কলকাতায় দূরদর্শনের সূত্রপাত এবং প্রকাশক বিমল ধর ও প্রবীর দাশগুপ্তের উদ্যোগে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড-এর প্রতিষ্ঠা, দুটোই ১৯৭৫ সালে। পরের বছর থেকে গিল্ডের উদ্যোগে কলকাতায় বইমেলা শুরু হল। তখন ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠান শুরু করেছি, তাতে বইমেলা নিয়ে অনেক কিছু করতে লাগলাম। ক্রমে ছোটদের অনুষ্ঠান ‘চিচিং ফাঁক’, ‘হরে কর কম্বা’, যুব অনুষ্ঠান ‘তরুণদের জন্যে’ ও আরও নানা অনুষ্ঠানে বইমেলা জায়গা পেল। বইমেলা চলাকালীন গিল্ডের সুপ্রিয় সরকার মাঝে মাঝে ফোন করে বলতেন, আর একটা অনুষ্ঠান করে আবার বইমেলায় ভিড় বাড়িয়ে দাও।
বইমেলা তখন এখনকার মতো বিশাল, বাণিজ্যিক, ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো মেলা নয়। সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট সব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হত মেলাতে, তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা হত। অনেককে টালিগঞ্জে স্টুডিয়োতে নিয়ে আসতাম আমরা। অনেকের সাক্ষাৎকার, কবিতাপাঠ ইত্যাদি মেলার মাঠেই ফিল্ম ক্যামেরায় শুটিং করে নেওয়া হত। বাইরে শুটিং করার ইলেকট্রনিক ক্যামেরা তখনও আবিষ্কৃত হয়নি, তাই রিভার্সাল ফিল্মে ফিল্ম ক্যামেরায় শুট করে, ল্যাবে সেই ফিল্ম প্রসেস করে নিতে হত। মনে পড়ে, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষ সন্ধেবেলা মেলায় এসে হাঁকডাক করে বইমেলা জমিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের ডেকে বলছেন, এ দিকে নিয়ে এসো ক্যামেরা, আমার অনেক কিছু বলার আছে। সন্তোষদা ডাকছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের, টিভি ক্যামেরার সামনে এসে বলে যাওয়ার জন্য।
এক বার বইমেলা চলার সময় বিবিসি লন্ডনের এক কর্তা, জন রেনার, কলকাতায় এলেন। তাঁকে নিয়ে গেলাম বইমেলায়, বিখ্যাত সব মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে লাগলাম। বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মেলায় ঘুরে ঘুরে বই কিনছিলেন, তাঁর সঙ্গেও রেনারের আলাপ করিয়ে দিলাম। বিস্মিত জন টিভি ক্যামেরার সামনে বললেন, গুরুত্বপূর্ণ এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে বই দেখছেন, এমন দৃশ্যের কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
বিবিসি লন্ডনে প্রযোজকের চাকরি নিয়ে গেছি, ১৯৮৬ সালে জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফার্ট বিশ্ব বইমেলায় থিম নির্ধারিত হল ভারতীয় প্রকাশনা। কলকাতা বইমেলা কভারেজের অভিজ্ঞতার কথা জেনে বিবিসি আমাকে পাঠাল ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার কভার করতে। ফ্র্যাঙ্কফার্টে কলকাতার প্রকাশক সুপ্রিয় সরকার, প্রসূন বসু, আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু, সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। জমে উঠল আমাদের আড্ডা, সেই আড্ডা গড়াল লন্ডনে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত। ফ্র্যাঙ্কফার্টে সমরেশ বসু আমাকে বললেন, আমার তো এই প্রথম বিদেশে আসা, এর পর আমি লন্ডনে আসব, এক মাস তোমার বাড়িতে থাকব, লিখব আর আড্ডা দেব। আমরা সমরেশদার জন্যে ঘর সাজিয়ে রাখলাম, কিন্তু তাঁর আর লন্ডনে আসা হল না, তার আগেই তিনি চলে গেলেন অন্য এক লোকে তাঁর ঘর খুঁজে নিতে।
বিশ্ব বইমেলায় আমার শিক্ষক কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে পেলাম, তিনি জার্মানিতেই থাকেন। সে বারের বিশ্ব বইমেলায় ভারতীয়দের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন ও পরিচালনার বিশেষ দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। কিন্তু অলোকদার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি আপনাকে চিনি? তার পর একেবারে অচেনা মানুষের মতো আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে যেতে লাগলেন। বুঝলাম, লন্ডনে চাকরি নিয়ে এসে তখনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি বলে খুব অভিমান করেছেন। রফা হল, যদি তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়ে রাত্রিবাস করি, তবেই তিনি আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন।
গিল্ডের ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু দে’রা বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে আমার প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমাকে সম্মান জানানোর কথা জানান। সবিনয়ে বলি, ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে নয়, দূরদর্শনকে জানান এই সম্মান। দূরদর্শনের হয়ে সম্মান গ্রহণ করি যে সন্ধ্যায়, সে দিন আমরা, দূরদর্শনের কর্মীরা, খুব আনন্দ করেছিলাম। পরে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা চালু করতে পেরেছিলাম দূরদর্শনে। বইমেলাতে প্রথম দূরদর্শনের একটা স্টল করা হল। তখন ‘দূরদর্শন বিচিত্রা’ নামে একটি পত্রিকা বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় দুটি সংস্করণ সম্পাদনা করছিলাম। সেগুলি বিক্রি হতে লাগল। এখন তো বিভিন্ন টিভি চ্যানেল যেন বইমেলার দখল নিয়ে নেয়। মঞ্চে চলতে থাকে তাদের নানা অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, অডিশন, আরও নানা কাণ্ড। আমরা বইমেলাকে কখনও ব্যবহার করার কথা ভাবিনি। আমাদের বন্ধু বইমেলা বিকশিত হোক, এটাই ছিল আমাদের ভাবনা।
pankajsaha.kolkata@gmail.com