আর সিনেমা প্রোডিউস করতেন। লোকটা হেমন্তদা, হেমন্তকুমার, আপনাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ, যখন হিন্দি ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে ‘গঙ্গা আয়ে কহাঁ সে’ গানটি গাইতে এলেন। রেকর্ডিং রুমে ঢুকেই ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। সামনে মাইক, হেমন্তদার হাতে সিগারেট! তখন হেমন্তদা ভাল গাইবেন, এটা কোনও বলার মতো কথাই নয়। ওটাই হয়। কন্সট্যান্ট। গান শেষ হল। আমি অবাক, বলেই ফেললাম, ‘হেমন্তদা, গলা খারাপ হয়ে যাবে এই ভয়ে প্রায় কোনও গায়ক সিগারেটই খায় না, আর আপনি রেকর্ডিংয়ের সময় সিগারেট টানতে টানতে গান গাইলেন!’ হেমন্তদা রাগে-বিষাদে-আনন্দে সব সময় এক রকম। মুচকি একটা হাসির আভাস ছড়িয়ে বললেন, ‘না হলে আমার গলার গ্রেনটা ভাল আসে না, গলাটা পরিষ্কার হয় না।’

আরও একটা আশ্চর্য যাওয়ার মতো খবর দিতে পারি। এক জন অমন ব্যারিটোন গলার লোক নস্যি নিতেন! তার পরেও ওই গলা। ঈশ্বর যে একটু বেশি পার্শিয়ালিটি করেছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। হেমন্তদার একটা দারুণ ভঙ্গি ছিল নস্যি নেওয়ার। অনেক ক্ষণ ধরে উনি নস্যি নেওয়ার প্রসেসটা চালাতেন। প্রথমে পকেট থেকে ডিবেটা বের করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ট্যাপ করতেন। তার পর এক চিমটে নস্যি বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ফাঁকে ধরে অনেক ক্ষণ গল্প করতেন অন্যের সঙ্গে। আমি ভাবতাম কত ক্ষণ একটা লোক এটা ধরে রেখে দিতে পারে, কখনই বা হেমন্তদা নস্যি নেবেন। তার পর গল্পের একটা ইন্টারভ্যালে মুখটা একটু সরিয়ে টুক করে নস্যিটা নিতেন। তার পর ধুতির কোঁচাটা পকেট থেকে বের করে সেটা দিয়ে হাতটা একটু ঝেড়ে নিয়ে ফের পকেটে কোঁচাটা ঢুকিয়ে রাখতেন। আশ্চর্য একটা গ্রেস ছিল ওঁর। যখন দু-হাত বুকের কাছে পাল্টাপাল্টি করে রেখে (মানে বিবেকানন্দ স্টাইলে) অন্যের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, সেটাও দেখার মতো ছিল। আসলে একটা অত লম্বা লোক, সোজা মেরুদণ্ড, অনাড়ম্বর ইমেজ কিন্তু স্টাইলিশ গায়কি আর মেজাজি জীবনধারা— এ রকম রয়্যাল কম্বিনেশন, নাহ্, বড় একটা দেখিনি।

এর পর যোগাযোগ কিছু বাড়ল। স্টুডিয়ো বা রেকর্ডিংয়ের বাইরেও দেখা হত কোথাও কোথাও। হঠাৎ বিমল রায় চলে গেলেন। আমরা, মানে বিমলদার ছেলেরা অনাথ হয়ে গেলাম। আর হেমন্তদা এলেন সিনে, বিরাট বুকের পাটা নিয়ে। সাহস, ঔদার্য আর ভালবাসা জমা ছিল সেখানে। আমাদের প্রত্যেককে বিভিন্ন কাজ দিলেন, কাজের সন্ধান দিলেন। এবং সম্পূর্ণ নিজে থেকে যেচে এসে সাহায্য করলেন। মুকুল দত্ত ছিল বিমলদার সেক্রেটারি। ওর কবিত্বের কথা বোধ হয় হেমন্তদা জানতেন। মুকুলকে বললেন বাংলা গান লিখতে। আমায় নিয়ে নিলেন ওঁর হিন্দি সিনেমার গান লেখা ছাড়াও চিত্রনাট্যের কাজে। আরও সবাইকে আস্তে আস্তে কাজের সন্ধান করে দিলেন।

এক দিন হেমন্তদার জুহু-র বাড়ির মিউজিক রুমে বসে আছি। উনি একটা পাশবালিশে ভর দিয়ে ওঁর হারমোনিয়ামে সুর করছেন, একটু হেলান দিয়ে। ওটাই ওঁর স্টাইল ছিল। আর সুরটা হয়ে গেলেই সটান উঠে বসে গেয়ে নিতেন এক বার। আবার হেলান দিয়ে সুর ভাঁজতেন। এ রকমই এক দিন হঠাৎ বললেন, ‘গুলজার, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ দেখেছ?’ ‘দেখেছি, কিন্তু অনেক দিন আগে। খুব স্পষ্ট মনে নেই।’ ‘আচ্ছা, ওটা হিন্দিতে করলে কেমন হয়?’ ‘দারুণ হয় দাদা।’ আমার তো সুচিত্রা সেনের দীপ জ্বেলে যাই-এর সব শট টকাটক মনে পড়তে লাগল। বললেন, ‘চলো।’ বলেই উঠে পড়লেন এবং রেডি হয়ে গেলেন। এই সময় বেলাদি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এ কী গো, এখন কোথায় যাচ্ছ?’ বললেন, ‘অসিত এসেছে। কাছেই রয়েছে একটা হোটেলে। ওর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’ গেলাম, অসিত সেনের কাছে। হেমন্তদা খুব উদাস ভাবে বললেন, ‘আচ্ছা, অসিত, তোমার ওই, দীপ জ্বেলে যাই হিন্দিতে হলে কেমন হয়।’ অসিতদা আরও উদাস এবং আহত সুরে বললেন, ‘এ সব সিনেমা কে হিন্দিতে করবে দাদা?’ ‘আমি করব, আর সেই জন্যই তোমার কাছে এসেছি।’ অসিতদা প্রথমটা থম মেরে গেলেন আর তার পরের দশ মিনিটে আমরা হইহই আলোচনা করে ফেললাম, কাস্টিং কী হবে, লোকেশন কী হবে, বাজেট কী হবে, কে চিত্রনাট্য লিখবে। যখন ফিরছি, গাড়িতে হেমন্তদা ওঁর ছায়াসঙ্গী পরিমলকে বলছেন, ‘পরিমল, কাল একটা ট্রায়াল শো রাখ তা হলে।’ পরিমল খুব শান্ত গলায় বলল, ‘হেমন্ত, তার জন্য প্রিন্টটা আনাতে হবে। ওটা বম্বেতে পাওয়া যাবে না।’ শিল্পের প্রতি অসম্ভব ভালবাসা, কনভিকশন, দরদ না থাকলে দশ মিনিটে সিনেমা ফাইনাল হয় না।

হইচই করে শুরু হল ‘খামোশি’। ওয়াহিদা রেহমান মেন লিড। এক দিন ওঁর বাড়ি গেলাম হেমন্তদার সঙ্গে। ওয়াহিদাজিকে আমার সেই প্রথম চর্মচক্ষে দেখা। আরে এ কী! এ তো একটা শ্যামলা মেয়ে! সিনেমায় যে ওই রকম টকটকে রং মনে হয়! একটু দমে গেলেও, খামোশি-র ‘হামনে দেখি হ্যায় ইন আঁখো কি মহেক্তি খুশবু’ গানের কলিগুলো আমার মনে ফুটতে শুরু করল। গানটা লিখে ফেললাম। হেমন্তদা অসাধারণ একটা সুর করে ফেললেন। এবং তার পর বোমটা পড়ল। হেমন্তদা নির্বিকার ভাবে বললেন, ‘গানটা লতা গাইবে।’ ‘বলেন কী হেমন্তদা? এটা এক জন ছেলে তার প্রেমিকাকে দেখে গাইছে। এটা কোনও মেয়ে তার প্রেমিককে দেখে গাইতে পারে না। ওটা হয় না।’ ‘না হে গুলজার, এটা লতার গলায় মানাবে ভাল।’ ‘আরে মানালেই হল, একটা ছেলের অভিব্যক্তির গান, মেয়ে গাইছে?’ আমার গাঁইগুঁই, হেমন্তদা নাছোড়। শেষমেশ ঠিক হল, এই গানটা রেডিয়োয় এক জন মেয়ে গাইছে। রেডিয়োয় যে কেউ যে কোনও গান গাইতে পারে। আর আশ্চর্য, আজ অবধি কেউ কোনও দিন লতাজির গানটা শুনে ও-সব ছেলের গান মেয়ের গান মার্কা আপত্তি তোলেইনি! হেমন্তদার সুরের জাদু আর বোঝার ক্ষমতা এমনই ছিল। তবে গানটা নিয়ে আমি খুব বিপাকে পড়লাম। সবাই বলতে লাগল, এটা গান না কবিতা? সিনেমার গানে কবিতা হয়? খুশবু হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়? গুলজার ছোকরার ভারী সমালোচনা হল। কিন্তু হেমন্তদার মধ্যে একটা লুকনো কবি ছিল তো। উনি বলেছিলেন, গুলজার, যে যাই বলুক, তুমি এই সব লাইন বদল কোরো না। ওই সাহস জুগিয়েছিলেন বলেই বোধ হয় এখন ‘গুলজারিশ’ কথাটা চালু হয়েছে!

gulzar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy