Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভূপেনদা গাইলেন, রুমাদি চাবি বাজালেন

১৯৭৫ সাল, কয়েক দিন আগেই কলকাতায় টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়েছে। অসমে ফোন করে ভূপেন হাজারিকাকে জানালাম, সারা পৃথিবীর লোকসংগীত নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে মানুষের ঐক্যের দিকটা তুলে ধরতে চাই, আপনাকে আসতেই হবে।

ভূপেন হাজারিকা গাইছেন, বিশ্বভারতীর ছাত্রীরা বিহু নাচছেন। দূরদর্শনের ‘নববর্ষের বৈঠক’।

ভূপেন হাজারিকা গাইছেন, বিশ্বভারতীর ছাত্রীরা বিহু নাচছেন। দূরদর্শনের ‘নববর্ষের বৈঠক’।

পঙ্কজ সাহা
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

১৯৭৫ সাল, কয়েক দিন আগেই কলকাতায় টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়েছে। অসমে ফোন করে ভূপেন হাজারিকাকে জানালাম, সারা পৃথিবীর লোকসংগীত নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে মানুষের ঐক্যের দিকটা তুলে ধরতে চাই, আপনাকে আসতেই হবে। কলকাতায় ভূপেনদার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, ‘লোকসংগীতের আপন ঐতিহ্য, ভূপেন হাজারিকার আপন ভুবন’ অনুষ্ঠানের নাম ভেবেছ বলেছিলে, আমার গাওয়া পুরনো গানের কথা তুলেছিলে, এই নাও অসমিয়া দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম ‘ইন্দ্রমালতী’, এই ছবিতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আমি ছিলাম গায়ক-অভিনেতা, ‘বিশ্ব নিজয় নজোয়ান’ গানটা গেয়েছিলাম, শুনে দেখো, ওই বয়সে খুব খারাপ গাইনি কিন্তু! বলে ফিল্মের ক্যান হাতে দিলেন।

টালিগঞ্জে তাঁর বাড়িতে বসে গল্প করতে করতে ঠিক করা হচ্ছে কোন কোন গান থাকবে। ভূপেনদা হারমোনিয়াম নিয়ে বসে প্রাদেশিক একটা লোকগান খানিকটা গেয়ে বলছেন, দ্যাখো ল্যাটিন আমেরিকার একটা গানের বিষয়ের সঙ্গে কেমন মিল এই গানটার! অথবা ভোজপুরি একটা গানের সারল্য আর মজার সঙ্গে একটা বিদেশি ফোক মিউজিকের মিলের দিকটা গেয়ে শোনাচ্ছেন। আমার মাথায় হঠাৎ একটা আইডিয়া এল। বললাম, ভূপেনদা, এই যে আপনি গল্প করতে করতে নানা গানে যাতায়াত করছেন, এই ভাবেই অনুষ্ঠানটা করি না? তখন শিল্পীরা শুধু বসে বসে গান গাইতেন। ভূপেনদা বললেন, সে কী, লোকে রেগে যাবে না তো! বললাম, দেখাই যাক না একটা পরীক্ষা করে। ভূপেনদা হাসতে হাসতে বললেন, দেখো যেন মারধর না খাই!

ঠিক হল রুমা গুহঠাকুরতা ভূপেনদার সঙ্গে অনুষ্ঠানে গল্প করবেন। ভূপেনদার ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ গানটা যখন যাবে, গঙ্গা-পদ্মার দৃশ্য দেখানো হবে, আর উত্তর-পূর্ব ভারতের গানের সঙ্গে সেখানকার প্রকৃতির দৃশ্য। এগুলো তখন নতুন ব্যাপার, এখন তো টিভিতে জলভাত। অনুষ্ঠানে ভূপেনদা অসামান্য গাইতে লাগলেন, ‘উই আর অন দ্য সেম বোট ব্রাদার’। রুমাদির কাছে তাঁর বাড়ির চাবির গোছা ছিল, সেটা হাতে নিয়ে বাজাতে বাজাতে রুমাদিও গানে যোগ দিলেন। বাজিয়েরা উদ্বেলিত হয়ে বাজাচ্ছেন, আমরা প্রযোজনার কর্মীরাও আপ্লুত। রেকর্ডিং শেষ হতেই সহকর্মীরা আনন্দে আমাকে কাঁধে তুলে নিল। খুব জনপ্রিয় হল অনুষ্ঠানটা।

এখন তো অনেক টিভি চ্যানেলেই আড্ডার সঙ্গে গানের অনুষ্ঠান দেখি, ওই অনুষ্ঠানেই কিন্তু ওটার শুরু। এর পরে এক দিন দুপুরে ভূপেনদা একটা রেকর্ড হাতে নিয়ে আমাদের কেন্দ্রে এসে বললেন, অনুষ্ঠানের সঙ্গে যারা ছিল তাদের ডাকো, মিষ্টি খাওয়াব। জানো তো, ওই টিভি প্রোগ্রামটার মতো করেই এখন নানা অনুষ্ঠানে গল্প করে করে গাইছি, লোকে খুব নিচ্ছে। ওই অনুষ্ঠানের আইডিয়ায় মূল গানগুলো নিয়ে একটা রেকর্ড করেছি, বলে আমার হাতে তুলে দিলেন ‘আমি এক যাযাবর’ রেকর্ডটি। বললেন, তুমি আমাকে আবার বাংলায় ফিরিয়ে দিলে, যখনই কোনও কাজে ডাকবে, আসব।

পরে, উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ কাজ ‘এয়ার মেনটেন্যান্স’ নিয়ে একটা ফিল্ম ন্যাশনাল প্রোগ্রামে যাবে, ভূপেনদাকে সংগীত পরিচালনার জন্য অনুরোধ করলাম। খুব ব্যস্ত তিনি, তবু কলকাতায় এলেন। আমি গান লিখেছিলাম এই ছবির জন্য, প্রফেসর পি.লাল খুব সুন্দর অনুবাদ করে দিলেন স্টুডিয়োতে বসেই। ভূপেনদা এসে সেই গানগুলো সুর দিচ্ছেন আর কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না, বারবার সুর বদলাচ্ছেন। পি.লাল বললেন, মনে হয় এখানে আমরা ক’জন ইমপসিব্ল পারফেকশনিস্ট একত্র হয়েছি!

এর পর বীরভূমের নানা গ্রামকে কেন্দ্র করে একেবারে পরীক্ষামূলক ‘নববর্ষের বৈঠক’-এ ভূপেনদাকে অংশ নিতে অনুরোধ করলাম, উনি মুম্বই থেকে উড়ে এলেন। চৈত্রের প্রখর গ্রীষ্মে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়ি ভাড়া করে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে এসে একটা ভাল হোটেলে উঠলেন, সবই নিজের খরচে। শুটিং স্পটে এসে যোগেশ দত্তকে দেখে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, আমাকে মূকাভিনয় শেখাবেন? ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বললেন, আমার কীর্তন খুব ভাল লাগে, যদি আপনার ছাত্র হতে পারতাম! কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে বললেন, ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’ গানটা একটু শোনাবেন আমাকে? বিশ্বভারতীর অসমের ছাত্রছাত্রীরা বিহু গান ও নাচের অনুষ্ঠান করবে জেনে বললেন, আমি গাইব ওদের নাচের সঙ্গে, তা না হলে ওরা মুডই পাবে না! যখন কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন, বললাম, সরকারি নিয়মমতে যে সম্মানদক্ষিণাটুকু, তার বাইরে তো আর কিছুই দিতে পারলাম না! বললেন, ‘কিন্তু যে আনন্দটা পেলাম!’ খোলা গলায় ‘জীবন খুঁজে পাবি’ গাইতে গাইতে গাড়িতে উঠে পড়লেন।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pankaj saha doordarshan anandabazar rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE