Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সু ম না মি

জন্মস্থান কটক থেকে ১৯৫৫ সালে কলকাতায় এসে জীবনে প্রথম সাপুড়ে ও সাপের খেলা দেখেছিলাম। সাপুড়েরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন কাঁধে নেওয়া ঝোলায় সাপ-ভর্তি চুপড়ি নিয়ে। হাতে থাকত এক ধরনের বাঁশি, যার আওয়াজ কতকটা সানাইয়ের মতো। অনেক পরে জেনেছি ওই বাঁশিটিকে ‘বিন’ বলে। তার যে সুর প্রথম বার শুনেছিলাম, সেটি তখন বেতারে, পাড়ার পুজোয় লাউডস্পিকারে খুব শোনা যেত। একটি হিন্দি গানের প্রিলিউড ও ইন্টারলিউড— এবং তা সাপুড়ের বিনের আওয়াজেই বাজানো।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

কবীর সুমন
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:২৯
Share: Save:

জন্মস্থান কটক থেকে ১৯৫৫ সালে কলকাতায় এসে জীবনে প্রথম সাপুড়ে ও সাপের খেলা দেখেছিলাম। সাপুড়েরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন কাঁধে নেওয়া ঝোলায় সাপ-ভর্তি চুপড়ি নিয়ে। হাতে থাকত এক ধরনের বাঁশি, যার আওয়াজ কতকটা সানাইয়ের মতো। অনেক পরে জেনেছি ওই বাঁশিটিকে ‘বিন’ বলে। তার যে সুর প্রথম বার শুনেছিলাম, সেটি তখন বেতারে, পাড়ার পুজোয় লাউডস্পিকারে খুব শোনা যেত। একটি হিন্দি গানের প্রিলিউড ও ইন্টারলিউড— এবং তা সাপুড়ের বিনের আওয়াজেই বাজানো।

শরীরে শিরশিরে অনুভব নিয়ে জীবনে প্রথম ফণা-তোলা গোখরোর দুলুনি দেখছি। সে তার শরীরের অনেকটাই মাটি থেকে উপরে তুলে একটু একটু দুলছে। অ্যাঁকাব্যাঁকা দুলুনি। সাপুড়েও দুলছেন অল্পস্বল্প। গাল দুটো অনেকটা ফুলিয়ে ফুঁ দিয়ে বাজানো তাঁর বিন-ও দুলছে। গোখরোর গায়ের রং, মাটির রং, সাপুড়ের গা ও পাগড়ির রং, চুপড়ির রং, ঝোলার রং আর বিনের রঙের মধ্যে কোথায় যেন মিল! কী সুন্দর মানিয়ে যাচ্ছে সব কিছু! জোরালো ফুঁয়ে বাজানো সেই সুর ও তার ছন্দ ছাড়া অন্য কোনও সুরছন্দ ওই সব রং ও আকারের সঙ্গে কিছুতেই মানাবে না। তখনও জানতাম না যে সাপের শোনার ক্ষমতাই নেই। আমি ভেবেছিলাম সাপটা ওই সুর আর ছন্দ শুনে একটু একটু দুলছে। সেই দুলুনি নিজের মধ্যেও টের পেয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা এ দেশের আরও অনেকের হয়েছে, কোনও সন্দেহ নেই।

বছর কয়েক পরে জানতে পেরেছিলাম যে, ওটি ‘নাগিন’ ছবির গান ও তার বাজনা। ১৯৫৪ সালের সেই ছবির ‘মন ডোলে মেরা তন ডোলে’ গানটির প্রিলিউড ওই সুর। ইন্টারলিউডেও আছে। ১৯৫৪ সালের হিন্দি ছায়াছবির সুর ১৯৫৫ সালে কটক থেকে কলকাতায় এসে সাপুড়েদের বিন-এ শুনছি। ওড়িশার সাপুড়েরাও সাপের খেলা দেখানোর সময়ে তাঁদের বাঁশিতে ওই সুর বাজাতেন কি না কে জানে। কটকে, আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে অন্তত সাপের খেলা দেখিনি, তাই জানি না।

ছেলেবেলায়, কলকাতার বাইরেও পশ্চিমবাংলার একাধিক জায়গায় সাপুড়েদের বাঁশিতে একই সুর শুনেছি, যেমন বোলপুরে। সব জায়গাতেই দেখতাম সাপুড়েরা ‘নাগিন’ ছবির ওই গানটির প্রিলিউড বাজিয়ে তার পর খোদ গান ‘মন ডোলে মেরা তন ডোলে’র স্থায়ী অংশটুকু সেরে আবার প্রিলিউডে ফিরে যাচ্ছেন। কাউকে কোনও দিন অন্তরার সুরটি বাজাতে শুনিনি। ইচ্ছে করত কোনও সাপুড়েকে জিজ্ঞেস করতে এর কারণ। কিন্তু ভরসা পাইনি।

দক্ষিণ কলকাতার বেহালা ও মুদিয়ালি অঞ্চলে যে সাপুড়েরা খেলা দেখাচ্ছিলেন, তাঁরাই ওই কাজটি করতে বোলপুর, বর্ধমান বা অন্যান্য জায়গায় চলে যাচ্ছিলেন এবং তাঁদের বিন বাজিয়ে বাজিয়ে সকলকে জানান দিচ্ছিলেন? মনে হয় না। আমরা কি ধরে নেব ‘নাগিন’ ছবির কাহিনিতে সাপের অনুষঙ্গ এবং সেই সূত্রে বিনের এই সুর সারা উপমহাদেশ জুড়ে সাপুড়েদের অনুপ্রাণিত করেছিল ওই সুরটি তুলে নিয়ে বাজাতে, না কি ওই সুরটি তার আগে থেকেই প্রচলিত ছিল এবং ‘নাগিন’ ছবিতে সেই সনাতন সুরটিই ব্যবহার করা হয়েছিল? যদি এই সুর ‘নাগিন’ ছবিটি নির্মাণের আগে থেকেই সাপুড়েদের বিন-এ বেজে থাকে, তা হলে ধরে নিতে হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেই সুরটি মাথায় রেখেই এ ছবির একাধিক গানের সুর করেছিলেন। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।

উইকিপিডিয়াতে দেখছি, ‘নাগিন’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুই সহকারী কল্যাণজি ও রবি নাকি ‘মন ডোলে’র প্রিলিউডের এই বিখ্যাত সুরটি রচনা করেছিলেন। সুরটি তাঁরা বাজিয়েছিলেন একটি মোনোফনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রে— এমন কায়দায়, যাতে লোকের মনে হয় যেন বিন-ই বাজছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য যদি ঠিক হয়, তা হলেও ওই সুর সৃষ্টিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদানের দিকটি বাদ দেওয়া অসম্ভব। ‘মন ডোলে’ এবং ‘তেরে দোয়ার খাড়া এক যোগী’— ‘নাগিন’ ছায়াছবির অন্তত এই দুটি গানের সুরের মধ্যেই রয়েছে বিন-এর সুরটির সব ক’টি উপাদান। প্রধানত শুদ্ধ রে, কোমল গা, শুদ্ধ মা, পা, কোমল ধা ও কোমল নি— এই স্বরগুলির সাহায্যে রচিত ওই সুর। ‘মন ডোলে’ গানটির সুরে দুটি গান্ধারই আছে, আর আছে শুদ্ধ ধা। বিন-এর সুরে শুদ্ধ গা আর শুদ্ধ ধা বাদ পড়ায় সুরটি আরও মেদুর, উদাস করা। ছায়াছবিতে এই সুরটি এক অদৃশ্য বাঁশিওয়ালার ডাক। নায়িকা তাতে শারীরিক ভাবেও উদ্বেল হয়ে উঠছেন।

কিন্তু ছায়াছবির বাইরে আমাদের দেশের সাপুড়ের বিন-এ এই সুর মিলে গিয়েছিল সাপুড়েদের রোদে-পোড়া জলে-ভেজা শ্রীহীন চেহারা, কালোকোলো শরীরে তাঁদের মেটে-রং গায়ের কাপড়, কাঁধের বিবর্ণ ঝোলায় সাপের চুপড়ি আর বিন যন্ত্রটির আকৃতি ও রঙের সঙ্গে। মিলে গিয়েছিল আমাদের দেশের গাছপালা, মাটি-ধুলো-আকাশ মেঘের রঙের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের চেহারা, পোশাক, হাবভাব, শরীরের ছন্দ, সাদামাটা আটপৌরে ঘরসংসার সমাজের সঙ্গে।

মানবেতিহাসে আর কখনও, আর কোনও দেশে একটি ছায়াছবির সাদামাটা সুরের সঙ্গে সাধারণ লোকস্তরের এবং এক বিশেষ পেশার মানুষদের এ-হেন সম্পর্ক হয়েছে কি? একটি নেহাতই বাজারি ছবিতে কাজ করতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কল্যাণজি ও রবি যে সৃষ্টি করে গেলেন, তার প্রভাব যে কত দূর পৌঁছল, তা আমরা কখনও ভেবে দেখেছি কি?

সাপুড়ে ছাড়াও, মাটির ভাঁড়ের মতো একটি পাত্রে ব্যাঙের চামড়ার ছাউনি দিয়ে, সরু বাঁশের একটি টুকরো ঢুকিয়ে, তাতে তিনটি তার লাগিয়ে, কঞ্চি দিয়ে বানানো ছড় টেনে-টেনে যে শহরপ্রান্তবাসী কারিগর-শিল্পীরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তাঁদের বাজনাটি বছরের পর বছর বিক্রি করে গেছেন (আজও হয়তো করছেন), তাঁরাও বাজিয়েছেন ‘নাগিন’-এর ওই সুর। এঁরাও তো সাপুড়েদের মতোই এ-দেশে ‘নিম্নবর্গীয়’, ‘অন্ত্যজ’ হিসেবে পরিচিত।

‘বিন’ যন্ত্রটি আমাদের দেশের কোনও কম্পোজার তাঁদের রচনায় ব্যবহার করেননি। চিনে অনেকটা একই ধরনের ‘বিন’ বা ‘হুলুসি’ যন্ত্র পাওয়া যায়, যাতে নল থাকে তিনটি (দুটি নল শুধু পোঁ ধরে), আর ছিদ্রও থাকে কিছু বেশি। পাশ্চাত্যের একাধিক কম্পোজার তাঁদের রচনায় সেটি প্রয়োগ করেছেন। সিরিয়াস সংগীত-চিন্তা ও রচনাতেও তা হলে আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের আত্মীকৃত ফতোয়া? সাপুড়ে-মুর্দাফরাশদের বাজনা নিয়ে ভাববে উপরতলার লোকজন? হেঁ-হেঁ, ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর বিষয়ই হয়ে উঠল না, তায় আবার কম্পোজিশন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kabir suman anandabazar rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE