Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৪৮


স্বপ্নময় চক্রবর্তী

ছোটবেলায় যে বাড়িতে থাকতাম, তার একতলার কারখানায় তৈরি হত কালির বড়ি। ডট পেন যুগের আগে ছিল ফাউন্টেন পেন যুগ, তারও আগে ছিল হ্যান্ডেল কলম। দোয়াতে ডুবিয়ে লিখতে হত। লেখার কালির বড়ি তৈরি হত ওই কারখানায়। শক্ত বড়িগুলো জলে ফেলে দিলে গলে গিয়ে কালি তৈরি হত। আমার পিতামহকে দেখতাম দোয়াতে কলম ডুবিয়েই লিখতেন। শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র এ ভাবেই লিখেছেন। আমরা নতুনকে গ্রহণ করি, পুরনোকে সহজে ছাড়ি না। রান্নাঘরে মিক্সি-ও থাকে, শিলনোড়াও। ষাটের দশকের মাঝামাঝি হেয়ার স্কুলে ভর্তি হয়ে দেখলাম, আমাদের ডেস্কে দোয়াত রাখার খোঁদল ছিল।

কালির বড়ি তৈরির প্রধান দুটি উপাদান ‘ডেক্স্ট্রিন’ নামের শ্বেতসার জাতীয় পদার্থ, যা নাকি আলুর গুঁড়ো, তার সঙ্গে রং মিশিয়ে, শুকিয়ে ডাইস-এ ফেলে বড়ি বানানো হত। কালো, নীল এবং লাল রঙের কালির বড়ি তৈরি হত। লাল বড়িগুলো নাকি সে সময় বর্মায় রপ্তানি হত, বিহার এবং মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী অঞ্চলেও। ওই বড়িগুলো লেখার জন্য নয়, প্রসাধন হিসেবে ব্যবহার করত গরিব মেয়েরা। জলে ভিজিয়ে ঠোঁটে ঘষত। সস্তার লিপস্টিক। এ জন্য লাল কালিতে এমন রং দেওয়া হত, যা বিষাক্ত নয়, গোলাপের ‘সেন্ট’ এবং স্যাকারিনও মেশানো হত। ফলে একটু মিষ্টি স্বাদ হত। লাল রং মাখা ডেক্স্ট্রিন যখন ছাদে শুকোতে দেওয়া হত, সে সময় এলাকার সমস্ত কাকেদের লাল পটি হত। ওরা মিষ্টি ডেক্স্ট্রিন খেত কিনা...

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অনুপ্রেরণায় এই কারখানাটা গড়েছিলেন উদয় চক্রবর্তী। তাঁর ছেলে জাহ্নবী চক্রবর্তী ছিলেন ওই কারখানার স্বত্বাধিকারী। ছাত্রজীবনে শ্রমিক, মালিক, শ্রেণিসংগ্রাম, শোষণ— এই সব শব্দাবলির সঙ্গে পরিচয় হচ্ছিল, ওই সময়ে আমার দেখা প্রথম মালিক হলেন জাহ্নবী চক্রবর্তী, এবং প্রথম দেখা শ্রমিকরা হচ্ছে— খ্যাঁদা, নকে, ঘনা, পাঁচু, বিজয়...। কালিকলে কাজ করার কারণে যাদের শরীর রঙিন হয়ে থাকত, আমি ওদের সবাইকে চিনতাম এবং দাদা সম্বোধন করতাম।

এক দিন দেখি, খ্যাঁদাদাকে ঘিরে জটলা। বামাল ধরা পড়েছে। প্যান্টের পকেটে এক ঠোঙা লাল কালির বড়ি। বিজয়দাই ওকে ধরেছিল। বলছিল, অনেক দিন তক্কে তক্কে ছিলাম। যখন বেরোয়, দেখি, প্যান্টের পকেট ফুলো। ‘মালিক’ জিজ্ঞাসা করলেন— এগুলো সব কোথায় বেচিস খ্যাঁদা? কাকে দান করিস? ‘বিপল্লবকে।’ বিপল্লব আবার কে? সে কী করে? জেরার শেষে জানা গেল, কাস্তে-হাতুড়ি আঁকার জন্য এই লাল কালির ব্যবহার। বিপল্লব মানে বিপ্লব। সে কোনও ব্যক্তি নয়— রেভলিউশন।

বিপল্লব হলে কী হবে রে খ্যাঁদা? মালিক জিজ্ঞাসা করলেন। ‘তখন গরিব-বড়লোক সেম সেম হয়ে যাবে, সব কারখানা শ্রমিকদের হয়ে যাবে।’ মালিক বললেন, এই কারখানাটা তোদের দিলে চালাতে পারবি? ইংরিজিতে চিঠিপত্র লিখতে হয়, পারবি তো? জাহ্নবীবাবু হাসছিলেন। খ্যাঁদা বলেছিল, ‘কেন, নকুলবাবু চালাবে।’ নকুলবাবু দেওয়ালে ‘দেশহিতৈষী’ মারতেন। পাজামা আর ফুলহাতা শার্ট। মনে আছে, এক দিন দেশহিতৈষী পড়বার চেষ্টা করছিলাম। ওটা সিপিএম-এর একটা পত্রিকা। উঁচুতে সাঁটানো ছিল বলে পা উঁচিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। এক জন দুটো থান ইট এনে পেতে দিয়ে বললেন, খোকা, এগুলোর উপর দাঁড়িয়ে পড়ো। উনিই নকুলবাবু।

জাহ্নবীবাবু বললেন, কারখানাটা নকুলবাবু চালাবে? তাই নাকি? ডাকছি নকুলকে। নকুল কি তোকে কালি চুরি করতে বলেছিল? খ্যাঁদা বলেছিল, ‘না, কেউ বলেনি।’ চুরির জন্য শাস্তি পেতে হবে তোকে। বল, এর শাস্তি কী? জটলার মধ্যে তত ক্ষণে খোকাদা চলে এসেছে। এলাকার গার্জেন। খোকাগুন্ডা। খোকাদা বলল, ‘খ্যাঁদাকে দিয়ে দেয়ালে কাস্তে হাতুড়ি আঁকিয়ে, তার ওপর মুততে বলুন।’ জাহ্নবীবাবু বললেন, ছি ছি। যে চিহ্নকে এত লোক মানে, সেটাকে অসম্মান করা যায় নাকি?

কান ধরে ‘আর কখনও করব না’ বলে সে যাত্রায় রেহাই পায় খ্যাঁদা। কিন্তু আমার চোখে খ্যাঁদাদা এক জন হিরো। এক জন গেরিলা সৈনিক। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস হেরে যায়। খ্যাঁদাদার বিপল্লব এসে যায়। একটা উঁচু লাইটপোস্টের বাল্বে লাল কাগজ সাঁটতে গিয়ে খ্যাঁদাদা অনেক উঁচু থেকে পড়ে যায়। মাথা চৌচির। যখন বিজয়-উৎসব চলছে, খ্যাঁদাদা পুড়ছিল। মৃতদেহের উপর লাল ঝান্ডা চাপেনি, দেয়নি কেউ, শুধু নকে-ঘনারা লাল কালি ছোপানো কাপড় রেখেছিল। জাহ্নবীবাবু বলেছিলেন, কোনও কালি দিয়ে একটা কাস্তে হাতুড়ি এঁকে দে।

’৬৭-র সরকার বেশি দিন টেকেনি। ’৭২ সালে ভোট হয়েছিল ফের। কালিকলের দেওয়ালে খোকাদার তত্ত্বাবধানে কারা যেন লিখেছিল ‘দেহের শত্রু প্যাঁচড়া-খোস, দেশের শত্রু জ্যোতি বোস।’

জাহ্নবীবাবু বললেন— ছি ছি, এমন লিখতে আছে? লেখাটা মুছিয়ে দিলেন তিনি। আজীবন কংগ্রেসি ছিলেন জাহ্নবীবাবু। বলতে শুনেছি, গাঁধীজির আত্মাও শান্তি পেল না, খ্যাঁদার আত্মাও নয়। ১৯৯৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকায় ঢেকে দিতে আসেনি কেউ।

swapnoc@rediffmail.com


পিনাকী ভট্টাচার্য

১৮১১ সালের ২৭ মার্চ লন্ডনের ‘দ্য টাইম্স’-এ একটি বিজ্ঞাপন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আর সে দেশে চলে যাওয়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল খোদ লন্ডন শহরে কারি পাওয়া যাচ্ছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুস্থানি কফি হৌস’-এ। এতটাই জনপ্রিয় হল সেই কারি, দলে দলে স্মৃতিমেদুর সাহেবরা ভিড় জমাতে লাগল সেখানে। কিছু দিনের মধ্যে সেখানে হুঁকো টানার ব্যবস্থা অবধি চালু হয়ে গেল (শহরের নতুন গজানো কফির ঠেকগুলো ওখান থেকেই বুদ্ধিটা ধার নিয়েছে না কি)!

‘কারি’ শব্দটার উৎপত্তি তামিল থেকে। আমিষ বা নিরামিষ রান্না কষার সময় যে ক্বাথটা তৈরি হয়, তাকে তামিল ভাষায় কারি বলা হত। আবার মালয়ালম ভাষায় ‘ক্যারিল’ ব্যবহৃত হত সেই সব মশলার জন্যে, যা দিয়ে সবজি বা মাংস রান্না হত। এই উপমহাদেশে, সে যে কোণেই হোক, মশলাহীন রান্না লোকের মুখে রোচে না; রান্নায় মশলার ব্যবহার, সে বেশি হোক বা কম, প্রায় বাধ্যতামূলক সর্বত্র। সিন্ধু সভ্যতার সময়ও জিরে-মৌরি-সরষে ছিল, হামানদিস্তেতে তাদের গুঁড়ো করে নিয়ে তেঁতুলের ক্বাথে মিশিয়ে রান্না করাও ছিল।

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে কারির পরিচয় সেই জন্মলগ্ন থেকেই, কারণ অবশ্যই তাদের এদেশি মাতৃকুল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তিন প্রধান বাণিজ্যের কেন্দ্রেই কারি সাহেবদের অন্যতম প্রিয় খানা হয়ে ওঠে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের দৌলতে। আর কারিরও তিন ঘরানা তৈরি হয়। বাংলাদেশ খ্যাতি লাভ করে মাছের আর সবজির কারির জন্যে। মুম্বই (তখন বম্বে) সামুদ্রিক মাছের কারির জন্যে। আর দক্ষিণ ভারতের কারি বিখ্যাত হয় তার ঝাল স্বাদ আর নারকেল দুধের ব্যবহারের জন্যে।

সময়ের সঙ্গে কারি ইংল্যান্ডে এতই জনপ্রিয়তা লাভ করল, কারির ভারতীয়ত্ব মেনে নেওয়া দুষ্কর হল সাহেবদের কাছে। তারা এমনকী দাবিও করল, কারির সৃষ্টি ইংরেজের রসুইঘরে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে দ্বিতীয় রিচার্ড-এর শাসনকালে ইংরেজ রাঁধুনিরা কারি পরিবেশন করত। সাহেবদের কারি নিয়ে কাড়াকাড়ি এতই বেড়েছিল যে ১৭৮৪ সালে পিকাডিলি-র সর্লিজ পারফিউমারি ওয়ার্কস ‘কারি পাউডার’ বানাতে শুরু করল, যাতে মেমসাহেবরা সহজে নিজেদের হেঁশেলে কারি রান্না করতে পারে। এখানকার মৃৎশিল্পীরা যেমন বিশ্বকর্মার হাতির জায়গায় ময়ূর বসিয়ে কার্তিক তৈরি করে ফেলেন, প্রায় সেই একই অনায়াস নৈপুণ্যে ইংরেজ নারীকুল কারি পাউডারে চাটনি আর আম মিশিয়ে ‘বেঙ্গল কারি’ আর আধ মালা নারকেল মিশিয়ে ‘মালয় কারি’ তৈরি করে বাড়ির কর্তার থালায় এক টুকরো ভারতের স্বাদ বেড়ে দিচ্ছে আজ সওয়া দুশো বছর ধরে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy