Advertisement
E-Paper

প্রাণটুক লইয়া আছি রে বাবা

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সবে দেশভাগ হয়েছে। সে বড় অরাজকতার সময়, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে প্রত্যন্ত গাঁয়েগঞ্জে মানুষের কোনও নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তাও নেই। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে মুন্সিগঞ্জের বানিখাড়া গ্রাম, থানা টঙ্গিবাড়ি। সেই বাড়িতে তখন মেলা লোক। আমার সম্পর্কিত কাকা, জ্যাঠা, দাদু এবং কাকিমা, জেঠিমা, ঠাকুমা, দুজন বালবিধবা ঠাকুমা এবং কুমারী মেয়ে, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যুবক নিয়ে সে অনেক মানুষ।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০

সবে দেশভাগ হয়েছে। সে বড় অরাজকতার সময়, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে প্রত্যন্ত গাঁয়েগঞ্জে মানুষের কোনও নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তাও নেই। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে মুন্সিগঞ্জের বানিখাড়া গ্রাম, থানা টঙ্গিবাড়ি। সেই বাড়িতে তখন মেলা লোক। আমার সম্পর্কিত কাকা, জ্যাঠা, দাদু এবং কাকিমা, জেঠিমা, ঠাকুমা, দুজন বালবিধবা ঠাকুমা এবং কুমারী মেয়ে, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যুবক নিয়ে সে অনেক মানুষ। কিন্তু প্রত্যেকেই বিভ্রান্ত। পাকিস্তান ব্যাপারটাই তারা তেমন বুঝতে পারছে না।

মাতব্বররা পরামর্শ দেন উলটোপালটা। কেউ বলেন, না হে, দ্যাশে থাকন যাইব না। কেউ বলেন, আরে, ভাগাভাগি তো কাগজপত্রে, আমাগো দ্যাশ আমাগোরই আছে। কোনওখানে যাওন লাগব না।

এই দোলাচলে গোটা পরিবারের বক্ষ দুরুদুরু। মধ্যবিত্ত পরিবার, চাষবাস আর শিক্ষকতা নিয়েই তাঁদের দিন-গুজরান, সম্পন্নতা বলতে কিছুই তেমন নেই। আমার দাদু ময়মনসিংহের সফল মোক্তার, তিনি কিছু টাকা পাঠাতেন দেশে, এই ভাবে চলছিল। দাদু তো দেশভাগের অনেক আগেই মারা গেছেন। বানিখাড়ার গ্রামের বাড়ি সুতরাং তখন টালমাটাল। কেননা দেশ ছেড়ে এলেও পশ্চিমবঙ্গে কোথায় আশ্রয় জুটবে তারও তো কিছু ঠিক নেই। এতগুলো মানুষের চলবেই বা কী করে?

রোজই বাড়ির পুরুষেরা একত্রিত হয়ে শুকনো মুখে নানা সম্ভাবনার কথা আলোচনা করেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত কিছুই হয় না। সব আলোচনাই অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়। বাচ্চাদের মুখেও হাসি নেই। তারাও বুঝে গিয়েছিল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে, আর সেটা মোটেই বাঞ্ছিত নয়।

ঠিক সেই অস্থির সময়ে এক দিন মধ্যরাতে বাড়িতে ডাকাত পড়ল। সেই সময়ে ডাকাতদের ছিল পোয়াবারো। সংকটের সময়ে হাওয়া বুঝে তারা লুটপাটের একেবারে মচ্ছব শুরু করেছিল। প্রতি রাতেই কোনও না কোনও বাড়িতে ডাকাত পড়তই। গাঁ ছেড়ে যারা চলে যাচ্ছিল, পথে তাদের ওপরেও হামলা হত।

তবু গাঁয়ের প্রাচীন বাসিন্দা আর সত্‌ ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিত বলে পরিবারের কিছু সুনাম থাকায় ক্ষীণ বিশ্বাস ছিল যে ডাকাতরা হয়তো পণ্ডিতবাড়িকে রেয়াত করবে। করেনি।

মাঝরাতে ডাকাতের হুংকারে আর টর্চের আলোর ঝলকানিতে গোটা পরিবার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ডাকাতরা বলছিল, যা আছে বাইর কইর্যা দে তাড়াতাড়ি, না হইলে কাইট্টা ফালামু। তাদের হাতে রাম দা, দা, সড়কি আর লাঠি। মুখে কালিঝুলি মাখা থাকলেও তাদের অনেককেই চেনে আমাদের পরিবার।

ধনের চেয়ে প্রাণের মায়া অনেক বেশি। সুতরাং রব উঠল, প্রাণে মাইরোনা রে বাপ, যা আছে লইয়া যাও।

বাইর কর, বাইর কর যা আছে। সোনাদানা দে, টাকাপয়সা দে।

সেই সময়ে আমার নসুকাকুকে এক ডাকাত চুলের মুঠি ধরে কিছু দিয়ে মারতে উঠেছিল। বাড়ির সবচেয়ে নিরীহ, সবচেয়ে চুপচাপ, সাত চড়ে যার রা নেই সেই মিছরিপিসিমা হঠাত্‌ চৌকি থেকে লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে ডাকাতটাকে পাছড়ে ধরলেন, মারো ক্যান, অ্যঁা! মারো ক্যান? ছাইরা দাও, আহ আমার লগে, দেখাইয়া দিতাছি কোনখানে কী আছে।

ডাকাতটা কাকুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, চালাকি করলে কিন্তু এই দাও দেইখ্যা রাখ। দোফালা কইরা ফালামু।

মিছরিপিসিই অতঃপর ডাকাতদের গাইড। কোথায় কাঁসার বাসন, রুপোর গোট, কানের মাকড়ি আছে, কোথায় আছে লুকনো কাঁচা টাকা, সব দেখিয়ে দিতে লাগলেন। মুখে বিড়বিড় করে মন্ত্রের মতো শুধু বলে যাচ্ছিলেন, আমরা কি আর রাজা জমিদার? তবে প্রাণটুক লইয়া আছি রে বাবা। প্রাণটুক লইও না। আর সব লইয়া যাও।

উঠোন ঘিরে আলাদা আলাদা ঘর, বিচ্ছিন্ন। সব ঘরেই হানা দিল ডাকাতরা। সঙ্গে মিছরিপিসি। ঘরে ঢুকেই আগে মানুষজনকে আড়াল করে দাঁড়ান আর বলেন, মানুষগুলারে কিছু কইরোনা, তোমাগো পায়ে ধরি।

ডাকাতিতে দু-চারটে লাশ পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। ভয় এবং আতঙ্ক সঞ্চার করতে হৃদয়হীন ডাকাতদের ওটা একটা কৌশলগত চাল। ভয় পেলে মানুষ আর ধনসম্পদের মায়া করে না, লুকনো জিনিসও বের করে দেয়।

কিন্তু নিরীহ, নীরব, ভিতু আর দুর্বল মিছরিপিসির জন্যই ডাকাতরা সে দিন রক্তপাত ঘটায়নি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লুটপাট সেরে তারা চলেও যায়।

ঘটনার পর মিছরিপিসিকে কেউ কেউ দোষারোপ করেছিল বটে, তুই ক্যান ডাকাইতগো সব দেখাইয়া দিলি?

কিন্তু পরবর্তী কালে সকলেই নিরীহ মিছরিপিসির ভূয়সী প্রশংসাই করত। বলত, মিছরির বড় সাহস, হ্যায় না থাকলে কী যে হইত কে জানে! মিছরিপিসি কিন্তু নির্বিকার, কোনও হেলদোল নেই।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

rabibasariyo shirshendu mukhopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy