Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০০:০০

শাউরি গ্রামের নামটা শুনেই নারায়ণ রাণার কথা মনে পড়ল। বিরাট মাপের এক জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। গ্যালাক্সির চরিত্র, কৃষ্ণগহ্বর, নক্ষত্রের মৃত্যু এ রকম নানা বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন উনি। পৃথিবীর নানা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেছেন। দুশোর মতো পেপার। ১৯৯৫ সালে একটা পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন, নারায়ণ রাণার নেতৃত্বে এক দল গবেষক পৃথিবীর বিভিন্ন স্পটে পৃথিবীর উপর আপতিত চাঁদের ছায়া পর্যবেক্ষণ করে, অঙ্ক কষে সূর্যের ব্যাস ঠিক ভাবে নির্ণয় করে বিশ্ব জুড়ে হইহই ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বিজ্ঞানীদের মধ্যেই। পাড়ায় এই নামটা ফেলে দেখুন, কেউ চেনে না। টিভি সিরিয়ালে বার পাঁচেক ফ্যঁাচফ্যঁাচ করলেই সে সেলেব্রিটি। আমাদের সমাজ, বিজ্ঞানীদের ঠিকঠাক সম্মান দেয়নি। সে যাক গে যাক।

এই নারায়ণ রাণা অকাল প্রয়াত হন ১৯৯৬ সালে। তখন ওঁর মাত্র ৪৩ বছর বয়স। আকাশবাণীর জন্য ওঁকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য শাউরি গ্রামে যাই।

নারায়ণ রাণার ছোট্ট বাড়িটার একটা ঘর ঢালাই, বাকিটাতে টালির চাল। ঘরের বারান্দায় ছাগল। নারায়ণ রাণার মা কাঠের আঁচে কোনও একটা শাক সেদ্ধ করছিলেন। দুটো তক্তপোশ ছাড়া অন্য কোনও আসবাব নেই। একটি বছর পঁচিশের ছেলে এল। মাটি-মাখা হাত। কোথা থেকে একটি মেটে আলু খুঁজে এনেছে। ও হল অধ্যাপক রাণার ভাই। মা কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ওর বাপ কামারের কাজ করত, তেল কেনার পয়সা ছিল না, হাপরের আলোয় লেখাপড়া করত ছেলেটা, গাঁয়ের ইস্কুল থেকে ফাস্টো হয়ে যে কলকাতা চলে গেল, তার পর বাড়িতে আসতে পারত না। চিঠি লিখত, সে তো আমি পড়তে পারি না, ছোট ছেলে পড়ে দিত। বলত ‘গেরন’টা যাক, আমি ফিরে এসে বাড়িটা ঠিক করে দেব। তার পরই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ওই কান্নার মধ্যেই বললেন, ‘বাবা, আমার ছোট ছেলেটাকে কেউ একটা চাকরিবাকরির ব্যবস্থা করে দাও। নারান তো আর টাকা পাঠাবে না। কী করে দুটো চাল কিনে মুখে দেব ছেলেটার।’

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ওই কথাগুলি, ক্রন্দন, আকুতি, সবই রেকর্ড করা হয়েছিল। রেডিয়োতে বেজেছে, দু-চারশো লোক শুনেছে, ব্যস, ফুরিয়ে গেল।

কিন্তু ফুরিয়ে গেল না। জগন্নাথরা ফুরোতে দিল না। জগন্নাথ কুইলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম অধ্যাপক নারায়ণ রাণার ভাই কেমন আছে? চাকরি কি পেয়েছে? মায়ের খবর কী? ও জানাল মৃত্যু-পরবর্তী যা পাওনা হয়, সেই টাকায় ওদের কিছুটা সুরাহা হয়েছে। আর নারায়ণ রাণার ইচ্ছামত মণীন্দ্র লাহিড়ীর নামে একটা বৃত্তি চালু করা হয়েছে।

মণীন্দ্র লাহিড়ী কে? জিজ্ঞাসা করি।

আমাদের গাঁয়ের ইস্কুলের মাস্টারমশাই, একটু কুঁজো মতন। উনিই তো সব ছেলেদের ধরে ধরে মাঠে নিয়ে গিয়ে দেখাতেন ওই যে লুব্ধক, ওটা অশ্লেষা, ওটা কৃত্তিকা, ওই যে মেষ রাশি, আমার গাঁয়ের সবাই আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের নাম জানে। আর আমার দাদা তো মণীন্দ্র স্যরের জন্যই আকাশ নিয়ে পড়লেন।

মণীন্দ্র স্যর কি আছেন এখনও?

জগন্নাথ বলে, আমার মধ্যেই তো আছেন। আমিও তো বাড়ি গেলেই ছেলেপুলেদের আকাশ দেখাই। দেখবেন, দেখবেন স্যর একটা টেলিস্কোপ? ব্যাগ থেকে একটা পেতলের পাইপ বার করে জগন্নাথ। বলে এটা আসলে একটা পিচকিরি। তিনখানা লেন্স লাগিয়েছি ভিতরে। শনির বলয়টাও দেখা যায়। অন্যরা দেখতে পায় না যদিও, কিন্তু আমি দেখি।

আমি ওর হাত থেকে ওটা নিয়ে গাছের ডাবগুলোকে দেখতে পেলাম। জগন্নাথ কিন্তু নক্ষত্র দেখায়, দেখেও।

swapnoc@rediffmail.com

পিনাকী ভট্টাচার্য

বিশ্বের ভোজন-রসিকদের স্বর্গরাজ্য ফ্রান্সে খানদানি মেনু হল বারো পদের। বিভিন্ন পদের আক্রমণের পর ষষ্ঠ পদ আসে মাংসের। সেটার পর, খাইয়েরা পেট, মুখ, চোয়ালকে খানিক বিশ্রাম দেয় আর এক প্রস্থ মাংস সামলানোর আগে। এই বিশ্রামের পদের নাম ‘সোরবে’ (Sorbet) যখন ঠান্ডা ফলের বা ফুলের নির্যাসে বরফ মিশিয়ে খেয়ে উদরকে একটু ঠান্ডা করা হয়। তা হলে ‘শরবত’, যা কিনা ফলের ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি হয়েছিল আরবে, সেটা আসলে ইউরোপীয় পানীয়? আরব দেশের পাল্লা ভারী হয়ে যায় যখন দেখা যায় সে দেশে ‘শার্বা’ মানে পানীয়, আর ‘শারিবা’ মানে পান করা ‘শরাব’ কথাটাও সেখান থেকেই এসেছে! কিন্তু বিভিন্ন রকমের শরবতের কথা আমরা সে দেশে প্রথম পাই বারো শতকে গর্গানি’র লেখা বইয়ে। এদিকে ইউরোপের জনশ্রুতি, রোমান সম্রাট নিরো (হ্যাঁ, যিনি রোম আগুনে পোড়ার সময় বেহালা-বাদনে ব্যস্ত ছিলেন!) সোরবে’র আবিষ্কার করেন যিশু জন্মানোর ১০০ বছরের মধ্যেই। তাঁর নিযুক্ত দৌড়বাজরা রিলে-রেস করে পাহাড় থেকে সম্রাটের ব্যাংকোয়েট হল-এ বরফ নিয়ে আসত আর সম্রাট সেই বরফ মধু আর মদিরা মিশিয়ে খেতেন এই ভাবেই শরবতের জন্ম হয়।

ইউরো-এশীয় সম্প্রীতির কথা ভেবে বিশ্বের ভোজনরসিকরা শরবতের ও সোরবে’র এক সুন্দর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। আমাদের বলিউডি ফিল্মে যেমন ছোটবেলায় সীতাপুরের মেলায় হারিয়ে যাওয়া রামু তার মা-বাবার কাছে ২৫ বছর বাদে ফেরত যায় বিজয় নামে, তেমনই নিরোর আবিষ্কৃত শরবত হারিয়ে গিয়েছিল ইউরোপের মানচিত্র থেকে পৌঁছে গিয়েছিল আরব দেশে। সোরবে হয়ে ফ্রান্সে ফেরত গিয়েছিল ১৫৩৩ সালে, কাতেরিনা দে মেদিচি-র হাত ধরে, যিনি ও-দেশে আসেন ডিউক অব ওরলিয়ান্স-এর সঙ্গে বিয়ের সূত্রে, যিনি পরে দ্বিতীয় হেনরি নামে বিখ্যাত হন।

ফরাসি সোরবে আর আমাদের পরিচিত শরবত যদিও জন্মসূত্রে এক, পরে এদের গতিপথ বিস্তর বদলেছে। সোরবে’তে বরফ প্রায় আবশ্যিক, কারণ খাওয়া নিয়ে ধস্তাধস্তির মধ্যে বিশ্রামের আর শরীর ঠান্ডা করার পদ এটি। কিন্তু শরবত কোনও মেনুর মাঝের পদ না, সে স্বতন্ত্র থাকে মূল ভোজ থেকে (যদিও মুঘল বাদশারা খাওয়ার মধ্যেই শরবত খেতেন)।

ফল আর ফুলের নির্যাসই যদি শরবত হয়, ভারতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ সেই আদ্যিকালের। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সূর্যাস্তের পর আর ভোজন করতেন না, শুধু পানীয় খেয়ে থাকতেন। পাকা আম, জাম, কলা, আঙুর, ফলসা এই কয়েকটা ফলের রস খাওয়া চলত তাঁদের। আর এর সঙ্গে নারকেল আর ডাবের জল আর মধু। জৈন সাধুদের এই ফলগুলো বাদে অধিকার ছিল খেজুরের আর ডালিমের রস খাওয়ার। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে ধন্যামলা নামে এক আমলার পানীয় আর গাগোধক বলে এক গুড়ের পানীয়ের কথা পাই। দক্ষিণ ভারতে তেঁতুল ও আমলা মিশিয়ে এক পানীয়ের কথা তামিল শাস্ত্রে পাওয়া যায়, যা গ্রীষ্মে খাওয়া হত। প্রাচীন কালে ফলসা, লেবু, বা জামের মতো অম্ল বা কষা স্বাদের ফলের রসকে ‘রাগ’ বলা হত, আর জ্বাল দিয়ে ঘন করা ফলের রসকে ‘সাধব’ বলা হত।

তাই শরবতের মালিকানা নিয়ে দুই মহাদেশ যখন শরারতি করছে, ভারতীয়রা বিরিঞ্চিবাবার মতো বলতেই পারি, ‘ওরা তো শিশু!’

pinakee.bhattacharya@gmail.com

rabibasariyo magazine
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy