Advertisement
E-Paper

বাচ্চাটা হাত ধরে টানছে, সেই দিকে হাঁটছি

না খোদা মসজিদের উলটো পারের দোকানগুলোর সামনে সত্যিকারের মানুষের মাপের পুতুলকে বোরখা পরানো থাকে। ভিড়ের রাস্তা। গাড়ি, রিকশা আর ট্রাম একসঙ্গে ঢুকে পড়লে জ্যাম হয়ে যায়, তার ফাঁকফোকর দিয়ে পায়ে হাঁটা লোকরা নিজেদের গলি খুঁজে চলে যায়— যার যেখানে খুশি।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০২
ছবি: শুভময় মিত্র।

ছবি: শুভময় মিত্র।

না খোদা মসজিদের উলটো পারের দোকানগুলোর সামনে সত্যিকারের মানুষের মাপের পুতুলকে বোরখা পরানো থাকে। ভিড়ের রাস্তা। গাড়ি, রিকশা আর ট্রাম একসঙ্গে ঢুকে পড়লে জ্যাম হয়ে যায়, তার ফাঁকফোকর দিয়ে পায়ে হাঁটা লোকরা নিজেদের গলি খুঁজে চলে যায়— যার যেখানে খুশি। সামনেই জ্যাকারিয়া স্ট্রিট, খানদানি মুসলমান পাড়া। বোরখা পরা মহিলারা যখন পুতুলগুলোর পাশ দিয়ে চলাফেরা করেন, তখন একটু ধাঁধা লেগে যায় চোখে। পুতুলকেও মনে হয় মানুষ, অবাক চোখে যেন ভাবছে কিছু। চুপ করে। এই পুজোর সময় সন্ধেবেলা ভিড়টা আরও বেশি। চলেছে সবাই উত্তর দিকে। কিছুটা পরেই চিৎপুরের দু’পাশে শুরু হয়ে যাবে একের পর এক বিখ্যাত পুজো। পাথুরিয়াঘাটা থেকে শুরু করে কুমোরটুলি হয়ে বাগবাজার, আহিরীটোলা। বাড়িতেও পুজো আছে। প্রাচীন কলকাতার বুকে লম্বা দুর্গামেলা। গরমটাও কমে গেছে, বিকেলের পর হালকা হাওয়ায় ম্যাজিক ঠান্ডা। প্রচুর আওয়াজ চারপাশে, সঙ্গে জুটেছে ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা মাইকের ঘোষণা। এক মাইক অন্য মাইকের কথা না শুনে নিজের গলা ফাটিয়ে চলেছে। রাস্তার ওপর যাদের বাড়ি তারা বারান্দায়, দরজায় দাঁড়িয়ে ভিড় দেখছে। তারা বোধহয় আমার মতো ঠাকুর দেখতে বেরয় না। আমি দক্ষিণের লোক। তাই এ সব দেখছি আর ভাবছি। হঠাৎ মনে হল আমার হাঁটুটা কেউ যেন ধরেছে, দেখি একটা ছোট্ট ছেলে। সে কিন্তু কিছু বলছে না আমাকে, চাইছেও না। স্রেফ খামচে ধরে আছে প্যান্টটা। আর নিজের মতো এ দিক ও দিক দেখছে। কার ছেলে কে জানে। বাবা মা আছে নিশ্চয়ই আশেপাশে, তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে চলে এসেছে, বোঝে না তো। কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করে লাভ হল না, অস্পষ্ট ভাবে কী একটা বলল, তার পর পকেট থেকে একটা ফাটা বেলুন বের করে মুখে দিল। আশপাশ দেখলাম, সম্ভাব্য বাবা বা মা জাতীয় কাউকে খুঁজলাম। লাভ হল না। দুম করে বাচ্চাটা দৌড়ে গেল রাস্তার দিকে, কী একটা কুড়োতে। ধরে আনলাম। তার পর হাতটা ধরেই রইলাম। সন্দেহ নেই, খুবই দুরন্ত। আর সেই জন্যেই পালিয়ে এসেছে বোধহয়। অথচ কোনও দুশ্চিন্তার ছাপ নেই মুখে।

আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ চেনে না, এ পাড়ার বাচ্চা নয়। কী করব বুঝতে পারছি না, এক সময় ছেলেটা আমার হাত ধরে টানতে লাগল। হয়তো জানে কোথায় থাকে, কোন দিকে বাড়ি। তাই এগোলাম সে দিকে। হাত ছাড়লেই দৌড়চ্ছে ভিড়ের মধ্য দিয়েই। ভয়ের ব্যাপার, উন্মত্তের মতো অটো চলছে। দৌড়ে একটু গিয়েই রাস্তায় উবু হয়ে বসে এটা ওটা তুলছে, মন দিয়ে দেখছে, ফেলেও দিচ্ছে। জোর করে হাত ধরে ছিলাম বলে একটা লাথিও মারল। একটা বোতলের ছিপি তুলতে গেল রাস্তা থেকে। পারল না। কারণ সেটা পিচে গেঁথে আছে। রেগে গিয়ে সেখানেও লাথি চালাল। খুবই রগচটা বাচ্চা। মুশকিলের ব্যাপার। বুঝতে পারছি না কী করব, থানায় যাওয়া উচিত। ঠিক করলাম আর একটু খুঁজব, তার পর ওটাই করব। ছেলে একটা দেশলাইয়ের বাক্স তুলেছে। মন দিয়ে দেখছে। লেবেলে ঠাকুরের ছবি। তাকাল আমার দিকে, বেশ খুশি খুশি মুখ। আমি যে অপরিচিত সেটা নিয়ে এতটুকু ভাবিত নয়। আবার হাত দেখিয়েছে, উত্তর দিকে। বাধ্য হয়ে চললাম। এতটাই নিশ্চিন্ত আর দৃপ্ত ভঙ্গি যে ওর নির্দেশগুলো অগ্রাহ্য করা যাচ্ছিল না। এম জি রোড পেরিয়ে দুধপট্টি। আঙুল দেখাল পরপর দুধের ক্যানগুলোর দিকে। খেতে চায় নিশ্চয়ই। বললাম এক জনকে। কী ভেবে সে কোথা থেকে একটা বড় ভাঁড় আনল, তাতে ভর্তি গরম দুধ। দিলাম ছেলেকে। খাবে না, কিছুতেই নয়। যে দিয়েছে সে দিয়ে চলে গেছে, ফেরত দেওয়ার উপায় নেই। বোকার মতো মুখ করে নিজেই খেলাম, ও দিকে হাতে টান পড়েছে। হাতটা আর ছাড়ছে না এখন। বুঝে গেছে আমাকে ওর দরকার। অনেকখানি চলে এসেছি। ফিরে যাওয়া উচিত কি না কে জানে? এমনও হতে পারে যে ওর বাড়ি আরও দক্ষিণে, লালবাজারের দিকে। মাথা কাজ করছিল না। হাতে টান পড়ছিল, আমিও হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম। পাথুরিয়াঘাটা এসে গেল। খুব ভিড় এখানে, দু’পাশেই পুজো। মুহূর্তের জন্য ছেলেটা আমার হাত ছেড়ে দৌড়ে চলে গেল। ফিরেও এল দু’মিনিটের মধ্যে, হাতে একটা ফোলানো বেলুন, মুখে বিজয়ীর হাসি। হয়তো অন্য কোনও বাচ্চার হবে, তার হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় উড়ে বেড়াচ্ছিল নিজের মতো। এর ঠিক নজরে পড়েছে। সব বিপদ অগ্রাহ্য করে দৌড়ে গেছে এবং নিয়ে ফিরেও এসেছে। ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করল। পারলাম না। আমার কোনও বাচ্চা-টাচ্চা নেই। অন্য কারুর ছেলেকেও কখনও মারিনি আমি। তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। মায়া হল।

হাতে টান পড়েছে যথারীতি, এগোচ্ছি অসহায় ভাবে। যাত্রাপাড়ার চড়া হোর্ডিংগুলো চোখে পড়ছে। এর আগে, বিডন স্ট্রিট পেরোনোর সময় মোড়ের মাথায় ভীষণ ভিড় ছিল। ছেলেটা ইশারা করায় তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। পেরোতেই আবার ইশারা, নামিয়ে দাও। দিলাম। রাস্তাতেও যাত্রার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বড় বড় ছবি দেওয়া সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে একটা ওর নাগালের মধ্যে। সামনে গিয়ে মুখগুলোর ওপরে দমাদ্দম চাপড় মারার পর হঠাৎ এক জন মহিলার ছবি দেখে থমকে গেল। হাত দিয়ে গলার ওপর একটু হাত বোলাল। তার পর দুম করে ছিঁড়ে দিল। ঝুলতে লাগল অভিনেত্রীর মাথা সহঅভিনেতাদের অদ্ভুত মুখের পাশে। কাদের পোস্টার কে জানে, বেপাড়ায় মার খাবার সম্ভাবনা আছে। তাও এমন এক জনের দুরন্তপনার জন্য, যে আমার কেউ হয় না। আমি কেন তার সঙ্গে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি তা-ও জানি না। বড়দের মতো তার কর্তৃত্ব মেনে চলেছি ছেলেমানুষের মতো। এই রাস্তা দিয়ে কত বার গেছি। কখনও উদ্দেশ্যহীন ভাবে, সময় কাটাতে হবে বলে। কখনও হনহনিয়ে, বিশেষ কোথাও যেতে হবে তাই। আজকের চলার চালটা অদ্ভুত, গন্তব্য এবং গতি ঠিক করছে এমন এক জন, যার মাথা আমার কোমরের নীচেই থেকে গেছে। পুজোর সন্ধেতে সে ধরে ফেলেছে ঠিক লোক যে তাকে সঙ্গে করে পৌঁছে দেবে তার নিজের গন্তব্যে। অন্য কেউ নয়, আমাকেই পাকড়েছে। ঠিক বুঝেছে যে এর আসলে বিশেষ কোথাও যাওয়ার নেই, কোনও কাজও নেই, সময়ও আছে। আর এই লোক ওকে ফেলে চলেও যাবে না। এ সব অবশ্য আমার নিজের ধারণা। আগে কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি, তাই কী করা উচিত বুঝতে না পেরে হেঁটেই চলেছি। বিপদে পড়লে যাকে ধরা যায় তার কথা মনে পড়ল, ফোন করলাম, চারপাশের আওয়াজের মধ্যেও হাত চাপা দিয়ে বোঝালাম কী হয়েছে। গালাগাল করল। তার পর কেটে গেল। ভয়ের চোটে আর ফোন করলাম না। হাতের ওপর টান সমানে পড়ছে, আগের মতো জেরে নয়, একটু হালকা। খোকার বাড়ি এসে গেছে নাকি? চিনতে পারছে? এত দূর চলে এসেছিল কী করে? অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। ছেলেটা হাত ছাড়িয়ে আবার দৌড়ে গেল বাঁক নেওয়া চকচকে ট্রামলাইনের দিকে, বেলুনটা আর দেখলাম না। মুখ ঘুরিয়ে দেখি ট্রাম এসে গেছে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমার কিছু করার ছিল না, ট্রাম নিজের মতো নিশ্চিন্তে বাঁক ঘুরে চলে গেল ভিড় কেটে। আমি ট্রামের পেছন দিক দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এ দিক ও দিক দেখতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম ওকে। ফুটপাতে বাঁশের ব্যারিকেডের তলা দিয়ে গলে সামনের গয়নাগাটির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন স্বপ্ন চোখ, গা ভর্তি সোনার গয়নাগাটি পরা একটা মেয়ের ছবি দেখছে কাচের পেছনে। গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। ছটফটানিটা যেন নেই আর। আবার আমার প্যান্টটা খামচে ধরল।

আমিও অপেক্ষা করতে লাগলাম ওর নির্দেশের। কেন জানি না, আমার আর টেনশন হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল একে আমি আগলে রাখতে পারব না, রাখার কথাও নয়। এ আমার নয়। কারুর নয়। সত্যিকারের রাস্তার ছেলে, এখানেই থাকবে। ঘুরবে-ফিরবে। যা খুশি তাই করবে। শাসন করবে সবাইকে। লাথি মারবে যেখানে সেখানে, কাউকে পরোয়া করবে না। সারা কলকাতা উঠবে বসবে থামবে চলবে শুধু ওর ইচ্ছেতে। মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম, কোনও আবেগ নেই, ছেলেমানুষির ছাপও নেই। শুধু সামনে তাকিয়ে থাকা আছে। দেখছে আর চলছে। তবে, এখন হাঁটছে দক্ষিণ দিকে মুখ করে। কে জানে কত দূর যাবে। একটু ক্লান্তও হয়ে পড়েছে বোধহয়। পা ফেলা দেখে তাই মনে হল। আবার একটা বেলুন বের করল পকেট থেকে, রঙিন নয়, সাদা, টানাটানি করল হাঁটতে হাঁটতে, অন্যমনস্ক ভাবে। ফোলাল না। পকেট থেকে আরও কী সব, এটা ওটা বের করে ফেলতে লাগল রাস্তায়, যেন আর কোনও টান নেই ও সবে। যখের ধন নয় ও সব। নেহাতই ফালতু আবর্জনা।

এ বার আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, রেড লাইট এরিয়া এসে গেছে, সবুজ, বেগুনি আলো চমকাচ্ছে যত্রতত্র। ওই আলোতে চান করছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নানা ধরনের মেয়েরা। হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব, কোনও অশান্তি নেই। পুজোর বাজার, সবাই খুশি। দুটো বাড়ির মাঝখানে একটু জায়গা, গলি বললে কম বলা হয়। ভেতরে নীল আলো, গোলাপি ছায়া, প্রচুর জ্যান্ত শরীর কী জানি কী করছে, তাকাতেই সাহস হয় না। তার মুখেই দাঁড়িয়ে পড়েছে ছেলেটা। আর আমার হাত ধরছে না। কিছুই বলছে না। আমিও তাই দাঁড়িয়ে আছি। তার পরেই একটা মোলায়েম ডাক, ‘কোথায় ছিলি রে সোনা আমার’— চুড়ি পরা এক জোড়া হাত ওকে তুলে নিল ফুটপাত থেকে। মিলিয়ে গেল রঙিন অন্ধকারে।

suvolama@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy