Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩

খিচুড়ি

পিনাকী ভট্টাচার্য

বাদলা দিনের পরম বন্ধুটি শরতে মা দুর্গার ভোগ আলো করে থাকে। আর, বছরজুড়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের পুজোতেও তারই রমরমা।

এই খিচুড়ি-রাজ কবে থেকে শুরু হয়েছে বলা কঠিন। তবে এ দেশে খিচুড়ির জয়বাদ্যি শোনা যায় সেই আলেকজান্ডারের আমলের সেলুকাসের জমানা থেকেই। ইবন বতুতা ভ্রমণকথায় লিখেছেন, চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তিনি ভারতে মুগ ডাল আর চাল দিয়ে ‘খিশ্রি’ তৈরি হতে দেখেছেন। তাঁর ঠিক পর পরই এ দেশে আসা রুশ পর্যটক নিকিতিন-এর লেখাতেও খিচুড়ির প্রসঙ্গ আছে।

কিছু দিন আগে খানা তল্লাশি করতে বেরিয়ে যখন বিরিয়ানি খোঁজা হচ্ছিল, তখনও খিচুড়ির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কারণ মুঘল আমলে বাদশার ভালবাসাতেই খিচুড়ি জনপ্রিয়তার চুড়োয় পৌঁছয়। হুমায়ুন যখন শের শাহ-এর তাড়া খেয়ে পারস্যে পৌঁছলেন, সেখানকার শাহকে তিনি নেমন্তন্ন করে ভারতীয় খিচুড়ি খাইয়েছিলেন। আর তা খেয়েই নাকি শাহ মোহিত হয়ে হুমায়ুনকে পারস্যে আশ্রয় দেবেন ঠিক করেন। আকবরের সময়ে আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’-তে সাত রকম খিচুড়ির রেসিপি লিখেছেন।

মুঘল বাদশাদের খিচুড়ি-প্রীতিও বংশানুক্রমে চলেছিল। জাহাঙ্গীর এক বার গুজরাতে ভুট্টার খিচুড়ি খেয়ে, তক্ষুনি তাকে মুঘলাই হেঁশেলে জায়গা দেন। আর শাহজাহান পর্তুগিজ পর্যটক সেবাস্তিয়ান মান্‌রিখকে পেস্তা-বাদাম আর গরম মশলা দেওয়া যে খিচুড়ি খাইয়েছিলেন, সাহেবের তা খেয়ে মনে হয়েছিল মণিমাণিক্যের খিচুড়ি খাচ্ছেন! মুঘল দরবারের সঙ্গে খিচুড়ির সম্পর্ক বরাবরই ভারী মিঠে। আকবর-বীরবলের গপ্পেই তো আছে, বীরবল কী ভাবে খিচুড়ি রান্না করে আকবরকে নীতিকথা শিখিয়েছিলেন।

সাগরপারের ‘কেডজ্রি’ও আদতে আমাদেরই খিচুড়ি। ভিক্টোরীয় যুগে দেশে ফেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ অফিসারদের হাত ধরে তা ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিল। তখনকার দিনে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা রাতের বেঁচে থাকা খাবার, পর দিন সকালে নতুন করে রান্না করে আরও স্বাদু বানিয়ে পরিবেশন করতেন প্রাতরাশের টেবিলে। সেই খাবারেরই অন্যতম কেডজ্রি। আগের রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত আর ডাল থেকে তৈরি হত তা। সে খাবার আরও উপাদেয় বানাতে মাছ আর ডিম দেওয়া হত। কেডজ্রি আজও ইংল্যান্ডে প্রাতরাশ হিসেবেই খাওয়া হয়। যদিও স্কটরা বলে, তাদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গেই কেডজ্রি ভারতবর্ষে এসেছিল আর সেখান থেকে ইংল্যান্ডে ফেরত গেছে। ‘দ্য স্কটিশ কিচেন’ বইটিতে ক্রিস্টোফার ট্রটার এ রকমই দাবি করেছেন, কিন্তু তা একেবারেই ধোপে টেকেনি।

তবে, খিচুড়ি ছিল সাধারণ মানুষের খাবার। বানাতে সুবিধে বলে খেটে খাওয়া মানুষের খুব প্রিয়ও। তাই একে নিয়ে গল্প অনেক। জোধপুরের প্রতিষ্ঠাতা রাও জোধাকে মেওয়ারের রানা কুম্ভ চিতোর থেকে উৎখাত করেন। রাও জোধা তখন পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর তাঁর চিতোর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা বারবার বিফলে যাচ্ছে। সে সময় তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেয় নাকি এক বাটি খিচুড়ি! সেনা, ঘোড়া সব খুইয়ে, নিজের পরিচয় লুকিয়ে ঘুরতে ঘুরতে, রাও জোধা এক জাঠ চাষার বাড়িতে খাবার চান। সেখানে তাঁকে খিচুড়ি দিলে খিদেয় কাতর জোধা গরম খিচুড়িতে আঙুল ডুবিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। চাষার বউ তাঁকে বলে, ‘তুমি আমাদের রাজা রাও জোধার মতো ভুল করছ। খিচুড়ির মাঝখানটা সবচেয়ে গরম থাকে আর ধারগুলো ঠান্ডা। ধারগুলো থেকে খেতে শুরু করো।’ এর পর রাও জোধা সরাসরি চিতোর আক্রমণের চেষ্টা না করে চারপাশের দুর্গগুলো জয়ের দিকে মন দেন। অবশেষে পনেরো বছর বাদে রাজত্ব ফিরে পান তিনি।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

তিনটি মন্ত্র নিয়ে যাদের জীবন

আমার রোগা-প্যাটকা হাতখানা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভদ্রলোক বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘রূপকদা, পেয়েছি!’

সরকারি অফিসে কনিষ্ঠ কেরানি-অবতার হয়ে দুরু দুরু বুকে জয়েন করতে এসেছি। বয়েস সবে কুড়ি পেরিয়েছে। কলেজের খাতায় জ্বলজ্বলে নাম, কিন্তু ছোটখাটো রোগাভোগা চেহারা। কলকাতা থেকে বহু দূরে আমার পৈতৃক চালচুলো শুনে কর্মকর্তারা দয়াপরবশ হয়ে চালান করেছেন শিয়ালদার কাছের এই অফিসে। এখানে নাকি সময়ের কড়াকড়ি কম।

মধ্য-আশির দশকের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। গায়ে জ্যালজেলে সোয়েটার, ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরনো ইস্তক পেটে দানাপানি না পড়ায় মুখ শুকিয়ে আমশি। তার ওপর ভদ্রলোকের এই রণহুঙ্কার এবং বেড়ালের নেংটি ইঁদুর ধরার কায়দায় হ্যাঁচকা টান— সব মিলিয়ে আমার অবস্থা সঙ্গিন।

‘চলুন, রূপকদা আপনাকে দীক্ষা দেবেন।’ জীবনে প্রথম বার ‘আপনি’ সম্বোধন শুনছি, তাও আবার একমাথা পাকাচুলের দশাসই মানুষটার কাছ থেকে! প্রায় ভিরমি খেতে খেতে পৌঁছলাম আমার দীক্ষাগুরুর কাছে। কাকা-জ্যাঠার বয়সি পাকাচুলো দাদা। আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করে বললেন, ‘সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি বোধহয়?’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাঁক পাড়লেন, ‘রামদা, পাউরুটি আর ডিমের ওমলেট। সঙ্গে চা দিও।’ খাওয়ার আশায়, না কি পকেটের আশঙ্কায় পেটটা গুড়গুড় করে উঠল। বুকপকেটে একটা ন্যাতানো পাঁচ টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা সম্বল। খেয়েদেয়ে একটু চাঙ্গা হতে শুরু হল দীক্ষাদান পর্ব।

‘এই অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে?’ বলে একটু থামলেন। আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে বুঝি একটু মায়া হল। ‘এই যে অফিস দেখছ, এটা আসলে যমালয়, আর আমরা সবাই এক-এক জন চিত্রগুপ্ত। রাজ্য প্রশাসনের ল্যাজা থেকে মুড়ো, মানে ব্লকের বিডিও থেকে শুরু করে রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি, প্রত্যেকের ঠিকুজি-কুষ্ঠি, জয়েনিং থেকে রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত সব খুঁটিনাটি এখানে লেখা থাকে। ওই যে টেবিলে বাঁধানো খাতার মতো, ওগুলো কাম-সূত্র। না না ‘কামসূত্র’ নয়, ‘কাম-সূত্র’। চাকরি জীবনের কামকাজের খতিয়ান। ইংরিজিতে বলে ‘সার্ভিস বুক’। ওই যে রাশি রাশি চিঠি, ওগুলো সাহেবদের ইনক্রিমেন্ট, পে-ফিক্সেশান, লিভ, ট্রান্সফার, পোস্টিং, চার্জ রিপোর্ট— আরও হাজার বখেড়া। তোমার কাজ হল ঠিক লোকের সার্ভিস বুকে ঠিক তথ্যটা লিখে রাখা। তবেই তেনাদের অক্ষয় স্বর্গলাভ, মানে রিটায়ার করেই পেনশন। আর ওটা ঠিক না থাকা মানে নরকের টিকিট কনফার্মড। পেনশন পাইতে পিতৃনাম খগেন হইয়া যাইবে।’

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

‘আর সরকারের ‘ত্রিশীল’ জানো তো? মানে কর্মচারীদের পাওনাগন্ডার ব্যাপারে সরকারি ত্রিফলা নীতি। প্রথম শীল: ‘কাহাকেও কিছু দিব না’। দেখবে, ডিএ-ই হোক বা পে কমিশন, বছরের পর বছর ‘দিতে হবে দিতে হবে’ই সার। সরকার চিরস্থবির। দ্বিতীয় শীল: ‘যদি দিতেই হয়, যথাসম্ভব কম দিব’। ডিএ হয়তো ফিফটি পার্সেন্ট ডিউ, অনেক টালবাহানার পর পেলে ফাইভ পার্সেন্ট! আর তৃতীয় শীল: ‘উহাও যথাসম্ভব বিলম্বে দিব’। তিন বছর আগের পাওনা আজ ঘোষণা হল, এফেক্ট ছ’মাস বাদে! কি, বুঝলে না? বুঝবে, এই খোঁয়াড়ে বাকি জীবনটা কাটালে হাড়ে হাড়ে বুঝবে।’ রূপকদা তত ক্ষণে নিজের পকেট থেকে আমার টিফিনের দাম মিটিয়ে দিয়েছেন।

তার পর বললেন, ‘শোনো, তোমাকে তিনটে মন্ত্র দেব। সারা জীবন যদি মান্য করে চলতে পারো, দেখবে, সরকারি চাকরি-জীবন তরতরিয়ে চলছে। কিন্তু মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হয়েছ কি ঝঞ্ঝাট-সাগরে খাবি খাবে। আদর্শ সরকারি কর্মচারীর প্রথম মন্ত্র: ‘কখনও ন্যস্ত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করিব না’। যত কাজ করবে, তত তোমার ওপর কাজ চাপবে। যে কাজ করে না, তার ওপর কেউ কাজও চাপায় না। সিম্পল!’

‘দ্বিতীয় মন্ত্র: ‘কোনও কাজ কখনও নির্ভুল করিব না’। কারণ, তোমার কাজে ভুল ধরতে পারলে উপরওয়ালা খুশি হবেন। এই মহাবিশ্বে তিনিই যে একমাত্র বিদ্যাসাগর, তাঁর মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হবে। তোমার ওপর অনুকম্পা বাড়বে। অসীম ঔদার্যে তিনি ভাববেন, এই গাধাটা কিস্যু জানে না। একে কাজ দেওয়ার চাইতে নিজে করে নেওয়াই ভাল!’

‘আর তৃতীয় মন্ত্র: ‘সরকারের নিকট কিছু মাত্র পাওনা থাকিলে না পাওয়া অবধি পত্র লিখিয়া প্রাণ ওষ্ঠাগত করিয়া ছাড়িব’। নইলে সরকারের মনে হবে, এরা না জানি কত কী পেয়ে থাকে!

আমাকে গুরুর হাতে সমর্পণকারীর সঙ্গে পরে খুব ভাব হয়েছিল। দারোয়ান শ্যামসুন্দর। অফিসের টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে শুরু করে গেটের তালা, যা পেত বেচে মদ খেত। নিজের সম্পর্কে গর্বও ছিল: ‘দিল দরিয়া পেট সমুন্দর, নাম হ্যায় মেরা শ্যামসুন্দর!’ দেখা হতেই লম্বা স্যালুট ঠুকে এক–দু’টাকা ধার চাইত। অবশ্যই ফেরত দিত না।

জব্বর চলছিল। অন্যেরা ক্লাস কেটে সিনেমায় যায়, আমি অফিস কেটে কলেজের প্র্যাকটিকালে। রূপকদা সব সামলান। বিপদের আশংকা থাকলে ড্রয়ারে চিরকুট পাই, ‘কাল খোঁজ হয়েছে, আজ অফিস কাটা যাবে না।’ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি সব আদেশ। টেবিলের ওপর চিঠি জমতে জমতে পাহাড়ের মতো হয়ে ওঠে। এক দিন বরিষ্ঠ কেরানি প্রাণনাথদা বললেন, ‘ওহে ছোকরা, টেবিলে কি হিমালয় বানাতে চাও? রূপক দীক্ষা দিল, শিক্ষাটা দিল না! তুমি গুঁজতে শেখোনি?’

একে গুরুনিন্দে, তাতে আবার অশিক্ষার অভিযোগ! আমি দিশেহারা। প্রাণনাথদা বললেন, ‘এখন থেকে তোমার কাছে যত চিঠি আসবে, সব গুঁজে রাখবে, বুঝেছ?’ আমি তো অবাক, গুঁজে রাখলে তো তারও রিমাইন্ডার আসবে! ওঁর জবাব: ‘সেটাও গুঁজে রাখবে!’ সেটাও! অত চিঠি গুঁজব কোথায়! এমনিতেই টেবিলে আর জায়গা নেই। প্রাণনাথদা নির্বিকার: ‘আহা, বেশি দিন রাখবে কেন? কিছুটা জমলেই ডিসপোজ করে ফেলবে! উইন্ডো ডিসপোজাল। বুঝলে না? আরে বাবা, সিম্পলি ছিঁড়ে জানলা দিয়ে... হেঁ হেঁ...’

অরুণ কর, দক্ষিণপাড়া, বারাসত

arunkar77@yahoo.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy