Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বছর অক্টোবর মাসের একত্রিশ দিনই পুজোর ছুটি ঘোষণা করল। সরকারি আদেশনামায় বলা হয়েছে, এ বার থেকে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সমস্ত পুজো— অর্থাৎ সরস্বতী, লক্ষ্মী, কালী, শিব, দুর্গা, ভৈরব, কাত্যায়নী, মনসা, শনি, সন্তোষী মা, হনুমান, গণেশ, কার্ত্তিক, লোকনাথ বাবা, বালক ব্রহ্মচারী, তারকনাথ; এ ছাড়া জামাইষষ্ঠী, ছট, দোল, ঝুলন, রথযাত্রা, রাবণবধ, ভাইফোঁটা, বিশ্বকর্মা, জন্মাষ্টমী— সব রকম ধর্মোৎসব অক্টোবর মাসেই সেরে ফেলতে হবে। এই সিদ্ধান্তে বেজায় ক্ষুব্ধ বঙ্গীয় পুরোহিত সমাজ (আদি)। তাঁরা কালীঘাট মাতৃমন্দিরে এক প্রেস কনফারেন্সে জানিয়েছেন যে, সমস্ত পুজোই তিথি, নক্ষত্র মিলিয়ে পাঁজির শাস্ত্রীয় নিয়মমতে হয়। অক্টোবর মাসে সরস্বতী পুজো কখনওই হতে পারে না। তাই তাঁরা রাজ্য সরকারের এই নির্দেশ কোনও মতেই মানবেন না। প্রয়োজনে কলকাতা থেকে দিল্লি মিছিল করবেন। অবশ্য এই সিদ্ধান্তে বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলি দারুণ খুশি। এক মাস ধরে পুজো চললে প্যান্ডেল-খরচ অনেক বেঁচে যাবে। কোনও কোনও পুজো কমিটি বলেছে, চার দিনেই সব দেবদেবীর পুজো সেরে ফেলে বাকি ছাব্বিশ দিন জলসা, হনুমান চালিসা, কীর্তন, কবিগান, যাত্রা, বলিউড-টলিউডের শিল্পীদের লারেলাপ্পা গান ও উদ্দাম নেত্য হবে। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা। এমনিতেই তাঁদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার শতাংশ, তাই এক মাস লম্বা ছুটি পেয়ে তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছেন। এলটিসি নিয়ে অনেকেই সিঙ্গাপুর, লন্ডন যাবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজ্য সরকার আগামী বছরে আরও এক মাস ছুটি বাড়ানোর কথা ভাবছে। ধাপে ধাপে বারো মাসই ছুটি ঘোষণা করা হতে পারে। কলকাতা সহ সারা রাজ্যে সরকার হোর্ডিং-ফ্লেক্স টাঙিয়ে বড় বড় করে লিখেছে— ‘পুজোর এক মাস বিন্দাস থাকুন, মস্তিতে থাকুন। নমস্কার, সালাম।’

তুষার ভট্টাচার্য, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

খেয়ে নে, নইলে গুলি করে দেবে!

১৯৬৯। পুজো সবে শেষ হয়েছে, সে দিন দ্বাদশী। বন্ধুদের জোর আড্ডা চলছে ক্লাব ঘরে, হঠাৎ চার জন ছেলে এসে সটান ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের মধ্যে সিদ্ধার্থ কার নাম?’ গম্ভীর, ভরাট গলা। তখন ভরা নকশাল আন্দোলনের সময়। অজানা আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি তো রাজনীতি করি না, তবে আমার খোঁজ করছে কেন? বন্ধুরাও হকচকিয়ে গিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কোনও মতে ঢোক গিলে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি সিদ্ধার্থ। আমাকে আপাদমস্তক দেখে, ওদের মধ্যে এক জন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি অমুক নাটকে জ্যোতির রোল করেছিলেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ করেছিলাম, ক্লাবের অ্যানুয়াল ফাংশনে।’ ছেলেটি বাকি সবার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি আজ সন্ধে সাতটার মধ্যে বাগবাজার সর্বজনীনের মাঠে চলে আসবেন। আমাদের নাটক আছে ওখানে, ওই নাটকটাই। জ্যোতির পার্ট যে করছিল সে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আপনাকে পার্টটা করে দিতে হবে।’ গলায় যেন হুকুমের সুর।

ছেলেগুলোর চেহারা একদম ভাল লাগছিল না, তবু ভয়ে না বলার সাহসও হল না। একা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বন্ধু সজলকে (যে সম্প্রতি ‘পিকু’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছে) অনেক বলেকয়ে রাজি করালাম। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর নাটকের বইটাও আলমারির পিছনে পাওয়া গেল। সারা দুপুর ধরে মিনি মহলা চলল ক্লাব ঘরে, বন্ধুরা খুব সাহায্য করল। ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে পড়লাম।

প্যান্ডেলের কাছে গিয়ে দেখি, কেউ কোত্থাও নেই। মঞ্চের সামনের দিকে শতরঞ্চি পাতা, তার পিছনের দিকে সারি সারি চেয়ার এ দিক-ও দিক ছড়ানো। ও দিকে মাইকের তার জোড়ার কাজ চলছে, আর মাঝে মাঝে মাইক টেস্টিং-এর কানফাটানো আওয়াজ। চিনিও না কাউকে, এক পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল, ‘ও, আপনারা এসে গেছেন, খুব ভাল। আগে একটা ডান্স প্রোগ্রাম আছে, সেটার পর আমাদের নাটক। একটাই মেকআপ রুম, তাই নাচের ব্যাপারটা শেষ না হলে আমাদের মেকআপ শুরু হবে না। আপনারা চা-টা খান, মেলা ঘুরে দেখুন, আমরা সময় হলে ঠিক ডেকে নেব।’ বোঝো ঠ্যালা, এবার নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে চা খেতে হবে! সঙ্গে টাকাও বেশি ছিল না, তাই দু’কাপ চা আর দুটো করে বিস্কুট খেয়ে খিদে মেটালাম দুই বন্ধু।

কিরণ মৈত্রের লেখা নাটক ‘অন্য ছায়া’। এই নাটকই অভিনীত হয়েছিল সেই দিন,
বাগবাজার সর্বজনীনের মাঠে। ছবি সৌজন্য: সজল ভট্টাচার্য

রাত প্রায় সাড়ে ন’টায় নাটক শুরু হল। একটা দৃশ্যে ছিল— জ্যোতির একটা চোখ বোমায় নষ্ট হয়ে যাবে। সাজঘরে গেলাম বোমার আঘাতের মেকআপ সারতে, মেকআপম্যান কী একটা তলতলে জিনিস আমার চোখে লাগাতে এল। আমি বললাম ‘কী এটা?’ যে ছেলেগুলো সকালে এসেছিল তাদের মধ্যে এক জন ওখানে ছিল। এক গাল হেসে সে বলল, ‘পাঁঠার চোখ দাদা, একদম ন্যাচারাল দেখাবে বলে মাংসের দোকান থেকে এই একটু আগে গিয়ে নিয়ে এসেছি। নিন নিন, কথা না বাড়িয়ে লাগিয়ে নিন দেখি!’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। করুণ মুখে সজলের দিকে তাকাতে ও ফিসফিস করে বলল, ‘পরে নে, নইলে গুলি করে দেবে।’ অগত্যা লাগিয়ে নিলাম। কী বিকট গন্ধ!

যে ভাবে নাটক চলছিল, মনে হচ্ছিল, শেষ হতে হতে মাঝরাত হয়ে যাবে। একটা টুলে পরিচালক মশাই একটু চুকচুক খেয়ে ঝিমোচ্ছিলেন। সজলকে বললাম, চল, দাদুকে ম্যানেজ করি। আমি যা বলার বলব, তুই শুধু পাশ থেকে সায় দিয়ে যাবি। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি কোনও মতে চোখ তুলে তাকাতে বললাম, দাদা, শেষের দিকটায় জ্যোতির যে সব জ্ঞানের কথা আছে সেগুলো কেটে দিন। এত রাতে পাবলিক এই সব জ্ঞান থোড়ি শুনবে, ক্ষেপে যাবে তো! উনি বললেন, ‘তাই? তা হলে কেটে দিই?’ স্ক্রিপ্ট টেনে নিয়ে জ্যোতির ডায়ালগগুলো সব কেটে দিতে লাগলেন। কাটা শেষ হতেই আমি কপিটা নিয়ে সজলকে বললাম, তুই গিয়ে প্রম্পটার দুজনকে স্ক্রিপ্টটা দেখিয়ে আমার ডায়ালগগুলো কেটে দে। মহানন্দে মেকআপ তুলতে সাজঘরে চলে গেলাম। মুখটুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়েছি, হঠাৎ কানের পাশে গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর, ‘এ কী, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? আরে আরে, ছুটছেন কেন, দাঁড়ান!’ সজল কাঁপা কাঁপা গলায় আমার কানে বলে উঠল, ‘দাঁড়া, নইলে গুলি করে দেবে!’ দুটো ছেলে এসে দুটো প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিল। আমরা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি, কী না কী থাকবে ওতে! পিঠে হাত পড়তে চমকে গেলাম। সকালের সেই ছেলেটি, হাসছে: ‘আপনি আমাদের এত উপকার করলেন আর এমনি এমনি চলে যাবেন? এই নিন ধরুন, খাবারের প্যাকেট এটা।’

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, রীতিমত ছুটছি। বাড়ি পৌঁছলে আজ কী আছে কপালে কে জানে। রাস্তা একদম শুনশান, ইতিউতি কয়েকটা কুকুর শুধু। বাগবাজার মোড়ে পৌঁছেছি, একটা পুলিশের জিপ হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে যেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ‘কী বাপার? এত রাতে? কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’ কটমট করে এক জনের প্রশ্ন। ভয়ে ভয়ে বললাম, বাড়ি ফিরছি স্যর, বিশ্বাস করুন স্যর, আমাদের নাটক ছিল বাগবাজার প্যান্ডেলে। আবার প্রশ্ন, ‘হাতে কী?’ বললাম, ‘খাবারের প্যাকেট স্যর, ওরা দিল।’ সঙ্গে সঙ্গে জিপের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল, ‘কই দেখি?’ দুজনে এগিয়ে দিলাম প্যাকেট দুটো। নির্লিপ্ত ভাবে প্যাকেট দুটো নিয়ে পিছনের লোকের হাতে দিয়ে বলল, ‘যা, বাড়ি যা। যা!’ হুস করে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল জিপ। সজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না, গুলি করেনি।’

সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী, দেশবন্ধুনগর, বাগুইআটি

sidsup07@gmail.com

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy