নামের লিস্টের ওপর চোখ বুলিয়ে ‘বিয়ানপুর ব্যায়ামবীর সমিতি’র সেক্রেটারি বদনা ডান ভ্রু’টা উঠিয়ে বলল, ‘এই রমেন হালদার লোকটার নামের পাশে এস্টার চিহ্ন দিয়েছিস কেন রে?’ লেলো লাল রঙের তেলচিটে একটা ল্যাঙট পরে খালি গায়ে ঘাম ঝরিয়ে বারবেল ভাঁজছিল। ঘামের চোটে মনে হচ্ছে যেন তার শরীরটাতে বেশ করে গর্জন তেল মাখানো হয়েছে। জিভ দিয়ে সুড়ুত্ করে একটা শব্দ করে বলল, ‘বস, লোকটা মালদার।’
‘বটে!’ বদনার বাম ভ্রু’টা উঠে গেল। চোখের লোলুপ মণি দুটো ঘুরে গেল লেলোর দিকে। বলল, ‘খবর পেলি কোত্থেকে?’
‘আরে, ক্ষিতীশজেঠুর বাড়িতে নতুন ভাড়া এসেছে। উনিই বললেন।’
‘বাঃ, তবে তো একদম ঘোড়ার মুখের খবর।’ খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল বদনা। ভজু খালি গায়ে কালো শর্টস পরে বুক-ডন দিচ্ছিল। ভজুর পা দুটো দেখে মনে হচ্ছে যেন দু’খানা বাঁশ কেউ কাত করে রেখেছে। সেগুলোই ওঠানামা করছে। বলল, ‘যার যার নামের চিঠিগুলো এ বার দিয়ে দিস, বস? ডোনেশন কালেকশনে দেরি হয়ে গেলে আমাদের বাত্সরিক প্রদর্শনী মাথায় উঠবে।’
‘জলদি পাঠিয়ে দে।’ হুঙ্কার ছেড়েই বালির বস্তায় এক মোক্ষম ঘুসি চালিয়ে দিল বদনা।
চিঠি পেয়ে দিন তিনেক পর রমেন হালদার বিয়ানপুর ব্যায়ামবীর সমিতিতে এল। এসে তার মনে হল যেন সত্য যুগে প্রবেশ করেছে। চোখের সামনে এতগুলো পবনপুত্র ল্যাঙট পরে কেউ মুগুর ভাঁজছে, কেউ ব্যাঙ লাফানি লাফাচ্ছে, কেউ বা ডাম্বেল নিয়ে এক বার ওপর দিকে ওঠাচ্ছে আবার নীচের দিকে নামাচ্ছে।
রমেন হালদার কাঁপাকাঁপা হাত দুটো বুকের কাছে এনে বলল, ‘শ্রী বদনচরণ বাগাল আছেন?’ বদনা একটা বেঞ্চে চিত্ হয়ে শুয়ে ঘরের ছাদের দিকে ঘুসি চালাচ্ছিল। লেলো লাফাতে লাফাতে এসে বলল, ‘বস, একটা লোক তোমার তালাশ করছে।’ বদনা ব্যায়ামে মগ্ন ছিল। বলল, ‘কার লাশ পড়েছে?’
‘লাশ নয়, তালাশ। একটা লোক তোমার খোঁজে এসেছে। ওই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
‘আমাকে খোঁজার কারণ?’
‘জানি না, বস।’ বদনা তোয়ালেটা ঘাড়ে ফেলে বলল, ‘চল তো দেখে আসি।’
বদনা ঘাম শরীরে কাছে এলে রমেন হালদারের মনে হল তার হাতের শিরাগুলো যেন সদ্য গরম রস থেকে চুবিয়ে তোলা ল্যাংচা। এখনও যেন তার শরীর থেকে গরম তাত বেরোচ্ছে। দেখে তো রমেন হালদারের সর্ব শরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে। বদনা ঢাক পেটানো গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার?’
‘আজ্ঞে, আপনিই শ্রী বদনচরণ বাগাল?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই চিঠিটা...’ বলতে বলতে রমেন হালদার কাঁপা কাঁপা হাত দুটো ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়েছে, এমন সময় বদনা বাজখাঁই গলা, ‘আপনার কী মোশাই লিউমোনিয়া-টিউমোনিয়া হয়েছে নাকি? অমন কাঁপছেন যে?’
‘না না।’ বলে রমেন হালদার একটা শুকনো হাসি আনার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা যেন দুই ঠোঁটের মধ্যেই বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল। তার পর কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা বের করে বদনার হাতে দিল। বদনা সেটা খুলে দেখেই রমেন হালদারকে খাতির করে বলল, ‘আরে স্যর আপনি! বসুন বসুন। ওরে লেলো, স্যরের জন্য চেয়ার নিয়ে আয়।’ লেলো ছুটে গিয়ে ছত্রিশ গজের জি আই পাইপের বানানো চেয়ারটা এনে দিল। রমেন হালদার বসল তাতে। এমন সময় হঠাত্ বদনার মনে পড়ল, তোয়ালেটা ঘাড়ের ওপরে রয়ে গিয়েছে। যেটা এখন থাকা উচিত ছিল কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে সে তোয়ালেটা ঘাড়ের ওপর থেকে নামিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিল।
অচেনা একটা লোককে এ রকম ভাবে তোয়াজ করতে দেখে সমিতির অন্যান্য সদস্যরাও এগিয়ে এল। তা দেখে রমেন হালদারের ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। জিভ শুকিয়ে তেজপাতা। আর গলাটা মরা নদীর শুকনো চরা হয়ে গিয়েছে। বলল, ‘একটু জল হবে?’ বদনা একই ভাবে বলল, ‘অ্যাই লেলো, স্যরের জন্য জল নিয়ে আয়।’ লেলো প্রভুর নির্দেশ পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে শ্যাওলা পড়া একটা জলের বোতল এনে দিল। বোতলের দশা দেখে রমেন হালদারের তৃষ্ণা মিটে গেল। তবুও নিজে মুখে যখন চেয়েছে, একটু না খেলে যদি ঘাড়ে একটা রদ্দা বসিয়ে দেয়, সেই ভয়ে কোনও রকমে এক ঢোক জল গিলে বোতলটা ফেরত দিল লেলোর হাতে। বদনা এ বার সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল, ‘তা ডোনেশনটা আপনি কবে দিচ্ছেন স্যর?’ রমেন হালদার বলল, ‘আমি বলছি কী...’ মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বদনা দ্বিগুণ উত্সাহে বলল, ‘বলুন, বলুন স্যর।’ রমেন হালদার আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি বলছি যে টাকার অঙ্কটা আমার পক্ষে বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার পক্ষে এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়।’ শুনে বদনার বাম ভ্রু’টা উঠে গেল। মুখটা ল্যাংড়া আমের মতন করে বলল, ‘সে কী স্যর! এ আর আপনার কাছে এমন কী, হাতের ধুলো।’
‘ব্যাপারটা বুঝুন। আমি বাজারে তরকারি বেচি। আমার পক্ষে কি এত টাকা দেওয়া সম্ভব? আপনারাই ভেবে দেখুন।’
‘তরকারি বেচলেও আপনার মেলা টাকা আছে, সে খবর আমরা রাখি। দেখুন আমাদের সমিতির বাত্সরিক প্রদর্শনী নামকরা। আপনি এ অঞ্চলে নতুন এয়েচেন বলে হয়তো জানেন না। এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন মাননীয় ক্রীড়ামন্ত্রী। আমাদের শোভিনিরে আমরা ডোনেটরদের নাম ছাপাই। আপনার নামও ছাপানো হবে সেখানে। ভেবে দেখুন আপনার টাকা জলে যাবে না।’ রমেন হালদার মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন, তরকারি বেচে আমার সামান্য আয়...’ কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বদনা বলল, ‘ওরে লেলো রে, বলে কী সামান্য আয়!’ বলে ‘হা হা হা’ করে হেসে সারা ঘরটা কাঁপিয়ে তুলল বদনা। এই শুনে রমেন হালদারের হৃত্পিণ্ডটাও কাঁপতে লাগল। লেলো বলল, ‘আপনি তো মশাই মালদার লোক। আপনার আবার সামান্য আয় কোথায়?’
‘মালদার লোক বলে কি সামান্য আয় হতে নেই?’ মিন মিন করে বলল
রমেন হালদার।
এই প্যঁাকাটির মতন লোকটার সঙ্গে এতক্ষণ বচসা করতে ধৈর্য রইল না বদনার। সে হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘এই মাত্তর তো আপনি নিজের মুখেই স্বীকার করলেন যে আপনি মালদার লোক। তবে এ ক’টা টাকা দিতে পারবেন না?’ ভজু হাত পাকাতে পাকাতে বলল, ‘আপনার বাড়িওলা ক্ষিতীশজেঠু নিজে আমাদের বলেচেন যে আপনি মালদার লোক। আর আপনি এখন ভ্যান্তারা করচেন?’
এ বার রমেন হালদার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বলল, ‘উনি তো ভুল কিছু বলেননি।’
‘তবে এত ভ্যান্তারা করচেন কেন মোশাই?’
রমেন হালদার হেসে বলল, ‘ক্ষিতিশদা ঠিকই বলেছেন, তবে আপনাদের বুঝতে
ভুল হয়েছে।’
‘তবে আপনিই বুঝিয়ে দিন।’ হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে হাতের গুলিগুলো ফুলিয়ে বলল বদনা।
‘আমি মালদা জেলার লোক ঠিকই, তবে মালদার মানে পয়সাওয়ালা মোটেই নই। তবে কি আর তরকারি বেচতে হয়?’
ব্যাপারটাতে সবাই ‘হাঁ’ বনে গেল। আর বদনা লেলোর ওপর রেগে জ্বলন্ত মশাল হয়ে উঠল। রমেন হালদারকে বলল, ‘ঠিক আছে আপনি আপনার সাধ্যমতন চাঁদা দেবেন।’ তার পর লেলোর দিকে জ্বলন্ত কয়লার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘তোর সঙ্গে আমার পরে বোঝাপড়া হবে। বিয়ানপুর ব্যায়ামবীর সমিতির কি পেস্টিজ বলে কিছু নেই?’ বলেই সে উঠে গিয়ে বালির বস্তায় একটা জোরালো ঘুসি বসিয়ে দিল।