দুপুরে খেয়েদেয়ে জামাজুতো পরে সায়ক বেরিয়ে পড়ল। গত কাল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কাজেই আজ থেকে সে অ্যাডাল্ট, এত দিন সে মা বা বাবার সঙ্গে মামার বাড়ি গিয়েছে, আজ একা যাবে, দিন কয়েক থেকে হুটোপাটি করে আসবে সেখান থেকে।
গত বারে মামার বাড়িতে গিয়ে বিশাল একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর দেখেছিল, নাম তার রাজা, ভারী মজার কুকুর। দিনের বেলা আচার-ব্যবহার তার অতি ভদ্র ও অমায়িক, হাঁকডাক করা দূরে থাক, কারও দিকে মুখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত, নেড়ি কুকুরের মতো ল্যাজে মুখ গুঁজে পড়ে পড়ে ঘুমোয়, কেউ আদর করলে সুন্দর অ্যালাউ করে, চটকালেও নীরবে সহ্য করে, একমাত্র লেজ ধরে টানলেই মুখটা তোলে সে, কাতরমুখে যেন বলতে চায়, ‘প্লিজ, ল্যাজটা ছেড়ে দাও, লাগছে।’
কিন্তু সন্ধ্যা ঘনালেই এই রাজার মূর্তিই আলাদা, কুকুর থেকে এক লহমায় বাঘ হয়ে যায়, ছপছপ করে সারা বাড়ি টহল দিয়ে বেড়ায় আর থেকে থেকে এমন এক একখানা হাঁক ছাড়ে প্রাণ উড়ে যায়। তখন বাড়ির লোকরাও তার ধারেকাছে ঘেঁষতে ভয় পায়। এ যেন গল্পের অবিকল সেই মিস্টার জেকিল আর মিস্টার হাইড।
বাড়ি থেকে বেেরাতেই একটা বাস পেয়ে গেল সায়ক, বাসে উঠেই উল্লাসে তার প্রাণ নেচে উঠল, সামনের দিকে একটা সিট খালি। দূরপাল্লার গাড়িতে এই ভাবে সিট পাওয়া আর লটারির টিকিট পাওয়া এক কথা। পাছে পেছনের সিট থেকে কেউ উঠে এসে জায়গাটা দখল করে, সে ছুটে গিয়ে সিটে বসতেই পাশের দাড়িওয়ালা যাত্রীটি মন্তব্য করল, ‘ভাগ্য ভাল তোমার।’
ভাগ্য ভাল কি না বলতে পারে না, তবে সময়টা এখন তার ভালই যাচ্ছে। পরীক্ষা ভালই হয়েছে, রেজাল্ট ভালই হবে, ভাল কলেজেই ভর্তি হবে, মামার বাড়ি যাচ্ছে, তিন জোড়া মামা-মামির আদর খেয়ে আর সারাদিন ধরে রাজার সঙ্গে খুনসুটি করে সময়টাও ভালই কাটবে বলে তার বিশ্বাস। এখন শুধু জানলার ধারের সিটটা পেলেই ষোলো কলা পূর্ণ হয়। সে ‘হুঁ’ বলে ঘাড় নেড়ে ভাল ছেলের মতো মুখ করে লোকটিকে বলল, ‘ধুলোরহাট এলে একটু বলে দেবেন, কাকু?’
‘ধুলোরহাট? সে তো বিস্তর রাস্তা গো!’ লোকটি বলল, ‘আমি তো দু’স্টপ পরে কাদাপোতাতে নেমে যাব।’
উল্লাসে আবারও প্রাণ নেচে উঠল সায়কের, মাত্র দু’স্টপ পরেই আস্ত একটা জানলার মালিক সে! সময়টা সত্যিই আজ তার বেজায়ই ভাল।
কাদাপোতায় দাড়িওয়ালা যাত্রী নামতেই জানলার সিটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সায়ক, চলন্ত গাড়ি থেকে চার পাশের দৃশ্য আর মনোরম বাতাস একসঙ্গে গিলতে শুরু করল।
বেশ কিছু রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ বিশাল এক হ্যাঁচকা দিয়ে বাস দাঁড়িয়ে গেল। বাসের টায়ার ফেটেছে, মেরামত করতে সময় লাগবে।
তা লাগল। বাসের ক্লিনার-কনডাক্টর-ড্রাইভার আর কিছু প্যাসেঞ্জার মিলে ঘণ্টাখানেেকর চেষ্টায় টায়ার বাগে এল, ড্রাইভার সিটে গিয়ে বসল, হুড়মুড় করে সকলে ছুটল, নড়েচড়ে উঠল বাস। কিন্তু এক ঘণ্টাও গড়াল না, আবার কোণঠাসা বেড়ালের মতো রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে জখম টায়ারবাবাজি দেহ রাখল, বাস একটু এগিয়ে এক দিকে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জানা গেল আর সারানো যাবে না, গ্যারাজে নিয়ে যেতে হবে টায়ার।
শুনে বাসের প্যাসেঞ্জাররা বাসকোম্পানির শ্রাদ্ধ করতে করতে লাগিয়ে দিল হাঁটা। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে তাদের সঙ্গে জয়েন করল সায়কও। তার ‘ভাল সময়’-এর নিকুচি করেছে!
তার পর হাঁটছে তো হাঁটছেই, কোথায় পরের বাস, কোথায় ধুলোরহাট? কারও টিকির পাত্তা নেই। এ দিকে সময় বুঝে মোবাইলেও চার্জ চলে গিয়েছে, মামাদের একটা ফোন করে দেবে উপায় নেই। দেখতে দেখতে রোদ্দুর নিভে এল, সূর্য টা-টা করতে করতে টপাস করে পাটে বসে গেল, যাত্রীদের মিছিল আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে আসছে, কিন্তু পথের আর কুলকিনারা করতে পারছে না সায়ক।
তবে ভাল সময়ের মতো খারাপ সময়েরও শেষ আছে। সায়কেরও হল, এক সময় শেষ হয়ে গেল রাস্তা, দূর থেকে তাল-নারকেল-সুপারি গাছে ঘেরা কাঁচাপাকাবাড়িময় ধুলোরহাটের বাসস্টপটা চোখে পড়তেই মনে মনে বলল, ‘যাক বাবা পৌঁছে গিয়েছি, আর দশ মিনিট।’
কিন্তু ওই দশ মিনিটটাই যে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দশ মিনিট হয়ে আসবে, কে জানত! ধুলোরহাটে পৌঁছে সবে মামার বাড়ির দিকে হাঁটা লাগিয়েছে ঝপ করে সন্ধে নেমে এল। তার সঙ্গেই যেন তাল মিলিয়ে তার মনে পড়ে গেল রাজার কথা। সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে এখন রাজার বীরবিক্রমে জেগে ওঠার সময়! ওর মুখে গিয়ে পড়লে আর দেখতে হবে না। কে এই বাড়ির আদরের ভাগনে কে বাইরের লোক দেখবে না, ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি ছিঁড়ে নেবে মিস্টার হাইড।
ভাবতে ভাবতে পা অনড় অচল হয়ে গেল সায়কের, ভাবতে লাগল, কী করবে? কিছু ক্ষণ ভাবার পর মাথায় একটা বুদ্ধি এল তার। মনে হল, এক কাজ করলে হয়, ভালমন্দ খাইয়ে রাজার মুখ বন্ধ করে দিলে হয়। খাবারের কাছে সবাই জব্দ। এক ভাঁড় মাংস পেলেই চেটেপুটে খাবে, তার টুঁটি ধরা দূরে থাক, উলটে ‘থ্যাঙ্কস’ বলে লেজ নেড়ে স্বাগত জানাবে সায়ককে।
ভাবামাত্র আবার ব্যাক টু ধুলোরহাট, ধুলোরহাটে একটাই হোটেল, কিন্তু তাতে মাংস নেই মাছ আছে। অগত্যা রুই মাছের ঝোল এক ভাঁড় কিনে সবে দুরুদুরু বুকে মামার বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ভাবছে রাজা তেড়ে এলে একদম ঘাবড়াবে না, দরদি গলায় চুকচুক করে কাছে ডেকে মাছের ভাঁড়টা ধরিয়ে দেবে তাকে, কিন্তু কোথায় রাজা? তার বদলে ভেতর থেকে বড়মামার বাজখাঁই গলা পাওয়া গেল, ‘কে রে চোরের মতো উঁকি মারে? অ্যাই কে তুমি?’
সায়ক গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলল, ‘আমি মামা, সায়ক।’
বড়মামা বাইরের লাইটটা জ্বেলে তাঁর বিশাল ভুঁড়ি বাগিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন, সায়ককে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন, ‘এত দেরি করলি কেন? তোর মা তো ফোন করে করে অস্থির। একটা ফোন করতে কী হয়?’
কিন্তু সায়কের তখনও বুক ঢিপঢিপ করছে, মোবাইলে চার্জ ছিল না জানিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করল, ‘রাজা কই?’
‘রাজা? ওকে বিদেয় দিয়েছি, সারারাত এত উৎপাত করত ঘুমোতে পারতাম না। তোর মামির বাপের বাড়ির লোক নিয়ে গিয়েছে।’ বলতে বলতে বড়মামার নজর গেল সায়কের হাতের দিকে, ‘হ্যাঁ রে, হাতে ভাঁড়ে কী তোর?’
কী আর, রুই মাছের ঝোল! কিন্তু যার জন্য কিনে আনা, সে-ই তো নেই! মনটা খারাপ হয়ে গেল সায়কের, রাজার জন্য কত আশা করে এসেছিল! খারাপ সময়টা সত্যিই পিছু ছাড়ছে না! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে একটা হুলোবেড়াল ঘরের ভেতর থেকে তিরবেগে বেরিয়ে এল, তার পর সায়কের ভাঁড়ের চার পাশে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে লাগল আর বিকট লোভী গলায় ম্যাও ম্যাও করতে থাকল। মাছের গন্ধ পেয়েছে।
‘এটা আবার কে?’ সায়ক তাকাল বড়মামার দিকে।
‘এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবি না ঘরে যাবি?’ বলেই বড়মামা একগাল হেসে বললেন, ‘রাজা চলে যেতে বড্ড মন কেমন করছিল সকলের, তাই এটাকে ক’দিন ধরে পুষেছি। এর নাম মুকুন্দরাম, আমরা ডাকি মুকু।’
সঙ্গে সঙ্গে মনের ভাব বদলে গেল সায়কের। রাজার জন্য মুষড়ে পড়েছিল, এ তো আরও এককাঠি ওপরে, চটকানোর পক্ষে, আদর করার পক্ষে কুকুরের চেয়ে বেড়াল অনেক ভাল, অনেক নরম। তার চেয়েও বড় কথা, কুকুরের চেয়ে বেড়াল মাছের অনেক ভাল সমঝদার। যাক পয়সাটাও নষ্ট হয়নি দেখছি। কে বলে তার সময় খারাপ?
সায়ক মাছের ভাঁড়টা মুকুর মুখের সামনে নামিয়ে হেসে ফেলল, বলল, ‘কার জিনিস কে খায়! খা রে মুকুন্দরাম, ভাল করে খা!’