Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

পঞ্চরত্ন ডাল

পিনাকী ভট্টাচার্য

ডা ল চিরকালই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতাতেও ডালের খোঁজ পাওয়া যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আর সেলুকাস-কন্যা হেলেনের বিয়েতে নাকি এক রকমের চানা ডাল পরিবেশন করা হয়েছিল। পঞ্চরত্ন ডাল একটু স্পেশাল জিনিস। এটা একটা নির্দিষ্ট ডাল ঠিক নয়, ডালের মিশেল। গোটা মুগ, মুগ, অড়হর, চানা আর বিউলি ডাল মিশিয়ে বানানো হয়। চলিত ভাষায় একে বলে ডাল পাঁচমেল।

আভিয়াল রান্নার পর ভীমসেন নাকি বিরাট রাজার রান্নাঘরে পাঁচ রকম ডাল মিশিয়ে ফুটিয়ে নতুন এক ডাল রান্না করেন, আর তাতে ভাল রকম ঘি ঢালেন, সম্বরা হিসাবে। আর নিজের রান্নার স্বাদে মোহিত ভীমসেন, পাঁচ ডালকে ‘রত্ন’ খেতাব দিয়ে, নতুন ডালের নাম দেন পঞ্চরত্ন ডাল। আর এক লোককথা বলে, এই ডাল প্রথম রাঁধেন কুন্তী। যাতে বনবাসের দিনগুলোতে তাঁর ছেলেরা পুষ্টিকর খাবার পান। তাঁর থেকে এই রান্না শিখে নেন দ্রৌপদী।

খেতে অন্য রকম তো বটেই, তা ছাড়া ঘি আর মশলা ছড়িয়ে যখন সম্বর দেওয়া হত এই ডালে, তার গন্ধে এই পদের আকর্ষণ আরও বহু গুণ বেড়ে যেত। কাজেই মেবার ঘরানার হাত ধরে যখন এই পাঁচমেল ডাল রাজপ্রাসাদে পৌঁছল, অন্য পদেরাও সাগ্রহে একে স্বাগত জানাল। মশলাদার আর ঝাল সব খাবারের মাঝে এই ডাল এক ধরনের স্বস্তি নিয়ে এল যে! ডাল পাঁচমেল রাজকীয় ভোজে জায়গা পাওয়ার আগে, খাওয়া ছিল প্রায় যুদ্ধে যাওয়ার শামিল। সেই জমানার সব ওজনদার মশলাদার খাবার হজম করতে রীতিমত বেগ পেতে হত।

ডাল পাঁচমেলের জনপ্রিয়তার পিছনে মুঘল ঘরানার রান্নার কৃতিত্ব অনেকখানি। কারণ মুঘলদের থেকেই ‘দম’, বা কম আঁচে রান্না এ দেশে এসেছিল। সে জমানায় চানা ডাল ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় আর ইজ্জতদার। অনুষ্ঠানে চানা ডাল পরিবেশন ছিল প্রায় বাধ্যতামুলক। কিন্তু জোধাবাই-এর নিরামিষ হেঁশেলে রান্না গার্নিশ করতে, ডাল পাঁচমেল-এ দই ছড়ানো হত। তাতেই এ ডাল হয়ে ওঠে আকবর বাদশার অন্যতম প্রিয় পদ। এতে চানা ডাল থাকলেও তা একটা সুন্দর কোরাস গানের অংশ ছিল মাত্র, আসল জাদু ছিল এর স্বাদ আর সুবাসে। আকবর বাদশার রোজের খাবারে ডাল পাঁচমেল থাকতই। শাহজাহানের সময়ে শাহি ডাল পাঁচমেল এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এক মাস ধরে ডাল উৎসব হত। কঠোর নিরামিষাশী সম্রাট ঔরঙ্গজেব মাঝেমধ্যেই ডাল পাঁচমেল হুকুম করতেন। ঠিক যেমন তাঁর আগের বাদশারা শূলপক্ব মাংসের হুকুম করতেন।

এ রান্নার মূল ম্যাজিক ডাল মেশানোয়, আর তার সম্বরার বৈচিত্রে। ওস্তাদ কারিগরেরা নাকি এই ডাল একশোরও বেশি স্বাদে রান্না করতে পারতেন। তাই ডালের নামী শেফদের দাম আর মেজাজ ছিল আকাশছোঁয়া। নবাব আসফউদ্দৌলা সেই সময় পাঁচশো টাকা মাস মাইনেতে এক ডালের রাঁধুনিকে নিয়োগ করেন! রাঁধুনি আবার শর্ত দিয়েছিল, নবাবের ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হলে আগের দিন জানাতে হবে, আর ডাল তৈরি হয়েছে খবর পাওয়া মাত্র নবাব এসে দস্তরখানে বসবেন। এক দিন আসফউদ্দৌলা ডাল খেতে চাইলেন, এবং পরের দিন শেফবাবুটি গিয়ে যথাসময়ে খবর দিল— খানা তৈরি। কিন্তু নবাব তখন সভায় ভারী ব্যস্ত, তাই তিন বার খবর দেওয়াতেও এলেন না। অবশেষে যখন এলেন, সেই শেফ রান্না করা সমস্ত ডাল নিয়ে হুড়হুড় করে একটা শুকনো গাছের তলায় ঢেলে দিল, আর তক্ষুনি কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গেল।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

সুন্দরবনের সুন্দর সেই স্কুল

১৯৭০-এর জানুয়ারির এক বিকেলে সালকিয়ার বাড়িতে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এল। মাসখানেক আগে অনার্স পাশ করেছি, কয়েকটা স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষক পদের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। দেখি, চিঠি পাঠিয়েছেন কুমীরমারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের হেডমাস্টার, ঠিকানা চব্বিশ পরগনা (তখনও দু’ভাগ হয়নি), সুন্দরবন এরিয়া। সাত তারিখে শিয়ালদার প্যারাডাইস লজ-এর আট নম্বর রুমে ইন্টারভিউ।

সালকিয়া থেকে ২৪ নম্বর স্টেট বাস শিয়ালদা হয়ে ট্যাংরা যেত। ইন্টারভিউয়ের দিন অতি উৎসাহে ভোর ছ’টায় চেপে পড়লাম, গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম সাতটার আগেই। দুরুদুরু বুকে কলিং বেলে চাপ দিতে দরজা খুলে গেল। সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোক, ইঙ্গিত করলেন ভেতরে আসতে, তার পর টুথব্রাশ নিয়ে ঢুকে গেলেন বাথরুমে। ঘরে একটা খালি ডবল বেড, পাশেই আর একটা সিংগল বেডে মশারি টাঙিয়ে কেউ শুয়ে। ভদ্রলোক বাথরুম থেকে বেরোলেন, সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো পরা, গায়ে শাল জড়ানো। হাঁক ছাড়লেন, ‘দেবেন, ওঠো, ঘরে অতিথি এসেছেন, টেবিলে কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে দাও।’ আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, ‘একেবারেই ছেলেমানুষ দেখছি, গ্রামে থাকার অভ্যেস আছে?’ জানালেন, তিনিই কুমিরমারি স্কুলের প্রধানশিক্ষক, ওখানে কেউ ইন্টারভিউ দিতে যায় না, তাই নিজেই কলকাতায় এসেছেন বায়োলজি আর ফিজিক্সের শিক্ষক নিতে। বললেন, ‘ওখানে গিয়েই ফেরত আসবে না তো? অন্তত মাস কয়েক থাকবে তো?’ আমি অবাক: কেন? চাকরিটা কি স্থায়ী পদের জন্য নয়? উনি বললেন, ‘অবশ্যই, তুমি যত দিন খুশি ওখানে থাকতে পারো।’ আমি আমার মার্কশিট আর সার্টিফিকেট ওঁকে দিতে অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘ওগুলো লাগবে না। জয়েনিং-এর পর দেখে নেব।’ স্কুলের প্যাডের একটা পাতায় খসখস করে লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘তোমার নিয়োগপত্র।’ আমি তো অবাক, ইন্টারভিউ? উত্তর এল, ‘হয়ে গেছে।’ ইন্টারভিউ দিতে এসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নেশাগ্রস্তের মতো বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।

চার দিন পর, হাসনাবাদ-সাতজালিয়া রুটে দুপুর দুটোর লঞ্চ ধরে রাত আটটায় শরীর হিম করা ঠান্ডায় ঘন অন্ধকারের মধ্যে নামলাম কুমীরমারিতে। ঘাট, জেটি কিচ্ছু নেই, কাদা। সারেং আশ্বাস দিল: ভয় পাবেন না, লঞ্চের ভোঁ শুনে কেউ ঠিক ঘাটে এসে পড়বে। সত্যি দেখি, লণ্ঠন হাতে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। সেই ‘দেবেন’। এগোলাম ওর সঙ্গে। ঘাসপাতার মধ্য দিয়ে পায়ে চলার পথ, বড় একটা পুকুর, ডান দিক ঘুরতেই স্কুল বিল্ডিং। আবছা লণ্ঠনের আলোয় দেখি, সেই হেডমাস্টারমশাই এগিয়ে আসছেন। পাশের করিডরে হাত-পা ধুয়ে আসতে, বললেন, ‘একটু চা খাবেন?’ ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। দেবেন এক কাপ চা এনে দিল। হেডমাস্টার বললেন, ‘পুকুরঘাটের দিকে কোয়ার্টার্সে আপনার শোওয়ার ব্যবস্থা, খেয়ে শুয়ে পড়ুন আজ তাড়াতাড়ি।’

ছবি সৌজন্য: অনিন্দ্য মিস্ত্রী

সকালে ঘুম ভাঙল মেয়েলি কণ্ঠের ডাকে: ‘মাস্টারমশাই উঠুন, চা এনেছি!’ ছিপছিপে তরুণী, সিঁথিতে হালকা সিঁদুর। বলল, ‘এখানে বাথরুম পাবেন না। বারান্দায় বালতিতে জল আছে, হাতমুখ ধুয়ে নিন। স্নান পুকুরে।’ জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? মেয়েটি হাসল, ‘আমি রত্না, পরে আমার পরিচয় পাবেন, আসি।’ এর মধ্যে দু’এক জন মাস্টারমশাই এলেন, আলাপ হল। আমারই বয়সি, ফিজিক্সের এক শিক্ষকও দু’দিন আগে এসেছেন। ঘরে দুজনের খাবার এল, খেয়ে স্কুলে এলাম। প্রেয়ার শুরুর তোড়জোড় চলছে, কিন্তু ছেলেমেয়ে কারও সে দিকে মন নেই, সবার চোখ নতুন দুই শিক্ষকের দিকে। হেডমাস্টারমশাই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সবাইকে যে যার ক্লাসে যেতে বললেন। তবু কারও পা সরে না। আমরা ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছিলাম। এর আগে বাড়ি বাড়ি টিউশনি পড়িয়েছি, কিন্তু এত ছাত্রছাত্রী, এত বড় একটা স্কুল তো এই প্রথম! নিজেদের ভিআইপি মনে হচ্ছিল।

প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস জেনারেল সায়েন্সের, ক্লাস টেন। ঢুকেই দেখি, ফার্স্ট বেঞ্চে রত্না। খুবই অবাক হলাম। পরে জানলাম, রত্না এ স্কুলেরই ইতিহাসের জনপ্রিয় শিক্ষক প্রদীপবাবুর স্ত্রী, ক্লাস টেন-এ পড়ে। তখন আর্টস বা কমার্সের ছাত্রছাত্রীদেরও টেন পর্যন্ত ‘কোর ম্যাথ’ আর ‘জেনারেল সায়েন্স’-এ পাশ করা বাধ্যতামূলক ছিল। আমাকে ক্লাস নিতে হত সব শাখাতেই। ক’দিনের মধ্যেই সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। সহজ-সরল, আন্তরিক সবাই। তখন টেলিভিশন আসেনি, ওই প্রত্যন্ত এলাকায় রেডিয়োরও চল ছিল না। কলকাতা থেকে আসা তরুণ শিক্ষককে কাছে পেয়ে ওরা পড়ার বইয়ের বাইরের খবর জানতে মুখিয়ে থাকত।

নদীর দু’পাড়ে এক-মানুষ সমান উঁচু মাটির বাঁধ, যাতে নদীর নোনা জল ধানখেতে না ঢোকে। বাঁধের ওপর দিয়েই এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া। শীতকালে ধান কাটার পর লোকে মুড়োভাঙা মাঠ ব্যবহার করত শর্টকাট হিসেবে। ছাত্রছাত্রীরা কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে স্কুলে আসত। আরও দূরের যারা, তাদের অনেকে শালতি (ছোট, লম্বাটে নৌকো) চড়ে নিজেরাই দাঁড় টেনে যাওয়া-আসা করত। ছুটির দিনে শালতি চেপে জঙ্গল দেখতে গেছি, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!

অধিকাংশ মানুষই খুব গরিব, কাজ বলতে বছরে তিন মাস ভূস্বামীদের খেতে জনমজুরি, বাকি সময় নদী আর খালবিলে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ধরা, বা গভীর সুন্দরবনে ঢুকে মধু, মোম, কাঠ সংগ্রহ করা— বাঘ আর কুমিরকে যুঝে। ঘর বলতে বাঁধের ধারে কোনও রকমে মাটির দেওয়াল তুলে খোড়ো ছাউনি দিয়ে খাড়া করা কাঠামো।

পাঁচ মাস চাকরির পর এক দিন রাত দুটোর লঞ্চে চেপে ক্যানিংয়ে নামি, সেখান থেকে কলকাতা। কাউকে না জানিয়েই চলে এসেছিলাম, ক’মাসেই এত জনপ্রিয় হয়েছিলাম যে ছাত্রছাত্রী আর মাস্টারমশাইদের চোখের সামনে দিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে আসতে বিবেকে বাধছিল। কিন্তু ছেড়ে আসার কারণও ছিল। হেডমাস্টারমশাই পরে বাড়িতে এসে বাবাকে বুঝিয়েছিলেন, আমি যাতে ফিরে যাই। যাইনি, মাস্টারমশাইকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলাম। তবু সেই জলজঙ্গলময় প্রকৃতি আর সেই স্কুল এখনও মনে পড়ে।

অমিয় কান্তি দাশ, বালি, হাওড়া

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy