ওরা আসবে। ঝাঁকে ঝাঁকে। বাঁশগাছের সবুজপাতায় ঢেকে যাবে অনেকটা জায়গা। চার তলার জানলা দিয়ে নীচে তাকালে মাটি দেখা যাবে না। ঝাড়ের মধ্যে দু’একটা বাঁশ টুঙ্কাদের চার তলা ফ্ল্যাটের সমান লম্বা হবে। বাকি সাড়ে তিন তলার সমান। যেন একটা সবুজ পাহাড়।
ওরা আসবে ধৈর্য, সহ্য আর সুন্দরের দূত হয়ে। বাঁশের কঞ্চিতে কঞ্চিতে পাতার ফাঁকে ফাঁকে খুঁজবে বাসা বানানোর জায়গা। অনেকের জন্য অনেকগুলো বাসা গড়ে উঠবে। ওরা নিজেরাই বানাবে। যেন একটা আস্ত হাউজিং কমপ্লেক্স।
কেউ কারও সঙ্গে ঝগড়া করবে না। এক ফুট, দু’ফুট দূরে দূরে যে যার নিজের বাসায় ডিম পড়বে দুটো-তিনটে-চারটে। তার পর ডিমগুলোর ওপর সেই যে বসবে, দশ-পনেরো দিনের আগে আর উঠবে না। বাচ্চা না জন্মানো পর্যন্ত ওরা তা দিয়ে যাবে। ওদের দেখে মনে হবে যেন সবুজ পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা তুষার।
রোদের তেজ দিনে দিনে বাড়বে। কোনও কোনও দিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তবু ওরা ধৈর্য আর সহ্যের পরীক্ষা দিয়ে যাবে। ওদের সাদা পালকগুলো একটুও পুড়বে না। কোনও কোনও দিন ঝড় উঠবে। পাগলা হাতির মাথার মতো দুলবে পুরো বাঁশঝাড়টা। ওরা তবু ডাল থেকে পড়ে যাবে না। প্রাণপণে আগলে রাখবে ডিমগুলো। এক-একদিন বৃষ্টি হবে-হবে মনে হবে কিন্তু হবে না। গরম বাতাস আবার বইতে থাকবে। যেন স্টেশনে ট্রেনটা থামবে থামবে করেও থামবে না।
ইতিমধ্যে টুঙ্কাদের স্কুলে ছুটি পড়ে যাবে। সারা দুপুর ঘরের জানলা দিয়ে সে দেখবে সেই সবুজ পাহাড়ে এ-দিক ও-দিক ছড়িয়ে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা কাগজ। মায়ের মোবাইলে টুঙ্কা কয়েকটা ছবি তুলে রাখবে। কিন্তু বন্ধুদের দেখাতে পারবে না। মা মোবাইল নিয়ে যেতে দেবে না স্কুলে। ছবি দেখাতে না পারুক, গল্প শোনাতে তো পারবে। অনিশা-ডোনা-সৃজিতারা অবাক হয়ে শুনবে। শুচিতার হয়তো সন্দেহ হবে। বলবে, হাওড়াতে আমাদের বাড়ির আশেপাশেই বাঁশঝাড় নেই, আর তোদের খোদ কলকাতাতে এত বড় বাঁশবাগান!
অনিশা প্রতিবাদ করে বলবে, টুঙ্কাদের বাড়ি আমি গেছি। ওদের বাড়িটা কলকাতার দক্ষিণে পাটুলি উপনগরীতে। সত্যিই ওদের হাউজিং-এর পেছনে বিরাট বাঁশঝাড় আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। টিফিনের সময় মার বানিয়ে দেওয়া কেকের একটা টুকরো দিতে দিতে টুঙ্কা হয়তো অনিকে বলবে, তুই আমার সত্যিকারের বন্ধু।
কোথা থেকে আসে ওরা? ডিম ফুটে ছানা হতে এত দিন সময় লাগে কেন? ওরা কখন খায়? কী খায়?
প্রশ্নে প্রশ্নে মা-বাবাকে অস্থির করে তুলবে টুঙ্কা। মা শান্ত ভাবে যথাসাধ্য উত্তর দেবে। সব শেষে বলবে, ওরা কত কষ্ট করে বল তো! বুঝলি টুঙ্কা, ওরা বক, আর তুই হলি আমাদের বকবক রানি।
ডিম ফুটে ছানা বেরবে একে একে। একটু যেই বড় হবে আশপাশের ঝিল থেকে মাছ নিয়ে আসবে ছানাদের বাবারা। বাবারা কোথায় ছিল এত দিন? কী করে খবর পেল ছানা জন্মানোর? কোনগুলো নিজের ছানা কী করে চেনে ওরা? সব ছানাই তো দেখতে এক রকমের। ছোট ছোট মাছ মুখে করে এনে বাবারা দেবে মাদের মুখে। তার পর মায়েরা মোলায়েম করে নিয়ে ঠোঁট দিয়ে খাওয়াবে ছানাদের। কী জানি, কাঁটা বেছে দেবে কি না। টুঙ্কাকে মা তো মাছের কাঁটা বেছে দেয়। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে টুঙ্কার মনে হবে, কত দিন মা তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয় না। মনে হতেই আবদার জুড়বে, মা, আজ তুমি খাইয়ে দাও না! আমি নিজের হাতে খাব না। মা বলবে, টুঙ্কা তুমি বড় হয়েছ, এ রকম বায়না কোরো না, আমার অনেক কাজ। অবশেষে হার মেনে সে দিনের মতো মা খাইয়ে দেবে তাকে।
দেখতে দেখতে ছানাগুলো বড় হবে। এ-কঞ্চি থেকে ও-কঞ্চিতে পড়ি-পড়ি করে উড়ে বসবে। টাল সামলাতে হিমশিম খাবে। তবু কোনও অঘটন ঘটবে না। আর একটু বড় হলে চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করে দেবে। টুঙ্কা দেখতে পাবে ওদের মুখের ভিতরের লাল রং। দিনে দিনে ওরা আরও বেশি দূরে উড়তে চেষ্টা করবে, বাড়তে থাকবে ওদের সাহস।
এক দিন বৃষ্টি নামবে। বাচ্চা-বড় সবাই মিলে ওরা ভিজবে। টুঙ্কার স্কুল খোলার সময় হয়ে আসবে। তার পর টুঙ্কা এক দিন দেখবে ওরা কেউ নেই। কোথায় যেন উড়ে চলে গেছে। বাঁশঝাড়ের ওপর পড়ে আছে কতগুলো ছিন্নভিন্ন বাসা, যেগুলো বানানো হয়েছিল খড়কুটো দিয়ে। টুঙ্কার কান্না পাবে না। সে জানবে এমনই হয়। গত বছরেও হয়েছিল। আসছে বছরেও হবে। হঠাৎ তার মনে হবে মায়েরা কত কষ্ট সহ্য করতে পারে, কত ধৈর্যে ছানাদের বড় করে। এ কথা মনে হতেই টুঙ্কা ছুট্টে গিয়ে মাকে জাপ্টে ধরবে। মা বলবে, কী হল সোনা! টুঙ্কা বলবে, মা, তুমি না খু-উ-ব ভাল!