Advertisement
E-Paper

রিশার হাতের কাজ

অনন্যা দাশরিশা স্কুল থেকে ফিরেই ঘোষণা করল, ‘আমাদের ক্রাফ্টের প্রোজেক্টের জন্যে কালকে একটা পেন হোল্ডার বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’ মা খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন, ‘ও বাবা! আজকে বলে কালকেই নিয়ে যেতে হবে?’

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৯
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

রিশা স্কুল থেকে ফিরেই ঘোষণা করল, ‘আমাদের ক্রাফ্টের প্রোজেক্টের জন্যে কালকে একটা পেন হোল্ডার বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

মা খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন, ‘ও বাবা! আজকে বলে কালকেই নিয়ে যেতে হবে?’

রিশা কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘টিচার আগেই বলেছিলেন, কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে উনি কয়েক দিন আসেননি। তাই আজকে বললেন কালকেই নিয়ে যেতে হবে!’

‘থাক থাক, তোকে আর বাহানা বানাতে হবে না!’ দিদি মিশা ফোড়ন কাটল, ‘বানাতে যখন বলেছে, তখন বানা!’

‘আমি একা একা কী করে বানাব?

আমি তো ছোট!’

‘ছোট তো কী হয়েছে, একেবারে মাথা কিনে বসে আছিস নাকি। তোর ক্রাফ্ট তুই-ই বানাবি!’

রিশা দেখল এ তো মহা মুশকিল হল। সে ভেবেছিল বাড়িতে সবার কাছ থেকে সাহায্য পাবে, কিন্তু মা বা দিদি কেউই ওর হয়ে প্রোজেক্ট করে দিতে উত্‌সাহ দেখাল না। বিকেলবেলা বাবা অফিস থেকে ফিরতে বাবাকে গিয়ে ধরল রিশা, ‘বাবা আমাকে কালকে স্কুলে একটা পেন হোল্ডার নিয়ে যেতে হবে।’

বাবা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘বাড়িতে তো প্রচুর পেন হোল্ডার এ দিক ও দিক পড়ে রয়েছে, তার মধ্যে থেকে যে কোনও একটা নিয়ে গেলেই হবে।’

রিশা রেগে গিয়ে বলল, ‘দুর, তুমি কিছু বোঝো না! ক্রাফ্টে পেন হোল্ডার বানাতে হবে! কালকে সেটার ওপর নম্বর দেবে টিচার। সেই নম্বর রিপোর্ট কার্ডে লেখা হবে। যারটা সবচেয়ে সুন্দর হবে, সেটা ক্লাসে সাজিয়ে রাখা হবে।’

‘ও, তা আমাকে বলা কেন? আমি তো বাপু ক্রাফ্ট-টাফট একদমই বুঝি না। মা বা মিশাকে বলো, ওরা যা করার করে দেবে!’ বলে বাবা ফোনে কী সব ই-মেল-টিমেল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

দাদু সান্ধ্যভ্রমণ সেরে ফিরে আসতে রিশা দাদুর কাছেও গেল।

‘দাদু আমাদের ক্রাফ্ট প্রোজেক্টের জন্যে কালকে একটা পেন হোল্ডার বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে!’

‘আমি তো বুড়ো মানুষ, আমি কী আর ও সব ক্রাফ্ট-টাফট তৈরি করতে পারি, দিদিমণি? তুমি বরং মা, বাবা বা দিদিকে জিজ্ঞেস করো।’

‘মার সময় নেই, রান্না করছে। বাবাও তোমার মতো কিছু বানাতে পারে না বলছে আর দিদি বলছে ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাকে কেউ এই সবে সাহায্য করেনি। আমি নিজেই একা একা যা পেরেছি বানিয়েছি। তাই তুই আশা করিস না যে, আমি তোকে ক্রাফ্ট বানিয়ে দেব!’

দাদু টাক মাথা চুলকে বললেন, ‘সেটা অবশ্য তোমার দিদি খুব একটা ভুল কিছু বলেনি। নিজের কাজ নিজেই তো করা উচিত! তবে তুমি দিদিকে বলতে পার তোমাকে কিছু আইডিয়া দিতে, তার পর না হয় তুমি নিজে যা করার করবে।’

রিশা দিদিকে সেটাই বলতে গেল।

দিদি শুনে বলল, ‘ঠিক আছে, আইডিয়া দিতে পারি। আমার কাছে একটা ক্রাফ্ট তৈরির বই আছে, সেটাতে মনে হয় পেন হোল্ডার বানাতে শিখিয়েছে। দাঁড়া সেটা নিয়ে আসি। ওটাতে বেশ সুন্দর ছবি দিয়ে দিয়ে সব বোঝানো আছে, পড়ে দেখারও দরকার পড়ে না। তোর টিচারেরই শিখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু উনি যখন বলেছেন বাড়ি থেকে করে নিয়ে আসতে, তখন কী আর করা যাবে।’ বলে দিদি গিয়ে বইয়ের আলমারি থেকে বইটা বার করে নিয়ে এল।

বইতে যেমন লেখা তেমন জেলির খালি শিশি, রঙিন কাগজ, চুমকি, পুঁতি, কাচের টুকরো সব জোগাড় হয়ে গেল।

দিদি বলল, ‘এই দেখ, খুব সহজ। এই ভাবে কাগজটা দিয়ে শিশিটাকে মুড়ে ফেলবি। তার পর সুন্দর ডিজাইন করে চুমকি, পুঁতি আর কাচের টুকরোগুলোকে আঠা দিয়ে সারা গায়ে লাগিয়ে দিবি। ব্যস, কেল্লা ফতে!’

সারা বিকেল ধরে রিশা যা পারল করল। শেষ হওয়া জিনিসটা দেখে দিদি বলল, ‘ভালই করেছিস। তোর বয়সে আমি এর চেয়ে ভাল কিছু করতে পারতাম না। তোর ক্লাসেও মনে হয় না কেউ এতটা ভাল কিছু করবে!’

দিদির কথা শুনে বেশ খুশি হল রিশা! মা, বাবা আর দাদুও রিশার তৈরি পেন হোল্ডারের প্রশংসা করলেন।

পর দিন রিশা বেশ ফুরফুরে মনে ক্রাফ্ট নিয়ে স্কুলে চলে গেল।

ক্লাসে গিয়ে অবশ্য ওর মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। সব ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর সুন্দর সব জিনিস এনেছে! শ্রীজিতার পেন হোল্ডারটায় শোলার কাজ করা, রাজর্ষিরটায় কী অসাধারণ রংচঙে ফিতে দিয়ে গোলাপ ফুল বানানো। যে দিকে তাকায় সে দিকেই দারুণ একটা কিছু! লজ্জায় মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল রিশার।

আরাত্রিকা তো বলেই ফেলল, ‘এ মা! তুই এটা কী এনেছিস? মিস তো তোকে ফেল করে দেবে রে! এই দেখ আমারটা দেখ!’ বলে নিজের পেন হোল্ডারটা তুলে ধরল।

সেটা এতটাই বড় যে সেটাকে পেন হোল্ডার না বলে ছাতা হোল্ডার বলা চলে! পেন তো কোথায় ভিতরে ঢুকে যাবে তার ঠিক নেই। কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। রঙিন পালক দিয়ে পাখি তৈরি করা রয়েছে সারা গায়ে। মনের দুঃখে রিশা কিছু বলতে পারল না, কিন্তু ওর মনে হল ওই জিনিস আরাত্রিকা কিছুতেই নিজে বানাতে পারে না! ও তো আঁকার ক্লাসে টিচার যা বোর্ডে এঁকে দেন সেটাই এঁকে উঠতে হিমশিম খায়!

এই ভাবে সারাটা দিন কাটল। রিশার খুব রাগ হচ্ছিল মা, বাবা, দাদু আর দিদির ওপর। ওরা ওকে নিজে নিজে সব করালো, আর এ দিকে ক্লাসের অন্যরা...ক্রাফ্টের ক্লাস একদম শেষে, ছুটির ঠিক আগে। ক্রাফ্টের টিচার মল্লিকাম্যাডাম একে একে সবার আনা ক্রাফ্ট দেখলেন। অন্য সবারটা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন আর রিশারটা মোটেই বেশি সময় নিয়ে দেখলেন না। দেখে দেখে খাতায় নম্বর লিখছিলেন, কিন্তু সেটা খুব লুকিয়ে বলে ওরা কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। সব ক্রাফ্ট দেখতে দেখতে অনেক সময় লেগে গেল বলে ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই বাড়ি যাওয়ার জন্যে উসখুস করেছে দেখে ম্যাডাম বললেন, ‘কাল সকালে মরাল সায়েন্স ক্লাস আছে তখন তোমাদের নম্বরগুলো বলে দেব। আপাতত সবগুলোই ক্লাসে রাখা থাক কিন্তু পরে আরাত্রিকা তোমার ক্রাফ্টাই ক্লাসে থাকবে, সব থেকে সুন্দর দেখতে।’

আরাত্রিকা আনন্দে হইহই করে উঠল। সে দিন সারা বিকেল মন মরা হয়ে রইল রিশা। এ দিকে মনের দুঃখে বাড়িতে কাউকে কিছু বললও না। ভাগ্যিস তাও সন্ধেবেলা বুলামাসি এলেন পুঁচকে হিতকে নিয়ে। ওর সঙ্গে খেলতে খেলতে অবশ্য সব দুঃখ ভুলে গেল রিশা।

পরের দিন ক্লাসে ফেল করা নম্বর পাবে আশা করেছিল রিশা, কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে সে পেল ‘এ’ আর বাকিরা কেউ হয় ‘বি’ বা ‘সি’! এমনকী আরাত্রিকা তার এত সুন্দর ক্রাফ্টটার জন্যে ‘বি’ পেল!

আর থাকতে না পেরে আরাত্রিকা তো মল্লিকাম্যাডামকে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, ‘আপনি যে বললেন আমার ক্রাফ্টটা সবচেয়ে সুন্দর, ওটা ক্লাসে রাখা হবে, তাও আমি ‘বি’ পেলাম কী করে?’

মল্লিকাম্যাডাম মুচকি হাসলেন, ‘আমি তোমাদের ক্রাফ্ট বানাতে বলেছিলাম, তোমাদের বাবা-মা বা পাড়ার দোকানদারদের তো বলিনি! সেই জন্যেই আমাকে অত খুঁটিয়ে দেখতে হচ্ছিল। দেখতে চাইছিলাম ওগুলোতে অন্তত একটা কিছু তোমাদের পক্ষে করা সম্ভব কি না। একমাত্র ঋষিকা নিজের ক্রাফ্টা নিজে বানিয়েছে তাই ওরটা তোমাদের কারও মতন দারুণ সুন্দর কিছু হয়নি। কিন্তু কাজটা তো ওর! ও নিজে নিজেই যা পেরেছে চেষ্টা করেছে, সেই জন্যেই ও ‘এ’ পেয়েছে আর বাকিরা ‘বি’! এর পর থেকে আমি ভাবছি তোমাদের সবাইকে ক্লাসেই হাতের কাজ করাব। বাড়ি থেকে আনতে দিলে গোলমাল হচ্ছে! আমি প্রিন্সিপালের সঙ্গেও কথা বলেছি। উনি তোমাদের প্রত্যেকের মা-বাবাকে চিঠি দেবেন যে বাচ্চারা যেন নিজেদের কাজ নিজে করে! আরাত্রিকারটা ক্লাসে রাখছি তার সব চেয়ে বড় কারণ ওটা কাচের নয়, পড়ে গেলেও সহজে ভেঙে যাবে না!’

মল্লিকাম্যাডামের কথায় আনন্দে ঝলমল করে উঠল রিশার মুখ। যাক, মা, বাবা, দাদু আর দিদি মিথ্যে কথা বলেনি। নিজের ক্রাফ্ট নিজেই করা উচিত।

rabibasariyo anandamela ananya das
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy