Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জা স্ট যা চ্ছি

ফুল ফুটুক না-ফুটুক, আজ বসন্ত নয়

সকাল হলেই যে পাখিগুলো ডাকাডাকি শুরু করে দেয়, বেলা বেড়ে গেলে তারা আর ডাকে না। ডাকলেও, অন্য রকম শোনায়। তখন হয়তো ওরা অন্য কথা বলে-টলে। পাখিদের তো প্রায় দেখতেই পাই না। অথচ দিব্যি বুঝতে পারি, কাছেপিঠেই রয়েছে। এই কার সঙ্গে দর-কষাকষি চলছিল, সেটা শেষ না করেই উড়ে গেল অন্য কারও কাছে, জরুরি কথা বলতে, ভুলে যাওয়ার আগে।

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

সকাল হলেই যে পাখিগুলো ডাকাডাকি শুরু করে দেয়, বেলা বেড়ে গেলে তারা আর ডাকে না। ডাকলেও, অন্য রকম শোনায়। তখন হয়তো ওরা অন্য কথা বলে-টলে। পাখিদের তো প্রায় দেখতেই পাই না। অথচ দিব্যি বুঝতে পারি, কাছেপিঠেই রয়েছে। এই কার সঙ্গে দর-কষাকষি চলছিল, সেটা শেষ না করেই উড়ে গেল অন্য কারও কাছে, জরুরি কথা বলতে, ভুলে যাওয়ার আগে। চার পাশের পরিস্থিতি দেখে নিয়ে একটু উঁচু জায়গায় নিজেকে তুলে নিয়ে লাল ঝুঁটি জোরসে ডাক পাড়ল, সে যে আছে বুঝিয়ে দিয়ে। মা-মুরগির অনেক কাজ, কী যেন সব খুঁজে বেড়াচ্ছে এ-দিক ও-দিক। তাই ছানারাও পর পর পিছন পিছন, কিচমিচ করে। ভালমানুষ কালো কুকুর, কপালে একটু সাদা, এক বারও ভুক করেনি, আসছিল গুটগুট করে, অমনি তাকে দেখেই মুরগিরা খচমচ করে ঢুকে পড়ল ঝোপের মধ্যে। গরু দাঁড়িয়েছিল এমনি এমনি। খড় দেওয়া হয়েছে, খাচ্ছিল, এখনও বাকি আছে কিছুটা। কিন্তু সময় পড়ে আছে আরও অনেক বেশি। তাই মুখ তুলে এক বার আমাকে দেখেছে। নিজের চেনা লোকদের আশেপাশে দেখতে না পেয়ে এক বার ডেকেছে। এ ছাড়াও আরও অনেক রকম শব্দ কানে আসছে, এই তো সাইকেলের চেনের কিরকির আওয়াজ শোনা গেল। আর মা পা গা রে সা হর্ন। বাস লোক ডাকছে রাস্তায়।

সেই পুজোর সময় থেকেই শুনছি, সবাই বলছে, বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে। কিছু দিন আগে, যখন সরষে খেতগুলো হলুদে ভরে ছিল, রোদে ঝলমল করত, সন্ধে হলেই বুঝতে পারতাম, ঠান্ডা হবে রাতে। কাঠকুটো জোগাড় করে খোলা জায়গায় আগুন জ্বালতাম। একটা দুটো হলুদ ফুলকি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইত নীল তারাদের। ভোররাতে, কম্বলের ফাঁক দিয়ে চোরা ঠান্ডা ঢুকে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে উঠে বসতাম। দেখতাম অসুখে মোড়া একটা সাদা পরদা, জানলার বাইরে। ঘুম না কাটলেও পরিষ্কার শুনতে পেতাম কারা যেন কী সব বলাবলি করছে আশেপাশে। তার পর পৌষ গেল, মাঘ নিয়ে গেল একটাও কথা না বলা ভিজে ঠান্ডাকে। এই সময়েই এক দিন পা ঘষে ঘষে চলে যাওয়া এক জনকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘কাকা, বসন্ত কবে আসছে জানো?’ লোকটা দাঁড়াল, একটু ভেবে, কী সব হিসেব করে বলল, ‘চলে গেছে, রোদের খুব তাপ।’ বলামাত্র দেখতে পেলাম কুঁকড়ে যাওয়া নানা রকম বাদামি পাতায় বাতাস লেগেছে, এ সরে বসল ওখানে, ও উড়ে গেল সেখানে। মাথা নামিয়ে আমিও ভাবলাম, তার পর মুখ তুলে তাকাতেই হল।

সামনেই একটা বড় বাঁশবন। ঠাসা হলুদ লাঠিগুলো সবুজ হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে, সেখানে পাতায় পাতায় ঝুরোঝুরি। এর পিছনেই মনে হল কিছু একটা হচ্ছে, রংচং নড়ছে, গলা শোনা যাচ্ছে, চেরা গলায় কান্নাও। আমাকে এগোতে হল না, ওরাই বেরিয়ে এল হুড়মুড় করে। অনেকগুলো ছেলে, একটা মেয়ে, সে-ই কাঁদছে, চোখের তলাটা জলে-ধুলোয় মাখামাখি, বার বার মুছছে। আবার ভরে যাচ্ছে লাল হয়ে ওঠা ফোলা গাল দুটো। হাতে নখে ময়লা ভর্তি। আমাকে দেখেই ছেলেগুলো চিৎকার করে বলল, ‘ও ইট মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’ দ্বিতীয় ‘ও’-কে দেখা গেল একটু দূরে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে কোনও বিকার নেই। বুঝতে একটু সময় লাগল। ইট নয়, মাটির শক্ত ঢেলা তুলে ছুড়েছে মেয়েটা। যাকে মেরেছে, তার কোনও চোট চোখে পড়ল না। বাকিরা নিশ্চয়ই একা পেয়ে কোণঠাসা করে মেয়েটাকে দিয়েছে দু’ঘা। স্রেফ মুখের কথায় কেউ কাঁদে না এখানে। আমি এসে পড়ায় আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি করে বিচার চাইছে। এটাও বুঝলাম, আমি না এসে পড়লে মেয়েটাকে আরও অত্যাচার করত এরা। ঠিক ছোটও নয়, আবার বড়ও নয়। তাই আমাকে বুঝেসুঝে কথা বলতে হবে। বললাম, ‘তুই ইট মেরেছিস?’ মাথা নাড়ল অদ্ভুত ভাবে। মানেটা বোঝা গেল না। কেন, জিজ্ঞেস না করে ছেলেগুলোকে বললাম, ‘তোরা একে মারলি কেন?’ মেয়েটা আবার ফুঁপিয়ে উঠল। কিন্তু সেটা চাপা পড়ে গেল অভিযোগকারীদের হট্টগোলে। এ বারে, যাকে মারা হয়েছে, তাকে বললাম, ‘এ দিকে শোন।’ সে এল না, বরং দু’পা সরে গেল। অর্থাৎ ঘটনার আগেও একটা কিছু ঘটেছে। যেটা এর সঙ্গে মেয়েটার। তার পরের ঘটনার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আবার বললাম গলা তুলে, ‘তুই কী করেছিলি?’ বলতেই ছেলেটা এক হাত তুলে হাওয়ায় ছুড়ল এক বার। ‘কেন করলি অমন?’ বলতেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে রোদে জ্বলা শুকনো চাষের মাঠটা দেখতে লাগল মন দিয়ে। অন্য ছেলেগুলো এক বার আমাকে এক বার ওকে দেখছে। বুঝতে পারছে তাদের অভিযুক্তের শাস্তি না-ও হতে পারে। আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম আমার না-দেখা, না-জানা ব্যাপারও আছে অনেক। রাজনীতিও আছে। সেখানে আমার মতো বাইরের লোক ঠিক কী করতে পারে সেটাও ভাবতে হবে। মোটা দাগের সাধারণ ঘটনা, কিন্তু পরিস্থিতিটা সূক্ষ্ম।

চোখে পড়ল, সেই লোকটা আবার আসছে, পা টেনে টেনে, থোকা থোকা লাল কমলা ফুল ভরা গাছটাও চোখে পড়ল। অনেক বার বলা সত্ত্বেও শিমুল আর পলাশের তফাতটা আমি আজও বুঝি না। আমাদের জটলা দেখে সে কাছে এসে থামল, কিছু বলল না। হনহন করে, মাথায় প্রচুর শুকনো ডাল নিয়ে কয়েক জন মহিলাও চলে গেল আমাদের পাশ দিয়ে। দাঁড়াল না। এ-দিক ও-দিক থেকে আরও কয়েকটা বাচ্চা এসে গেল। সবাই অপেক্ষা করছে, এ বারে কিছু একটা হবে তার আশায়। অপেক্ষা আমিও করছিলাম, বুঝতেই পারছিলাম না কী করা উচিত। শুধু এটাই বুঝতে পারছিলাম, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত নয়। লোকটা আর একটু এগিয়ে এল, এ বারে খেয়াল করলাম তার হাতে একটা লাঠিও আছে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই বয়স কত। একেবারে শুকিয়ে যাওয়া, ভাঙাচোরা ব্যাপার রয়েছে।

লোকটা হাত নেড়ে ডাকল ইট-ছোড়া মেয়েটাকে। সে আর কাঁদছে না, বড় চোখে স্রেফ তাকিয়ে আছে। গেল। যেতেই দলটার মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ল কিছু একটা বলার। অন্য ভাষা, আমি বুঝলাম না। বুঝতে পারছিলাম আমার বিচারকের জায়গাটা চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বাঁশবনের ছায়াটা বধ্যভূমি হয়ে উঠছে। সব পাখিরা চুপ। অনেক দূর থেকে শুধু এক জন কুব কুব করে ডেকে চলেছে। এ বারে কথা বলল লোকটা, ‘তোরা যা, যেমন খেলছিলিস খেল গিয়ে।’ দলটা একটু একটু করে পিছিয়ে গেল। কিছু দূরে, গাছপালার আড়ালে, হাইওয়ে, সেখান থেকে সাঁ সাঁ করে ভারী ট্রাকের চাকার শব্দ শোনা গেল। লোকটা আরও এগোল, মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘তোমার নাতনি?’ জিগ্যেস করায় লোকটা বলল, ‘না, মেয়ে।’

দলটা সরতে সরতে চলে গেল, নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করে ট্রেন-ট্রেন জাতীয় খেলা জুড়ে দিল, আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। যে যেখানে ছিলাম সেখানে। কেউই কোনও কথা বলছিলাম না। লোকটা এ বারে একটু এগোল মেয়ের দিকে, সে চোখ তুলে এক বার তাকাল। তাকাতেই ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়ল সদ্য কান্না-শুকোনো গালে। লোকটা আবার হাঁটতে শুরু করল পা টেনে টেনে, ঘুরেও দেখল না। মেয়েটাও কাঁদল না এতটুকু। ছোট ছোট খালি পা ফেলে হাঁটতে লাগল বাবা যে-দিকে যাচ্ছে, সেই দিকে।

ছবি : লেখক।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhamoy mitra anandabazar rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE