Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩

ডাল-বাটি-চুরমা

পিনাকী ভট্টাচার্য

বা প্পা রাওয়াল নামটা একটুও চেনা চেনা লাগছে? না? তা হলে, অবন ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’র বাপ্পাদিত্যকে তো চেনেন? ইতিহাসের পাতায় এই বাপ্পাদিত্যই হলেন রাজস্থানের কিংবদন্তি যোদ্ধা, আর মেওয়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা বাপ্পা রাওয়াল। তিনি আবার শিলাদিত্য আর গোহের বংশধরও বটে। মোরি বংশের মান রাজার কাছে চিতোর উপহার পাওয়ার আগে পর্যন্ত বাপ্পা তাঁর যাযাবর যোদ্ধাবাহিনী নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই যোদ্ধারা আটাতে উটের দুধ আর ঘি দিয়ে এক মণ্ড তৈরি করত, আর তার পর সেই মণ্ড থেকে ছোট ছোট মণ্ড করে বালির পাতলা আস্তরণের তলায় রাখত, রোদ পাওয়ার জন্যে। দিনের শেষে যখন তারা ফিরত, তত ক্ষণে সূর্যের তাপে সেই ছোট মণ্ডগুলো সেঁকা হয়ে গিয়েছে। সেইগুলোকে ঘিয়ে ডুবিয়ে, বা ভাগ্য ভাল হলে ঘোল বা দইতে ডুবিয়ে, খিদে মিটিয়ে প্রকৃতির কোলে মাথা দিয়ে রাতে শুতে যেতেন বাপ্পা রাওয়াল আর তাঁর বাহিনী। এই মণ্ডটাকেই এখন আমরা ‘বাটি’ বলি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরুপ্রান্তর থেকে একেবারে রাজপ্রাসাদে এসে উঠল বাটি। তত দিনে আর তা বালির তলায় রেখে সেঁকতে হয় না। বিশেষ উনুন তৈরি হয়ে গেছে তার জন্য, কারণ বাটি তার মেঠো স্বাদ নিয়ে তত দিনে দারুণ জনপ্রিয়। মাঠে-ময়দানে যোদ্ধাদের খাইয়েদাইয়ে শক্তি-বল বাড়িয়ে সে রাজপুত স্বাভিমানের প্রতীকও বটে।

রাজবাড়ির মানুষদের তৃপ্ত করতে বাটি-র সঙ্গী হল পাঁচমেল ডাল (ঠিক গত পর্বেই যার সঙ্গে আলাপ হয়েছে)। এই ডালও মেওয়ার ঘরানারই, যেখানে এই বাটির উৎপত্তি। তবু, সেই ঘিতে ডুবিয়ে আর ঘোলে চুমুক দিয়ে বাটি খাওয়া আজও একই রকম জনপ্রিয়।

চুরমা এসেছে আরও পরে। লোককথা বলে, যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে ভয়ে জড়সড় এক রাঁধুনি অন্যমনস্ক হয়ে নাকি বাটি-র ওপর চিনির রস ঢেলে দেয়, আর সেখান থেকেই চুরমা-র জন্ম। অন্য মত বলে, রাজপুত গিন্নিরা বাটি বানিয়ে, সেটাকে টাটকা রাখার জন্য আর সুস্বাদু করার জন্য, তা চিনির বা গুড়ের জলে ডুবিয়ে রাখতেন। তা-ই হল আজকের চুরমা। এ জিনিসটি পাতে না পড়লে এখন ডাল-বাটি খাওয়াই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পাঁচমেল ডালের সঙ্গে আর একটা মিল, তার মতোই, ডাল-বাটি-চুরমাও মুঘল দরবারে ঢুকেছিল রানি জোধাবাইয়ের হেঁশেল থেকে।

পূর্ব ভারতের লিট্টি বাটিরই তুতো-ভাই। এরও স্বাদ বাড়িয়েছে মাটির গন্ধ। ইবন বতুতার লেখায় পাওয়া যায়, মগধে সূর্যের তাপে আটার মণ্ড সেঁকা হত। বাটি আর লিট্টির উপকরণ আশ্চর্য রকম ভাবে এক। শুধু লিট্টিতে উটের দুধ থাকে না, থাকে ছাতুর পুর।

এবং এর সঙ্গেও যুদ্ধের গভীর সম্পর্ক। তবে এ হল সিপাই বিদ্রোহের কথা। বাটির মতোই লিট্টি বানাতেও কোনও বাসনের দরকার পড়ে না। জলও লাগে সামান্যই। তাই তাঁতিয়া টোপি, রানি লক্ষ্মীবাইয়েরও ভারী প্রিয় খাবার হয়ে উঠেছিল লিট্টি। পথে চলতে চলতেই লিট্টি বানানো যেত, থেমে কোথাও রান্নার জন্য ঘাঁটি গাড়তে হত না, ফলে ধরা পড়ার ভয় থাকত না। লিট্টি দু’তিন দিন ধরে খাওয়া যেত, বাটির চেয়ে অনেক নরমও হত।

ডাল-বাটি-চুরমা বা লিট্টি, দুটোই আজ ডেলিকেসি। এথনিক খাবার হিসাবে এদের জনপ্রিয়তার পারদ চড়েই চলেছে। কারণ এদের স্বাদে-আহ্লাদে এখনও সেই নরমসরম মাটিরই গন্ধ, যা বিরিয়ানি-কোর্মার গুরুভোজনে কখনওই পাওয়া যায় না।

ছবি: শুভেন্দু চাকী

সৌজন্য: শেফ প্রদীপ রোজারিও

pinakee.bhattacharya@gmail.com

তোমাদের কিছু ঘুঁটে আমি দিয়ে দিই?

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

এক সময় ‘পশ্চিমবঙ্গ সমাজসেবা সমিতি’ নামে একটি সংস্থার অস্তিত্ব ছিল। উত্তর কলকাতার শ্যামপার্কের কাছে ছিল তার অফিস। ওই সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন অনন্ত কবিরাজ। ধুতি, হাত-গোটানো ফুলশার্ট পরতেন— এই শার্টকেই হেমন্ত শার্ট বলা হত। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এখনও এ রকম শার্ট পরেন। কবিরাজ জেঠা অকৃতদার ছিলেন। ছোট দোতলা বাড়িটা বোধহয় পৈতৃক ছিল। নিজে এক তলায় একা থাকতেন, একটা সাইকেল ছিল, ইকমিক কুকারে রান্না করতেন।

উনি সকালবেলাটায় দুধ বিলি করতেন। সমাজসেবা সমিতির মাধ্যমে বিদেশ থেকে গুঁড়ো দুধ সাহায্য হিসেবে আসত। উনি ঘুরে ঘুরে দুঃস্থ-রুগ্ন মানুষদের খুঁজে বের করে দুধের কার্ড করিয়ে দিতেন। এলাকায় কেউ মারা গেলে শ্মশানে যেতেন, বিয়েতে কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করতেন। নিত্যদিন মৃত্যু কিংবা বিবাহাদির মতো ব্যাপার ঘটত না বলে, সমাজসেবায় ‘পুষ্টি বাকি’ থাকত বলে মনে হওয়ায়, হাতে চটের আসন নিয়ে পোস্ট অফিসে যাওয়া শুরু করলেন। তখন অনেক নিরক্ষর। মানি অর্ডারের ফর্ম ও চিঠি লিখে দিতেন। তখন চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে অনেক বিহারি শ্রমিক ছিল বলে হিন্দিটাও শিখতে হয়েছিল। সন্ধের পর অন্য সমাজসেবা না থাকলে ঘরে বসে ধুতি আর হাফহাতা গেঞ্জি পরে কবিরাজি করতেন।

পোস্ট অফিসের কিছু লোক কবিরাজ জেঠাকে হেনস্থা করেছিল। কিছু লোক পয়সা নিয়ে ফর্ম ও চিঠি লেখার কাজ করত। কবিরাজ জেঠা বিনা পয়সায় করতেন। ওরা আগে অনেক বারই ওখানে বসতে নিষেধ করেছিল, শোনেননি। এ বার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল, চড়-থাপ্পড়ও। এর পর থেকে আর পোস্ট অফিসে না গিয়ে বাড়ি বসেই এ সব করতেন। বাড়ির বাইরে লিখে দিয়েছিলেন— ‘এখানে বিনামূল্যে অক্ষরকর্ম করা হয়।’

এক দিন বাবার সঙ্গে সন্ধেবেলায় কবিরাজ জেঠুর কাছে গেলাম পিছন-কুটকুটির বড়ির জন্য। হয়েছে তো কুচো কৃমি, কিন্তু উনি আমার নাড়ি টিপে বললেন— পিত্ত প্রাবল্য, বড় চঞ্চল মতি। বাবা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এমন সময় এক জন বিহারি ঢুকলেন, কাঁধে গামছা। এ বার কবিরাজ জেঠা নিজেই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ‘আরে, আও রামদাস। বিবি কা খত আ গিয়া?’ আমাদের বললেন, একটু বাইরে যেতে হবে। প্রাইভেট ব্যাপার। ওর স্ত্রীর পত্র এসেছে, পড়ে উত্তর লিখে দিতে হবে।

পোস্ট অফিসের পরিবর্তে বাড়িতে বসেই আরও ভাল সমাজসেবা হচ্ছিল। জনসমক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মনের কথা আদান-প্রদান করা যেত কি? কবিরাজ জেঠার প্রেমপত্র লিখনের চাহিদা এত বেড়ে যায় যে কবিরাজি বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তখন ‘অক্ষরকর্ম করা হয়’-এর তলায় সময় লিখে দিয়েছিলেন: সকাল দশটা হইতে বেলা একটা।

দুপুরে একটু ঘুমোতেন। বোধহয় ‘আরাম হারাম হ্যায়’ এবং ‘দিবারাত্রি কুঅভ্যাস করহ বর্জন’ ইত্যাদি মনীষী বচনের প্রভাবে মনে হল দ্বিপ্রহর কেন বৃথা যায়? সমাজসেবার জন্য দুপুরবেলাটা প্রকৃষ্ট সময় নয়। ‘বিনামূল্যে ছাত্র পড়াই’ লিখলেও দুপুরে কেউ আসবে না। কী করা যায় ভেবে সাইকেল পরিক্রমায় লক্ষ করলেন, এই সময়টাতেই রেলের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা ঘুঁটে দেয়। উনি প্রস্তাব করলেন, তোমাদের কিছুটা ঘুঁটে আমিই না হয় দিয়ে দিই? সত্যিই তিনি ঘুঁটে দিতে শুরু করেছিলেন। ঘুঁটেউলিদের প্রাচীরনীতি রাজনৈতিক দলের মতো গা-জোয়ারিতে চলে না। ওরা মিলেমিশে প্রাচীর ভাগ করে ভোগ করে। অনন্ত কবিরাজের সমস্যা হল, উনি কার প্রাচীরে ঘুঁটে দেবেন? মনে হয়, ঘুঁটে-সেবা নিয়ে একটা পক্ষপাতিত্ব ঘটেছিল, এবং কোনও মহিলার সঙ্গে একটা হালকা ঘুঁটে-সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। নইলে বাবা-জেঠাদের কথাবার্তায় শুনব কেন— কবিরাজ মশাইয়ের মাথায় একটু ছিট আছে বুঝতাম, কিন্তু এই বয়সে ঘুঁটেউলিদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করবে বুঝিনি। কবিরাজ-জেঠা ঘুঁটেউলিদের সবাইকেই নাকি দুধের কার্ড করে দিয়েছিলেন।

কিছু দিন পর বিদেশ থেকে গুঁড়ো দুধ আসা বন্ধ হয়ে গেলে সকালটা শূন্য হয়ে যায় অনন্ত কবিরাজের। কিছু দিনের মধ্যেই ওঁর স্ট্রোক হয়। তখন ওঁর দেখাশুনো করত এক ঘুঁটে-নারী। ওঁর বাড়ির বাইরের দেওয়ালও তখন ঘুঁটেময়।

আমি কলেজে ঢোকার আগেই উনি মারা যান। বাড়িটা ভাড়াটেদের দখলেই চলে যায়। এর পর ওই বাড়িটার কী হাতবদল হয়েছে, কী ভাবে হয়েছে, জানি না। চল্লিশ বছর কেটে গেছে। ওই বাড়িটা এখনও আছে। জানালায় লোহার শিকের বদলে গ্রিল। দেওয়ালে যেখানে লেখা ছিল ‘এখানে বিনামূল্যে অক্ষরকর্ম করা হয়’, সেখানেই লেখা আছে ‘এখানে ফ্ল্যাট-গ্যারেজ-দোকানের সন্ধান দেওয়া হয়।’

বুঝলাম, নতুন কোনও ‘সমাজসেবী’ এই গোকুলে বাড়ছে এখন।

swapnoc@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy