Advertisement
E-Paper

ভোটের কালি

সুস্নাত চৌধুরীজেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইংক থেকে ভুসো হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। এই কালি বানানোর অথরিটি রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু-একটি সংস্থার হাতেই। তার মধ্যে প্রধান: মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০০:০০

জেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইংক থেকে ভুসো হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। এই কালি বানানোর অথরিটি রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু-একটি সংস্থার হাতেই। তার মধ্যে প্রধান: মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ভোটের কালি নির্মাতা। এ বারের লোকসভা ভোটেও সারা দেশে কালি সাপ্লাই করেছে কর্নাটকের এই সংস্থাটিই।

মহীশূরের এক কোণে ১৬ একর জায়গা জুড়ে এই কারখানা। ১৯৩৭ সালে মহীশূরের রাজপরিবারের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহীশূরের তখনকার মহারাজা শিল্পোদ্যোগী ছিলেন, তিনি ঠিক করলেন, আশপাশের জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে বড়সড় আকারে মোম উত্‌পাদন করতে হবে। এক কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হল ‘মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি’। সেই মোম তৈরির ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। ব্যালটে ভোট হলে, ব্যালটবাক্স সিল করার সময়ও এই কারখানার মোমই ব্যবহার করা হত। আজও রোজ রাতে কারখানা বন্ধের সময় তালা দিয়ে সেই নিজেদের বানানো মোমেই সিল করা হয়। ১৯৪৭ সালে কর্নাটক সরকার সংস্থাটি অধিগ্রহণ করে। শুরু হয় রং উত্‌পাদনও। সংস্থাটির নতুন নাম হয় ‘মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস লিমিটেড’। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু পরিবর্তন। তার পর থেকে ‘মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড’ নামেই এটি পরিচিত। এখন মোম ও নানা ধরনের রং ছাড়াও পালিশ, প্রাইমার, ডিস্টেম্পার, সিন্থেটিক এনামেল ইত্যাদি তৈরি হয় এখানে। রীতিমত লাভজনক একটি পাবলিক সেক্টর কোম্পানি। তবে আজও এটি সবচেয়ে বেশি লাভ করে ভোটের কালি থেকেই।

১৯৬২ সালে, দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে, প্রথম ব্যবহৃত হয় ভোটের কালি। সেই শুরু ইনডেলিব্ল ইংক প্রস্তুতি। তার পর দেশ জুড়ে লোকসভা, বিধানসভা বা স্থানীয় নির্বাচনে নিরন্তর কালি জুগিয়ে আসা। দিন যত গড়িয়েছে, ভোটার তত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাভও। গড়পড়তা একটা হিসেব বলছে, দেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ৬০০ কোটি ভোটারের হাতে দাগ ফেলেছে এই কালি। আর বিদেশেও এই সংস্থার কালি হাতে-মাখা ভোটারের সংখ্যাটা কম নয় ৪০ কোটি। হ্যঁা, বহু দেশে ভোটের কালি রফতানি হয়েছে, হচ্ছেও, এই সংস্থা থেকে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা মায় বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে ভারত। তার ঠিকানা কখনও কম্বোডিয়া, কখনও আফ্রিকার লিসুটু।

ক’দিন আগে পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়ার সময় পাননি এই কারখানার দুই শতাধিক কর্মচারী। ওভারটাইম করে সামলাতে হচ্ছিল চলতি লোকসভা ভোটের জন্য কালি তৈরির কাজ। এক দফায় এত কালি এর আগে কখনও লাগেনি। দেশে এ বার মোট ভোটার ৮১ কোটিরও বেশি। ওয়েস্টেজ ধরে অর্ডার ছিল প্রায় ২২ লক্ষ কৌটো কালির। দশ মিলিলিটারের একটি পাত্রের দাম দেড়শো টাকার কাছাকাছি মানে, প্রায় ৩১ কোটি টাকার বিক্রি।

২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় ২০ লাখ কৌটো কালি। কৌটোগুলি ছিল এ বারের মতোই দশ মিলিলিটারের। কিন্তু ২০০৪ সালে কালির বরাত ছিল অনেক কম। পাঁচ মিলিলিটারের ছোট কৌটো সে বার গিয়েছিল ১৭ লাখ মাত্র। শুধু ক্রমবর্ধমান ভোটারের সংখ্যা নয়, এই হিসেব আসলে নির্ভর করে কালি লাগানোর পদ্ধতির উপর।

২০১৪-র এই লোকসভায় দশ মিলিলিটারের একটি কৌটো খুললে গড়ে ৫০০ জনের হাতে কালির দাগ পড়বে বড়জোর। কিন্তু আট-ন’বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না। মনে করে দেখুন, তখন ভোট দিলে তর্জনীর নখ আর ত্বকের সন্ধিস্থলে একটি আড়াআড়ি দাগ পড়ত। আর এখন পড়ে লম্বা একটি দাগ, তর্জনীর প্রথম গাঁটটির আগের চামড়া থেকে নখের উপরিভাগ পর্যন্ত। স্বভাবতই কালি লাগে বেশি। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন এই নতুন নিয়ম চালু করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এ কালির প্রয়োজনও তাই এক লাফে এতটা বেড়ে যায়।

শুধু সময়ের সঙ্গেই নয়, রাষ্ট্র ভেদেও এই হিসেব বদলায়। কারণ, কালি লাগানোর পদ্ধতি এক এক দেশে এক এক রকম। ভারতে কালি লাগানো হয় কাঠি জাতীয় কোনও বস্তুর সাহায্যে। আফগানিস্তানে ভোটের কালি লাগানো হয় মার্কার পেন দিয়ে, এতে কালি খরচ কম হয়। কম্বোডিয়া বা মালদ্বীপে গোটা তর্জনীর উপরিভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয় কালিতে। আফ্রিকার কোনও কোনও দেশ, যেমন বুরকিনা বা বুরুন্ডিতে, ভোটের কালি লাগাতে ব্যবহার করা হয় ব্রাশ। তুরস্কে নজ্ল থেকে কালির ফোঁটা ফেলা হয় আঙুলে।

কী থাকে ভোটের কালিতে? কেন তা কিছুতেই মোছে না? গোটাটাই রসায়নের খেলা। কিন্তু ধাঁ করে পুরো ইকুয়েশনটা বলে ফেলা সম্ভব নয়! ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি এই সিক্রেট ফর্মুলা তুলে দেয় মহীশূরের ওই কালি নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। আজও তা গোপনই রয়েছে। দু’এক জন বাদে সংস্থার কর্মীরাও পুরোপুরি জানেন না, আসলে ঠিক কী করে তৈরি হয় এই কালি। তবে, সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, এই কালি আসলে রুপোর এক রাসায়নিক পদার্থ (সিলভার নাইট্রেট বা AgNO3) আর পাতিত জলের মিক্সচার। সঙ্গে কিছুটা অ্যালকোহল, যাতে চট করে শুকিয়ে যায় কালিটি। আর থাকে বিশেষ কিছু রং। এখন, এই সিলভার নাইট্রেটই হচ্ছে আসল মক্কেল! চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সে ফেলে বিশেষ এক প্রকার অধঃক্ষেপ, যা এক্কেবারে সেঁটে যায় চামড়ার সঙ্গে। সিলভার নাইট্রেটের আধিক্য যত বেশি থাকবে, তত টেকসই হবে কালি। আমাদের দেশে সচরাচর ১৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকে সিলভার নাইট্রেটের ঘনত্ব, তাতে হপ্তা তিনেকের জন্য নিশ্চিন্তি! আর, কালি লাগানোর পর এক ছটাক অতিবেগুনি রশ্মি যদি তার উপর পড়ে, তবে তো রুপোয় সোহাগা! বেগুনি কালি রং বদলে কালচে-বাদামি হয়ে আরও চিপকে বসে আঙুলে।

তবে ভোটের কালির রংবাজি যে শুধু বেগুনিতেই, তা নয়। বিরল হলেও, অন্য রঙের ভোটের কালিও দেখা যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার সুরিনাম দেশটিতে এই কালির রং কমলা। ভোটারদের আকর্ষণ করতে একদা ডাচ কলোনি সুরিনামের জাতীয় রঙের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই রং বদল।

অসত্‌ ভোটার এই ভোটের কালি মোছে কী করে? কেউ আসল কথাটা বলে না, শুধু বাতাসে ফিসফিস করে ঘুরে বেড়ায় সব টোটকা। কেউ বলে, পাতি টুথপেস্ট লাগিয়ে ১৫ মিনিট রাখতে হয়, তার পর দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আলতো ঘষলেই রং হাওয়া। অথবা, খানিক দুব্বোঘাস তুলে তার রসটুকু লাগাতে হবে, তাতেই নাকি কালির জারিজুরি শেষ! কারও প্রেসক্রিপশন পেঁপেগাছের দুধ-রস, কখনও ব্লিচিং পাউডার আর ফিনাইলের মিক্সচার! কারও মতে, এক টুকরো সিরিশ কাগজ নিয়ে বার কয়েক ঘষলেই হল! কেউ বাতলাবে, দেশলাই কাঠি জলে ভিজিয়ে শুধু তার বারুদটুকু কালির ওপর ঘষতেই হবে একশো আট বার। অবশ্য অনেক সর্বজ্ঞ বলবে, আরও আগে থেকে নাকি মাঠে নামতে হয়! মানে, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই হাতে স্বচ্ছ নেলপালিশ বা গঁদের আঠা লাগিয়ে নিতে হবে। তাতে একটা আস্তরণ পড়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। তার পর ভোট দিয়ে বেরিয়ে নেলপালিশ রিমুভার দিয়ে বা এমনিই ঘষে-ঘষে তুলে ফেললেই হল। ব্যস, হাত ধুয়ে আবার দাঁড়িয়ে যাও!

ভোটের কালি নিয়ে নানা বিচিত্র সমস্যা ঘুরেফিরে আসে। এ বারই অন্ধ্র প্রদেশে ৩০ মার্চ থেকে ৭ মে-র মধ্যে অনেকগুলি ভোট হচ্ছে। ৩০ মার্চ ১৫৬টি জায়গায় পুরভোট হয়েছে, মাঝে পঞ্চায়েত ভোট, আবার ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর নির্বাচন পড়ায় অনেকেই ঘোর দুশ্চিন্তায় লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে যদি পুর বা পঞ্চায়েত ভোটের কালি আঙুল থেকে না ওঠে, তা হলে কী হবে? আবার, ২০০৮-এ মালয়েশিয়ায় ইলডেলিব্ল ইংক চালু করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও, নির্বাচনের চার দিন আগে তা বাতিল করতে হয়। কারণ, শেষ বেলায় চোখে পড়ে, তখনও সে দেশের সংবিধানে এই আইনটিই হয়নি: কারও হাতে ভোটের কালি থাকলে সে আর ভোট দিতে পারবে না! আবার জিম্বাবোয়েতে দেখা গিয়েছে, ভোটের পরে কারও হাতে কালির দাগ না থাকলে মিলিটারিই অত্যাচার চালিয়েছে। ভোট দাওনি কি মরেছ, সিধে কথা! বাংলাদেশে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর নাকি উলটো ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের হাতে কালির দাগ রয়েছে, তাঁদেরই উপরই চলেছে নির্যাতন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তীসগঢ়ের বহু মানুষই যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভোটের পর তাঁদের আঙুলে যাতে কালি না লাগানো হয়। কারণ, মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে তাঁরা যে সাড়া দেননি, তা বোঝা গেলে কপালে ঢের দুঃখ!

তার চেয়ে সকাল সকাল ভোট দিন। আপনি পাতি ভোটার, প্রতিশ্রুতিমাফিক ভোটের পর আর কিছু পান না-পান, দু-তিন সপ্তাহের জন্য কালির গ্ল্যামারটুকু আপনার আঙুলে জ্বলজ্বল। দিনভর, সপ্তাহভর গণতন্ত্রের স্মৃতি রোমন্থন করুন। দেখুন, দেখান। কক্ষনও ভাববেন না যে গণতন্ত্র আপনাকে প্রতারক ভেবেছে, কক্ষনও ভাববেন না যে আপনি ফের এসে ভোট দিতে পারেন সন্দেহ করে আপনার আঙুলে গণতন্ত্র কালি মাখিয়েছে। কেবল ভাববেন সেই বছর চারেকের বুদ্ধু ছেলেটির গপ্পো। মায়ের কোল থেকেই যে হেবি রেলায় চেঁচাচ্ছিল, ‘এইযো...আমি ভোট দিয়েছি’! তার কচি হাতে তখন ইনডেলিব্ল ইংক। পিছনে পাল্স পোলিয়ো-র ব্যানার।

susnatoc@gmail.com

আঙুলে ভোটের কালি মাখা সেলেব্রিটিদের ছবি দেখতে, অ্যাপ্ল অ্যাপ স্টোর (আই ফোন)
অথবা
গুগল প্লে স্টোর (অ্যান্ড্রয়েড) থেকে ABP AR App-টি ডাউনলোড করে এই ছবিটি স্ক্যান করুন।

election voter khali susnata choudhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy