Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সাদা কাক

তখনও কেটারিং আসেনি। বিয়ের ভোজে ডাঁটিওয়ালা বেগুন ভাজা, ছ্যাঁচড়া, কাশ্মীরি না হয়ে যাওয়া আলুর দম। বাড়ির লোকজন বাজার করত, হালুইকর রান্না করত, কোমরে গামছা বেঁধে ঘোঁতন, নিতাই, জগারা ‘আর দুটো লুচি দিই’ করত, আর অমিতাভ, পার্থ, শুভময়রা পাড়ার মেয়েগুলোকে বিয়ে করে নিয়ে যেত।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:০৬
Share: Save:

তখনও কেটারিং আসেনি। বিয়ের ভোজে ডাঁটিওয়ালা বেগুন ভাজা, ছ্যাঁচড়া, কাশ্মীরি না হয়ে যাওয়া আলুর দম। বাড়ির লোকজন বাজার করত, হালুইকর রান্না করত, কোমরে গামছা বেঁধে ঘোঁতন, নিতাই, জগারা ‘আর দুটো লুচি দিই’ করত, আর অমিতাভ, পার্থ, শুভময়রা পাড়ার মেয়েগুলোকে বিয়ে করে নিয়ে যেত। সেই সময়ের এক জন রান্নার বামুনের নাম পঞ্চাদা। আমাদের পাড়ার যাবতীয় ভোজ-কান্ডারি। ভোজের মেনু তৈরি হচ্ছে, পঞ্চাদার উপদেশ: ‘একটু পোলাও করে নিন দাদা। ডালডা মেরে এমন বানিয়ে দেব যে একদম মুখ মেরে দেবে। মাছ-মিষ্টি বেশি টানতে পারবে না।’ একটু দুর্বল গৃহস্থকে পঞ্চাদা অভয় দিত ‘আরে আমি তো আছি, কিচ্ছু ঘাবড়াবেন না। মাংসটা একটু রেখে সেদ্ধ করব, বেশি টানতে পারবে না। দশ কেজিতেই আপনার সোয়াশো লোকের হয়ে যাবে।’ ‘রেখে সেদ্ধ’ মানে কম করে সেদ্ধ। পাতে রসগোল্লা ছাড়ার আগে দু’মুঠো করে বোঁদে ছেড়ে দেওয়ার উপদেশ দিত পঞ্চাদা। সেই বোঁদে কড়া রসে ফেলা। এটা সন্দেশ-রসগোল্লা বাঁচানোর কায়দা। তখন মানুষ নেমন্তন্নবাড়িতে গিয়ে খেত খুব। ২০-২৫ পিস মাছ খানেওয়ালার সংখ্যা কম ছিল না। একটা বিয়েতে ৪০ জন বরযাত্রী আসার কথা ছিল, এল ৮০ জন। পঞ্চাদা ত্রাতা। এমন একটা বরযাত্রী স্পেশাল চপ ভেজে দিল, সবাই চেয়ে চেয়ে তিন-চারটে করে খেয়ে নিল, আর মাছ-মাংসে টান পড়ল না।

সত্তরের দশকেই ছ্যাঁচড়া যুগের পতন শুরু। বিয়েবাড়ি থেকে ছ্যাঁচড়া, লাফরা (বাঙালরা বলে লাবড়া), শাক ভাজা, বেগুন ভাজা ইত্যাদি উঠে গেল। ফিশ ফ্রাইটা আগেই এসেছিল, ক্রমশ ফিশ বাটার ফ্রাই, ফিশ ওরলি, চিলি চিকেন, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, মাটন ভিন্ডালু নানা দেশের নানা পদ বাঙালির ভোজ-মেনুতে ঢুকে যেতে লাগল। প্রোমোটিং-এর মতো কেটারিং শব্দটাও বাংলা শব্দভাণ্ডারে শুধু নয়, বাংলা সংস্কৃতিতেও ঢুকে গেল। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই পঞ্চাদা শেতলা পুজোর খিচুড়ি বানানো টাইপের কাজ ছাড়া অন্য কাজ পেত না। রোয়াকে বিরস বদনে বসে থাকত। আমাদের দেখলে বলত, পাঁচটা টাকা দিয়ে যা বাপ। তোদের মুখেভাতে রেঁধেছি, তোদের কাকা-পিসিদের বিয়েতেও রেঁধেছি। তোরা এখন বে-থা করছিস, আমায় ডাকিস না। ক্যাটারারগুলো কি রাঁধতে জানে? ওরা তো বোতলে ভরা সস আর প্যাকেটে ভরা মশলা দিয়ে রাঁধে। নিজেরা স্বাদ বার করতে পারে? আমি পারি। ছানার কোপ্তা করে দেব। রবারের মতো পনির নয়, ছানার ভিতরে রস ঢুকে থাকবে। এমন মুগডাল রাঁধব, বাতাস বলে দেবে হ্যাঁ, মুগডাল হচ্ছে। আমি পঞ্চা ঠাকুর, আমি মানুষের মুখে রুচি আনতে পারি। আর ক্যাটারারগুলোর তো মুখ মারার ধান্দা। লোকে যত কম খাবে, ওদের তত লাভ।

ফতুয়ার পকেট থেকে একটা মেনু বের করল পঞ্চাদা। রামধনু কেটারার। প্রোঃ বিমল সাধুখাঁ। ওপেনিং সং—বেবি নান। সংগতে—ছোলে কিমা। ব্রেক ডান্স—ফিশ ওরলি। কি-বোর্ড—গ্রিন স্যালাড, পপ গায়িকা—চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। গজল—মাটন বিরিয়ানি। অতিথি শিল্পী—রায়তা। কৌতুকশিল্পী—প্লাস্টিক চাটনি। উদাস বাউল—পাঁপড়... ইয়ারকি হচ্ছে, অ্যাঁ? খাবারের আইটেম নিয়ে ছেলেখেলা? গজল গাইছে বিরিয়ানি? বিমল সাধুখাঁ বিরিয়ানির জানেটা কী? সা-জিরে দেখেছে কখনও? কোন আইটেমে কাবাবচিনি কতটা গুঁড়ো করতে হয় জানে? ও তো রঙের মিস্ত্রি ছিল। আমি তিন পুরুষের হালুইকর। আমার ঠাকুরদা এসেছিল বালেশ্বর থেকে। ঠাকুরদার বাপ মন্দিরে ভোগ রাঁধত। আমার রক্তে জিরা-লংকা-মেথি-হলুদ। তোর বিয়ে হল, আমায় ডাকিসনি। পঞ্চু মাঞ্চু করতে পারে না, তাই না? মাঞ্চু আমিও বানাব।

পঞ্চাদা ওই সব মাঞ্চুরিয়ান, বেবি নান, চিকেন মেক্সিকান শেখার জন্য সাধুখাঁদের তেল দিয়েছে, ওরলি-মাঞ্চুরিয়ান সমন্বিত বিয়েবাড়িতে অযাচিত ঢুকে গলাধাক্কাও খেয়েছে, কখনও চেখে দেখেছে। আসলে পঞ্চাদা বুঝতে চেয়েছিল এই সব খাদ্যের সৃষ্টিরহস্য। বাড়িতেও চেষ্টা করেছে এ সব বানাতে।

আমাদের বলেছে, আরে, মাঞ্চুরিয়ান তো আসলে মাংসের বড়ার ঝোল। মাংসর কিমায় একটু আটা-ময়দা মিশিয়ে বড়া বানিয়ে ঝোল করে দিতে পারব না? সব পারব আমি। দে না মাইরি আমাকে কাজ। একটা ছোটখাট কাজ পেয়েছিল পঞ্চাদা, আমার এক বন্ধুর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে। কিন্তু মাঞ্চুরিয়ানগুলো ভেঙে ভেঙে গেল। পঞ্চাদাকে শুনতে হল, এ সব তোমার কম্ম নয়। তুমি হলে কুমড়োর ঘ্যাঁট আর মুগের ডাল জমানার পাবলিক। বৃদ্ধাশ্রমে রান্নার কাজ দেখোগে যাও।

এর মাসখানেকের মধ্যেই পঞ্চাদার রক্তাক্ত দেহ পাওয়া যায়। একটি বিয়েবাড়ির রান্নার জায়গাটার উপরে একটা বড় মাপের ঘুলঘুলি ছিল। ঘুলঘুলির তলায় কার্নিস। কার্নিস ভেঙে পঞ্চাদা পড়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পঞ্চাদা বিড়বিড় করছিল,
‘কর্ণ-কর্ণ-কর্ণ। কর্ণ মু ভুলিবিনি। হা কুন্তী হা মাতঃ, রক্ষা কর, রক্ষা কর। কর্ণ কহিছন্তি কর্ণ নামটা ভুল হবনি ম...।’
মাতৃভাষায় স্বগত কথা পঞ্চাদার। মাথায় হেমারেজ হয়েছিল। দু’দিন পর পঞ্চাদা মারা যায়।

পরে বুঝেছি, ঘুলঘুলি দিয়ে ও আধুনিক খাদ্য নির্মাণ কৌশল দেখছিল। মাঞ্চুরিয়ান বানাবার সময় কেউ হয়তো বলেছিল কর্নফ্লাওয়ারটা মেশাও। ওই নামটা ভুলতে চায়নি। শিরা ছিঁড়ে রক্ত যখন মাথার ভিতরে গ্লোবালাইজ্ড হয়ে যাচ্ছিল, ও ফেলে আসা যাত্রাপালার কর্ণ নাম জপছিল। আসলে কর্নফ্লাওয়ার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE