Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩

মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে সারা রাজ্য জুড়ে বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে ‘ট্যাটু ফেস্টিভাল’ পালন করা হল। লতাপাতাফুল, পশুপাখি, ভূত-প্রেতের ছবি আঁকা মানব-শরীরকে কেন্দ্র করে এই বিশাল মেলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্যের ‘উৎসব বিকাশ যোজনা’র অন্তর্গত একটি জনসচেতনতামূলক প্রকল্প। তরুণ-তরুণীদের বিপুল সমর্থনে এটি ‘শিশু ধরো শিক্ষা ভরো’ প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্রীয় সাহায্য পেয়েছে। এমনিতেই তরুণ প্রজন্মের ট্যাটু-উন্মাদনার জেরে রাজ্যের সমস্ত কাপড়ের কল ও মিলগুলি আজ বন্ধ। বহুজাতিক ব্র্যান্ডের রমরমা, পোশাক আমদানির খরচও আর নেই। ছেলেমেয়েরা এখন লজ্জানিবারণে প্রয়োজনীয় স্বল্পবাসটুকু পরে, বাকি শরীর বিচিত্রবর্ণের ট্যাটুতে ভরিয়ে রাখে। রাজপথ জুড়ে ট্যাটু-প্রেমীদের গঙ্গাভিমুখী মিছিল দেখার জন্য সারা দেশের মানুষজন, মিডিয়া এবং বিদেশি প্রতিনিধিরা ভিড় করেছেন। রাজ্যের বন্ধ হওয়া মিলগুলিকে ‘ট্যাটু আর্ট গ্যালারি’তে পরিণত করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের শিল্পপতিরা ট্যাটুশিল্পে বিপুল লগ্নির আগ্রহ দেখিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী এই ‘ট্যাটু উৎসব’কে কেন্দ্র করে ইন্ডোর স্টেডিয়ামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। যাদের ট্যাটুতে সব থেকে বেশি নীল-সাদা রং থাকবে, তাদের মধ্যে থেকে সরকারি চিত্রশিল্পীরা ‘ট্যাটু ভূষণ’ ও ‘ট্যাটু বিভূষণ’ বেছে নেবেন। তাদের বারবার ট্যাটু করার ও পুরনো ট্যাটু লেজার করে তুলে নতুন ট্যাটু করার খরচ সরকার আজীবন বহন করবে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, মহালয়ার দিনটি এ বার থেকে ‘বিশ্ববঙ্গ ট্যাটুদিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। এ দিন ট্রাফিক সিগনালে বাজানো হবে: ‘এই তো আমার আপনারই এই ‘হুল’ ফোটানোর মাঝে/ তারে দেখি নয়ন ভরে নানা রঙের সাজে।’ মূল গানের ‘ফুল’ শব্দটি বদলে ‘হুল’ শব্দটি বসিয়ে রবীন্দ্রসংগীতটিকে ট্যাটু-উৎসব উপযোগী করে নিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। গানটি গেয়েছেনও তিনিই।

বিদ্যুৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বেলেঘাটা, কলকাতা

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

প্রঃ/উঃ

আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: মহিষাসুর

অগলি বার ‘মহিষ’ সরকার

শান্তনু চক্রবর্তী

[এই শহরতলির এক ম্যাটমেটে পুজোর টিমটিমে প্যান্ডেলের পেছন দিকটা কেন বাছলেন কে জানে! আমি পৌঁছে দেখি, একটা খোঁটা গেড়ে মোষটাকে ‘পার্ক’ করছেন! ঘাম-জবজব আদুড় গায়ে থোলো-থোলো সবজেটে মাস্‌লগুলো ঠেলেঠুলে ফুলে ফুলে উঠছে!]

প্রতিবেদক: আপনি মোষের পিঠেও চড়েন নাকি? আমরা তো জানতাম মোষ আপনার ক্যামোফ্লাজ— দুর্গার সঙ্গে গেরিলা ফাইটিং-এর স্ট্র্যাটেজিক কৌশল?

মহিষাসুর: দেখছিস, মিডিয়া কত ভুল জানে! আরে, মোষ আমার ব্র্যান্ড ইউএসপি, আমাদের অসুরকুলের শৌর্য-বীর্য-ইজ্জতের প্রতীক। সিনেমা-সিরিয়ালে দেখিসনি, অসুরের কস্টিউম মানেই শিং-লাগানো হেলমেট? শোন, ফ্যাসিস্ট দেবতারা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল না করে, স্বর্গে ঠিকঠাক ইলেকশন করালে মোষ-ই হত আমাদের নির্বাচনী সিম্বল। বিষ্ণুর সিংহাসনের পায়ায়, ইন্দ্রর প্রাসাদের সদর দরজায়, এমনকী নারদের ঢেঁকির গায়ে অবধি পোস্টার চিপকে দিতাম, ‘সকাল সকাল ভোট দিন, মোষ চিহ্নে ছাপ দিন!’ কৈলাসে শিবঠাকুরের গাঁজার ঠেকের সামনে তিরিশ ফুট কাট-আউট: মোষের পিঠে আমি: নীচে স্লোগান ‘অগলি বার, মহিষ-সরকার!’ নৃতত্ত্ব, সমাজততত্ত্ব পণ্ডিতরা টোটেম-মোটেম অনেক কিছু বলবে। আসলে আমরা অসুররা মোষের মতোই সিধাসাধা গোঁয়ার, তাই দেবতারা চান্স পেলেই ঠকিয়ে নেয়।

প্রতি: আপনি দেবতাদের ফ্যাসিস্ট বলছেন, কিন্তু আপনারাই ওদের কিলিয়ে, খেদিয়ে স্বর্গছাড়া করেছেন! সেটা কীসের গণতন্ত্র?

মহিষাসুর: আরে সে তো অমৃতের বাঁটোয়ারা নিয়ে ওদের দুগ্গিবাজির জন্য। ঘেমে-নেয়ে সমুদ্র ছেঁচে অমৃত তুলব আমরা, আর তাতে চুকচুক চুমুক মেরে অমরত্বের মস্তি করবে তোমরা? ইল্লি! মুনাফাখোর, পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া কোথাকার!

প্রতি: যাহ্ বাবা! এই বলছেন দেবতারা ফ্যাসিস্ট, আবার বলছেন বুর্জোয়া-মুনাফাবাজ— কোনটা ঠিক?

মহিষাসুর: এটা কোথাকার ভোঁদাই রে! বলি, মার্ক্স, লেনিন-টেনিনের রচনাবলি উলটে দেখেছিস? দেখলে জানতিস, ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদেরই বিকৃত রূপ। দেবতারা দিনের পর দিন উদ্বৃত্ত শ্রমের সঙ্গে আমাদের বুকের রক্ত চুষেছে, আখ মাড়াইয়ের মতো ছিবড়ে করে ছেড়েছে। প্রতিবাদ করলেই আমাদের নেতাদের শিব, বিষ্ণু, কার্তিক— কাউকে না কাউকে লাগিয়ে খতম করেছে! সে সব সুপারি কিলিং-এর এক-একটা বৃত্তান্ত এক-একখানা পুরাণ হয়েছে। পড়ে দেখবি, সব ক্ষমতার বয়ানে ঠাসা! লাইনে-লাইনে ঢপবাজি। দেবতারা যখন খুন-জখম করছে, সব ‘ন্যায়ের’ পক্ষে, আর অসুরদের কাজ-কারবার সব সন্ত্রাস! পুরো আমেরিকান মিডিয়ার কায়দা। গল্পটা পাবলিককে বারবার খাওয়াতে খাওয়াতে সেটাই ‘সত্যি’ হয়ে ওঠে! চমস্কি পড়েছিস তো? এ-ও তা-ই। দেড়-দু’হাজার বছর ধরে একই বানানো কাহিনি শুনতে শুনতে লোকে বিশ্বাস করে, অসুর মানেই পাক্কা ভিলেন!

প্রতি: নিজেকে এত যে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত, ‘ভিকটিম-ভিকটিম’ প্রমাণ করতে চাইছেন, স্বর্গের দখল নেওয়ার পর তো আপনি আর আপনার লোকজন ‘ম’-মার্কা ফুর্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিয়েছিলেন, তার বেলা?

মহিষাসুর: ও তো বুর্জোয়া মিডিয়া, মানে দেবতা আর তাদের দালালদের বানানো শাস্ত্র-পুরাণের অপপ্রচার। হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি হয়েছিল। বিপ্লবের পরে কোথায় না হয়! কিন্তু দু-একটা বিচ্যুতির তিলকে তাল করে যা রটানো হয়েছে, সব আমাদের ইমেজ খারাপ করার চক্রান্ত।

প্রতি: তা হলে আপনি বলছেন, আপনার দল স্বর্গের দেবী, অপ্সরাদের লুট-টুট করে শ্লীলতাহানি গোছের কাণ্ড ঘটাননি?

মহিষাসুর: শোন্, এমন যদি কিছু ঘটেও থাকে, জানবি সেখানেও প্ররোচনাটা উলটো দিক থেকেই ছিল। দেবী-অপ্সরাগুলোই আমাদের সিডিউস করেছে। কেনই বা করবে না? অসুরদের সেক্স অ্যাপিলের সঙ্গে দেবতাদের তুলনা হয়? ওই তো কার্তিক: লাল্টু মার্কা মাকাল ফল! ইন্দ্র, গা-ভর্তি অভিশাপের মেচেতা! বিষ্ণু কর্পোরেট ঘ্যাম নিয়ে বৈকুণ্ঠের বাইরে পা-ই রাখেন না! ও দিকে শিবঠাকুরের কাছে কোনও মেয়ে যেচে ভস্ম হতে যাবে কেন? আর বাদবাকিরা, সব তো ‘লালিমা পাল (পুং)!’ অসুরদের পৌরুষ, জোশ, তাকত‌ দেবতাদের আছে নাকি! স্বর্গের মেয়েরা তাই আমাদের পাশেই ঘুরঘুর করে, আর দেবতারা হিংসেয় বুক ফেটে মরে। হীনম্মন্যতা, ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ওদের বাবরি চুলের ডগা থেকে গোড়ালির গোড়া পর্যন্ত চিড়বিড় করছে। হলফ করে বলতে পারি, এই যে মহিষাসুরকে খতম করতে সব্বাই দল পাকিয়ে ব্রহ্মার কাছে গেল, সেখানে ক্ষমতা বেদখলের শিরশিরানি ভয়টা ছাড়াও যৌন-ঈর্ষার ওই ষোলো আনা সুড়সুড়িটাও ছিল!

প্রতি: কিন্তু মহিষাসুর-রাজ খতম করতে এই যে দেবতাদের ‘অপারেশন দুর্গা’— আপনারা তার মোকাবিলা করতে পারলেন না কেন? এ দেবতা, ও দেবতার তেজ জমিয়ে তৈরি এক ‘সিন্থেটিক নারী’ আপনাদের গো-হারা হারিয়ে দিলেন!

মহিষাসুর: আরে ওই তেজ, শক্তি-ফক্তি সব মেটাফর! ‘দুর্গা’ আসলে দেবতাদের একটা গোপন জঙ্গি মিলিটারি জোট। অনেকটা ন্যাটো-র মতো। আমরা গরিব, প্রান্তিক, দলিত মানুষ। বড়জোর তির-ধনুক, লাঠিসোটা, বল্লম-খাঁড়া নিয়ে যুদ্ধ করতে পারি! অত বড়, অত অস্ত্রশস্ত্রওয়ালা মিলিটারি পাওয়ার-এর সামনে কী করব! তাও তো হার নিশ্চিত জেনেও ফাইটটা দিয়েছিলাম। তার জেরেই তো মহালয়ার ভোরে বীরেন ভদ্দরের চণ্ডীপাঠে অত নাটক! মহিষাসুর না থাকলে তোদের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র পালা জমত?

প্রতি: কী বলছেন মশাই? চণ্ডী-মাহাত্ম্য, মহিষাসুরমর্দিনী, সবটা নাটক বলছেন?

মহিষাসুর: আবার কী! আসল গল্পটা হল আর্য দেবতাদের দখলদারির বিরুদ্ধে দলিত-অসুরদের রুখে দাঁড়ানোর আখ্যান। তাকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়ে দুর্গা ছানাপোনা-সাঙ্গোপাঙ্গসুুদ্ধু তোদের ঠাকুরদালানে, বারোয়ারি প্যান্ডালে ত্রিশূল বাগিয়ে ‘দুর্গতিনাশিনী’র পোজ-এ দাঁড়িয়ে গেলেন। আর দুর্গতির নাম হল ‘মহিষাসুর’! দুর্গার ত্রিশূল আমার সবুজ রঙের বুকের ছাতিতে ঘ্যাঁচাত করে ঢুকে গেল আর গ্যালগ্যাল করে রক্ত বেরোতে লাগল। সেই থেকে ‘দুষ্কৃতী’ সেজেই যাচ্ছি! ইংরেজ আমলে গোরা পল্টন, এমনকী চার্লস টেগার্টের আদলে আমার মুখ হয়েছে। বলিউড আমলে প্রাণ, আমজাদ খান, অমরীশ পুরী— কত কী সাজলাম!

প্রতি: রাত পোহালে মহালয়া। ভোর হতেই রেডিয়ো, টিভি: সবখানে রাশি-রাশি অসুর বধ। জনগণকে কোনও বার্তা?

মহিষাসুর: দ্যাখ্, সাব-অলটার্ন স্টাডিজ-এর রণজিৎ গুহ ছাড়া আমাদের কথা তো কেউ ভাবল না। তা-ও উনি রাহু-কে নিয়ে লিখেছেন, আমাকে নিয়ে নয়! যাক গে, এই কয়েক হাজার বছর বয়সে একটাই অনুরোধ, আমার ‘দুষ্কৃতীকরণ’ করছিস, কর। কিন্তু এ বার পুজোয় আমাকে কেউ সাংবাদিক ঠ্যাঙানো, ভোট-লুটেরা ‘বহিরাগত’ বানাস না প্লিজ! দেবতাদের অমৃত-কেলেংকারি, ত্রিশূলের খোঁচা, সিংহের কামড় অবধি সয়ে যাবে, কিন্তু এই জমানার এই নয়া রঙ্গ আর সহ্য হবে না। বদহজম হয়ে মারা যাব! একে অসুর, তায় ভূত, তার মৃত্যু: কৈলাস অবধি টলে যাবে কিন্তু!

sanajkol@gmail.com

‘শুধুমাত্র কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’

ঝকঝকে সুন্দর আইভরি কার্ড। প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা তিন ইঞ্চি চওড়া। কিন্তু তার ওপর কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু সংকেত, কী বীভৎস চিত্র। ভয়ঙ্কর বীভৎস বিষাক্ত একটি সাপ— করাল দুটি চোয়াল ব্যাদান করে শিকারের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়তে চায়। দুটি চোখে স্থির দৃষ্টি। চোখের নীল আভায় একটা ভয়াবহ বিপদের সংকেত। মৃত্যুর অগ্রদূত। ধ্বংসের করাল ছায়া তার সারা দেহের প্রতিটি রেখায় ফুটে উঠেছে। সে যেন মহাকালের দূত। মহাকালের প্রলয় ডমরু বেজে উঠেছে ঐ সাপের ভয়াবহ দুটি নীল চোখে। দীপক চ্যাটার্জী তাকিয়ে থাকে কার্ডখানার দিকে।’ তার পর?

তার পর জমজমাট এক রহস্যের খনি, যার পরতে পরতে খুনের পর খুন। লাস্যময়ী নারী, চাপা যৌনতা, রক্ত, রিভলভার। আর সব শেষে ভারতবিখ্যাত গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জীর দুরন্ত বুদ্ধিমত্তার জয় ও হ্যাপি এন্ডিং‌। সত্তর দশকে স্বপনকুমারের লেখা চটি বইগুলো বাজার মাত করে রাখত। মশলাদার ঝালমুড়ির মতো মুখরোচক এই গোয়েন্দা বইগুলোর টান আমাদের কাছে ছিল দুর্নিবার। বাড়ির গার্জেনদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। টান টান উত্তেজনায় নিজেদের ছেঁকে নিয়ে আবার অধীর অপেক্ষায় থাকতাম পরের মাসের বইয়ের জন্য।

বইয়ের টাইটেল পেজে সিগারেটের প্যাকেটের মতো বিধিসম্মত সতর্কীকরণ লেখা থাকত: ‘শুধুমাত্র কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’। কিন্তু আমরাও তো আর সুবোধ বালক ছিলাম না। স্কুলে থাকতেই ইঁচড়ে পাকা আমাদের কাছে লোভনীয় ছিল স্বপনকুমারের সব বই-সিরিজ— কালনাগিনী সিরিজ, প্রহেলিকা সিরিজ, ড্রাগন সিরিজ, ক্রাইম ওয়ার্ল্ড সিরিজ, রহস্য কুহেলিকা সিরিজ। আর বইগুলোর নাম তো চুম্বকের মতো টানত। ‘ড্রাগনের প্রতিহিংসা’, ‘কালো ছায়া’, ‘কে তুমি’, ‘মহাশূন্যে বাজপাখি’, ‘নীল সাগরে রক্তলেখা’, ‘সাপের চোখ নীল’, ‘ভয়ংকরের অভিযান’, ‘কালো নেকড়ের প্রতিহিংসা’, আরও কত!

এক বার চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে স্বপনকুমারের বই পড়ছি: ‘গভীর রাত। সারা পৃথিবী ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন, শুধু ঘুম নেই একমাত্র রতনলালের চোখে। বহু দূরে আত্মগোপন করে রায়সাহেবের শিবপুরের বাড়ির দিকে চোখ মেলে বসেছিলো। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে রতনলাল ভালো করে তাকালো। একটা ছায়ামূর্তি যেন রাতের কালো ছায়ার থেকেও বেশী কালো। কালো কাপড়ে দেহ ঢেকে এগিয়ে চলেছে রায়সাহেবের বাড়ির দিকে...’ সাসপেন্স একেবারে তুঙ্গে। উত্তেজনায় নিজের বুকের ধুকপুকানিও শুনতে পাচ্ছি, কার একটা হাত আমার কান লক্ষ করে এগিয়ে এল। মুখ তুলে দেখি, বাবা। পুলিশি কায়দায় বাবা বই বাজেয়াপ্ত করলেন। জুটল জোর বকুনিও।

ক্লাসে পড়ার বইয়ের ফাঁকে স্বপনকুমারের বই লুকিয়ে পড়া ছিল রোজকার রুটিন।
টিফিন টাইমে ভিড় জমত গোয়েন্দা দীপকের নতুন গল্প ঘিরে। ছবি: সুমন চৌধুরী

পরের গল্পটা অবশ্য আলাদা। মা’র কাছে শুনেছিলাম, বাবা নাকি রাতের বেলা সেই বইটাই বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলেন। বুঝলাম, গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জীর ফাঁদে পা দিয়েছেন বাবাও। সেই ফাঁদ কেটে বাবা আর বেরোতে পারেননি। এর পর থেকে বাবাকে নিয়মিত স্বপনকুমারের চটি বই জোগান দেওয়ার গুরুদায়িত্ব আমার ওপরেই পড়েছিল! বিনোদন বলতে তখন রেডিয়ো আর খবরের কাগজ। তাই ছোঁয়াচে রোগের মতো স্বপনকুমারের গোয়েন্দা-কাহিনির নেশা ছড়িয়ে পড়ল চোদ্দো থেকে চুয়ান্ন, সবার মধ্যে। বাবাকে দেখতাম, বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে সুটকেসে স্বপনকুমারের বই পুরতে। ট্রেনে ওই বই পড়ে সময় কাটাবেন।

তখন আমাদের কাছে হিরো মানে দুজন। উত্তমকুমার আর দীপক চ্যাটার্জী। গোয়েন্দা দীপকের সহকারী রতনলালও কম সেলেব্রিটি ছিল না। নারায়ণ দেবনাথের আঁকা দুর্ধর্ষ প্রচ্ছদ বইয়ের আকর্ষণকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিত। মেরেকেটে হয়তো ষাট-সত্তর পাতার বই! আমাদের কাছে সেটাই সারা মাসের রসদ। দাম ছিল চল্লিশ পয়সা।

কয়েকটা প্রচ্ছদ এখনও মনে আছে। চার রঙে, হাফটোনে ছাপানো ছবি, ছবিতে টাইট জামা পরা যুবতী। সারা দেহে যৌবনের অমোঘ আবেদন। সত্তর দশকের রক্ষণশীল সমাজের নিরিখে সে ছবি যথেষ্ট সাহসী ছিল। এখনকার অফসেট ছাপা তখন কোথায়! পায়ে-ঠেলা টেড্রল মেশিনে, সস্তার নিউজপ্রিন্টের পাতার পর পাতায় শিহরন-জাগানিয়া রহস্য-রোমাঞ্চ। পাসপোর্ট-ভিসা না থাকা সত্ত্বেও গোয়েন্দা দীপক আর তাঁর সহকারী রতনলাল কী করে যে এক দেশ থেকে নিমেষে আর এক দেশে পৌঁছে যেত! এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেছে বলে শুনিনি। আর কী ডায়ালগ! ‘মাথার ওপর হাত তোল শয়তান! পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব’, শুনে রক্ত চনচন করে উঠত। মুচমুচে প্লটকে সঙ্গত করত দুরন্ত গতি। বাস্তব-অবাস্তবের তফাত গুলিয়ে যেত। কখনও গোপন সুড়ঙ্গের মুখ খুলে যাচ্ছে, কখনও মাটির তলার ঘরে মিটিং করছে ভয়ংকর দস্যুরা। কখনও চলন্ত গাড়িতেই ছদ্মবেশ বদলে নিচ্ছে গোয়েন্দা দীপক।

এক বার বাংলার মাস্টারমশাই কানাই স্যরের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়লাম। ‘ওটা কী বই রে’ বলে একেবারে রঘু ডাকাতের কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, বই লুকনোর ফুরসতটুকু মিলল না। বইটা ছিল ‘ড্রাগনের প্রতিহিংসা’। হাতে নিয়ে স্যরের চোখমুখ পালটে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি এই গুপ্তধনের সন্ধানেই এত দিন ছিলেন। ‘ড্রাগনের প্রতিহিংসা’ চলে গেল স্যরের বাড়ি। মজাটা হল পরের দিন, স্যর ক্লাসে এসে সিরিজের পরের বইটা চাইলেন। তার পর তার পরের বই, তার পর তার পরেরটাও। জানা গেল, স্যরের স্ত্রী স্বপনকুমারের বইয়ের পোকা। এক একটা সিরিজে একশোটা করে বই বেরোত, আমরাও পর পর সাপ্লাই দিয়ে যেতাম আমাদের মাস্টার-দম্পতিকে!

সমীর সরকার, বেথুয়াডহরি, নদিয়া

সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy