Advertisement
E-Paper

পাশের বাড়ি থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে গেলাম

সিনেমায় তো হঠাৎ ওই ভাবে এক বারে সুযোগ পাইনি। আমি প্রথমে নাটকে আসি, ‘নতুন ইহুদি’। আমার জন্ম বাংলাদেশে। দেশভাগের পরে বেশ ছোট বয়সেই কলকাতায় আসা। বাবা-মা অনেক পরে এসেছিলেন যদিও। কারণ ওখানে আমাদের বাড়ি-টাড়ি, অনেক গরু ছিল।

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৭

সিনেমায় তো হঠাৎ ওই ভাবে এক বারে সুযোগ পাইনি। আমি প্রথমে নাটকে আসি, ‘নতুন ইহুদি’।

আমার জন্ম বাংলাদেশে। দেশভাগের পরে বেশ ছোট বয়সেই কলকাতায় আসা। বাবা-মা অনেক পরে এসেছিলেন যদিও। কারণ ওখানে আমাদের বাড়ি-টাড়ি, অনেক গরু ছিল। সব ছেড়ে তো চলে আসা যায় না। তাই আমাদের দুই বোনকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। এখানে এসে ভিক্টোরিয়া স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস থ্রি-তে।

তখনও আমি খুবই ছোট, ফ্রক পরি। বোধ হয় ক্লাস সিক্স কি সেভেন। তত দিনে বাবা এ দেশে চলে এসেছেন। আমরা থাকতাম ভবানীপুর স্কুল রো-তে। একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করেছিলেন বাবা। সেই ঘরেই বাবা, মা, ঠাকুমা, আমার আগের বোন, আমি থাকতাম। এক দিদি আমায় মানুষ করেছিল, তাকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। কাজেই সে-ও থাকত সঙ্গে। সেই সময়েই দেখতাম, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও কয়েক জন রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে একটা পানের দোকানের সামনে আড্ডা মারতেন। প্রতি দিনই দেখতাম, স্কুল থেকে ফেরার সময়ে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো সিনেমায় আগে দেখেছি। কাজেই চিনতে পারতাম বেশ। এক দিন ভানুদা এসে আমায় বললেন, ‘আমরা একটা বাঙাল কথার নাটক করছি, উদ্বাস্তুদের নিয়ে। দেশভাগের পরে তাঁদের জীবনযুদ্ধটাকে ধরেই হচ্ছে সেই নাটক। শুনেছি, আপনি বাঙাল কথা বলতে পারেন ভাল, পূর্ববঙ্গের মেয়ে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ পারি। তবে আমি তো এ সব কিছু জানি না। আপনি আমার বাবার কাছে যাবেন।’ উনি এলেন বাবার কাছে। তখনই জানতে পারলাম, ওঁর আসল নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি আবার আমাদের আত্মীয়ও। আমার মেজদি ওঁর নিজের মামি।

বাবা রাজি হলেন ভানুদার কথায়। তবে বললেন, ‘রাস্তাঘাট আমার মেয়ে ভাল চেনে না। শুধু স্কুলে যায় আর আসে। কাজেই তুমি এসে নিয়ে যেও ওকে।’ পরের দিন ভানুদা আমাকে নিয়ে যেতে এলেন। আমাদের তখন এতই অবস্থা খারাপ যে স্কুলের কেড্স ছাড়া অন্য কোনও জুতো ছিল না। তাই খালি পায়েই গিয়েছিলাম নাটকের মহড়ায়। ভানুদা আমায় দেখে বলেছিলেন, ‘খালি পায়ে যাচ্ছ কেন?’ বললাম, ‘আমার তো জুতো নেই। কেড্সটাও প্রায় ছিঁড়ে গিয়েছে।’ তখন উনি আমায় একজোড়া জুতো কিনে দিয়ে বললেন, ‘এই কলকাতা শহরে খালি পায়ে হাঁটা যায় না।’ সেই জুতো আমি বহু বছর যত্ন করে রেখেছিলাম।

তার পরে ভানুদা আমায় চেতলায় এক ভদ্রলোকের বাড়িতে নিয়ে গেলেন নাটকের মহড়ার জন্য। সেই নাটকের দলে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশীল মজুমদারের মতো মানুষেরা ছিলেন। নাটকটার নাম ‘নতুন ইহুদি’। তবে আমায় দেখে প্রথমে ওঁরা ‘না’ করে দিয়েছিলেন। কারণ, তখন তো আমি খুবই ছোট! কিন্তু পরে বোধ হয় ওঁরা আর কাউকে খুঁজে পাননি, তাই আবার আমার কাছে এসেছিলেন। তখন শুরু হয়েছিল আমাকেই ঘষেমেজে তৈরি করে নেওয়ার কাজ। পুরোদমে চলত মহড়া। তার পরে কালিকা থিয়েটারে নাটকটা হল, সবাই ধন্য ধন্য করল। বলল, ‘বাবা! এই বাঙাল মেয়েটি কে? অসাধারণ অভিনয় করেছে!’

যে ক্লাবে আমি ‘নতুন ইহুদি’র মহড়া দিতাম, সেখানে মাঝেমধ্যেই অনেক চিত্রপরিচালক আসতেন। তাঁদেরই এক জন ‘পাশের বাড়ি’ ছবিটার কথা বলেন আমাকে। ছবিটার পরিচালক ছিলেন সুধীর মুখোপাধ্যায়, যিনি আবার ‘বরযাত্রী’, ‘পরিবর্তন’ও পরিচালনা করেছিলেন। ভানুদাই আমায় নিয়ে গেলেন ছবির ওখানে। ওঁরাও প্রথমে আমায় দেখে বললেন, ‘এত বাচ্চা মেয়ে। এ করতে পারবে না।’ আর আমি তো তখন খুব রোগাও ছিলাম। এ ভাবে দিন যেতে লাগল। ওঁরাও নায়িকা খুঁজে পান না। ইতিমধ্যে ‘নতুন ইহুদি’র আরও শো হল। আমারও বেশ নামডাক হল। তখন ওঁরা আমাকেই নায়িকার ভূমিকায় নিলেন। কিন্তু শুটিং চলতে চলতে টাকার কারণে বন্ধ হয়ে গেল ছবিটা।

প্রায় ছ’মাস না এক বছর বাদে যখন আবার শুটিং শুরু হল, তত দিনে ‘নতুন ইহুদি’ও চলছে সমান তালে। খুব নাম হয়ে গিয়েছে। ‘পাশের বাড়ি’তে আমার সঙ্গে ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার। আর গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গান-অভিনয় দুটোই করেছিলেন। গল্পটা ছিল এই রকম— দুটো পাশাপাশি বাড়ি। একটা বাড়িতে থাকত একটা মেয়ে। সে খুব গান ভালবাসত। মানে আমার চরিত্রটা। কিন্তু হিরো সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় গান জানতেন না। সেই জন্য অন্ধকারে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গান গাইতেন, মেয়েটি ভাবত হিরোই বুঝি গান গাইছে। তার পরে সেই নিয়ে অনেক ভুল-বোঝাবুঝি। শেষে মিলন। পুরোদস্তুর হাসির ছবি।

এখন তো হিরোইনদের গাড়ি পাঠাতে হয়, আরও কত কী! আমাদের সময়ে ও সব ছিল না। মনে আছে, বাসে করে গিয়েছিলাম প্রথম শুটিং-এ। রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতে হয়েছিল শুটিং। প্রথম দিন আমায় বলা হয়েছিল, দু-একটা ভাল শাড়ি-ব্লাউজ নিয়ে আসবে। আমি ভাল শাড়ি কোথায় পাব! তাই আমাদের পাশের বাড়ি থেকে একটা চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনের প্রথম শটটা খুব ভাল হল। শটটা ছিল, কান্নাকাটি করে এ-বাড়ি থেকে ছুটে ও-বাড়ি যাচ্ছি। তার পরে ছবির প্রযোজক আমায় বললেন, ‘আজকে তোমার সঙ্গে কন্ট্র্যাক্ট করব। আজকে শুটিংটা করে দেখছিলাম, তুমি ঠিক পারবে কি না।’

‘পাশের বাড়ি’ সাংঘাতিক চলেছিল। সুপার-ডুপার হিট। তার পরে আমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কয়েক জন বলল বটে, ‘বাঙাল কথার টান আছে। অন্য ছবিতে সমস্যা হবে।’ কিন্তু পেয়ে গেলাম আরও ছবি। তবে সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারও আমি সমানে চালিয়ে গিয়েছি। ‘শ্যামলী’, ‘মল্লিকা’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘পরিণীতা’, ‘শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মী’— কত নাম বলব! আমার দ্বিতীয় ছবি ছিল শরৎচন্দ্রের ‘শুভদা’। সেটা আবার ট্র্যাজেডি। কিন্তু দিব্যি উতরে গিয়েছি। আসলে মনে হয়, সেই সময়ে সঙ্গে যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁদের জন্যই উতরে গিয়েছি। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, কমল মিত্র, প্রভা দেবী— দিকপাল অভিনেতা সব! আর ওঁদের মতো কেউ জন্মাবে না। ওঁদের থেকেই সব পেয়েছি, ওঁদের থেকেই সব শিখতে পেরেছি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy