Advertisement
E-Paper

সু ম না মি

অল্প বয়সে একটা হিন্দি গান শুনেছিলাম কোথাও একটা। সুরটি বেশ লেগেছিল। তাল, ছন্দ, লয়ও। সেই যুগের অনেক হিন্দি গানে ওই তিনের সাহায্যে একটা স্ফূর্তির ভাব জাগানো হত। শুনতে বেশ লাগত। বাংলা গানেও কোথাও কোথাও সেই ছন্দের স্ফূর্তি থাকলেও অনেক গানে থাকত একটা ঢিমে, মন-মরা ভাব। যেমন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ বা ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’।

কবীর সুমন

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

অল্প বয়সে একটা হিন্দি গান শুনেছিলাম কোথাও একটা। সুরটি বেশ লেগেছিল। তাল, ছন্দ, লয়ও। সেই যুগের অনেক হিন্দি গানে ওই তিনের সাহায্যে একটা স্ফূর্তির ভাব জাগানো হত। শুনতে বেশ লাগত। বাংলা গানেও কোথাও কোথাও সেই ছন্দের স্ফূর্তি থাকলেও অনেক গানে থাকত একটা ঢিমে, মন-মরা ভাব। যেমন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ বা ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’। বা, পঞ্চাশের দশকে (ওরে বাবা, বাংলা আধুনিক গানের ২৮ ক্যারাট স্বর্ণযুগ) কে জানে কেন, বাংলার গান-মানসে পেয়ে বসা ‘পরলোক-সংগীত’: ‘যদি ডাকো এ পার হতে/ এই আমি আর ফিরবে না’, ‘একটি কথাই লিখে যাবো শুধু জীবনের লিপিকাতে’, ‘যেদিন রবো না আমি, আসব না কোনও ছলে/ তুমি শূন্য সমাধি মোর, ঢেকে দিও ফুলদলে।’ প্রথম দুটি গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, অসামান্য কণ্ঠনৈপুণ্যে। তৃতীয়টি আর-এক তুখড় কণ্ঠশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁদের এক-একটি গানের গায়কি আমার মতো অক্ষম গেনো লোকের কাছে এক-একটি পাঠ। কিন্তু মিষ্টি সুর আর নিখুঁত গায়কির টানে বুঁদ হয়ে শুনেও শেষবেশ মনে হত— দুত্তেরিকা, গেল সব ভেস্তে।

সব আধুনিক গান শুনেই মানুষের মনে স্ফূর্তি আসতে হবে, তার নিত্যদিনে গতি সঞ্চার হবে এমন কথা পাগলেও বলবে না। কিন্তু গান শুনে মনটা মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মতো হয়ে গেলেও তো চলে না।

আপামর জনগণের বিনোদনের জন্যেই হয়তো তাল, ছন্দ, লয়, গায়কি ও বাজনার প্রত্যক্ষতা দিয়ে হিন্দি ছবির প্রযোজক ও সংগীত পরিচালকরা এমন একটা মেজাজ বানিয়ে তুলতেন, যা সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করত। সেই আকর্ষণ থেকেই এই লেখার প্রথম দিকে একটি হিন্দি গানের উল্লেখ।

মজার কথা, গানটি কখনও নিজের ইচ্ছেয় শুনিনি। হিন্দি ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানে এই গানটি শুনব বলে রেডিয়ো চালিয়ে বসে আছি— এমন কখনও হয়নি। কী যে গানের কথাগুলো, তাও ছাই জানতে চাইনি কোনও দিন। গানের প্রথম কথাগুলো ছিল ‘গোরি তেরে...’ তার পর কী-যেন, তার পর ‘নয়না’। এইটুকুই যা জানতাম। হিন্দি আমি জানি না। যত বার শুনেছি, দূর থেকেই শুনেছি। প্রতি বারই মনে হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা, সঙ্গে বোধহয় লতা মঙ্গেশকর।

আজ, কী মনে হল, ইন্টারনেটে গিয়ে সার্চ করে গানটি পেয়ে গেলাম। ও মা, পুরুষকণ্ঠটি হেমন্ত নন, সুবীর সেন। মহিলাকণ্ঠ গীতা দত্ত। গানটি হল ‘গোরি তেরে নট্খট্ নয়না’। সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবির নাম ‘হম ভি ইনসান হ্যায়’ (১৯৫৯)। সে ছিল এক যুগ। বয়সে নবীন, অভিজ্ঞতায় অনেক কমজোরি এক গায়ককে দিয়ে ছবিতে গাওয়ালেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গানটি নিজে না গেয়ে। তাঁর মনে না ছিল ঈর্ষা, না ছিল খাল কেটে কুমির আনার ভয়। একই ভাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গুরু আচার্য পঙ্কজ কুমার মল্লিক এক দিন কে এল সায়গলকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

‘গোরি তেরে নট্খট্ নয়না’ গানটি কাছ থেকে শুনলেও, থেকে থেকেই খটকা লাগে— আরে এ তো হেমন্ত! কিন্তু ১৯৫৯ সালেরই আর একটি ছবিতে কল্যাণজির সুরে ‘দিল লেকে যাতে হো কঁহা’ গানটিতে যে সুবীর সেনকে আমরা পাচ্ছি, তাঁর গলার আওয়াজে কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রতিধ্বনি কম। রয়েছে সবার আগে হিন্দি উচ্চারণ ও তার পরেই গায়কির মিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হিন্দি ছবিতে যে কণ্ঠটি উপহার দিয়েছিলেন, ধ্বনির দিক দিয়ে তা পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সমগোত্রীয় হলেও উচ্চারণ ও স্বরপ্রক্ষেপের দিক দিয়ে তা সম্পূর্ণ নিজস্ব। যুগান্তকারী।

আমার তিন বাঙালি বন্ধু এক বার আমাদেরই এক উচ্চশিক্ষিত, হিন্দিভাষী বন্ধুর সামনে বসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হিন্দি উচ্চারণ নিয়ে তামাশা করছিলেন। উত্তর-ভারতীয় যুবকটি শেষে থাকতে না পেরে বললেন, ‘হিন্দি ভাষাটা তো জানো না। জানো না খড়ি বোলি কাকে বলে। হিন্দি আমার মা-বাবার ভাষা। হেমন্তবাবুর মতো অমন পরিশীলিত আধুনিক হিন্দি উচ্চারণ উচ্চশিক্ষিত হিন্দিভাষীদের মুখেও কম শোনা যায়।’

সুবীর সেনের গান শুনে আমার আগেও মনে হয়েছে, আজও আবার হল, উচ্চারণ ও স্বরপ্রক্ষেপে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেই অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু বাংলার পরের যুগের আরও কোনও কোনও শিল্পীর মতো তিনি নকল করেননি। তাঁর ওপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রভাব ছিল সাংস্কৃতিক, অনুকরণভিত্তিক নয়।

১৯৬১ সালের হিন্দি ছবি ‘এক আসকা পঞ্ছি’তে শংকর জয়কিষণের সুরে সুবীর সেনের ‘দিল মেরা এক আসকা পঞ্ছি’ শুনলে আজও পেয়ে যাব আমরা এক তরুণ আধুনিক মানুষের পরিশীলিত উচ্চারণ, স্বরপ্রক্ষেপ ও গায়কি। দূর থেকে, কাছ থেকে যে ভাবেই শোনা যাক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মনে হবে না আর।

বাংলা গানেও সুবীর সেন এনেছিলেন সেই নিজস্ব মাত্রা ও আবেদন। আমার ছেলেবেলায়, বাংলা গানের আকাশ বাতাস যেখানে হেমন্ত-ধনঞ্জয়-সতীনাথ-মানবেন্দ্র-অখিলবন্ধু-তরুণ-শ্যামল-দিলীপ-মৃণাল-মান্নাময়, সুবীর সেনের গাওয়া গানগুলি এনে দিয়েছিল তারুণ্য ও অভিনবত্বের এক আলাদা মেজাজ। তাঁর গাওয়া ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্নরঙিন’ শুনে আমার কিশোর মন নেচে উঠেছিল অজানা এক আনন্দে।

‘চাঁদ তুমি এত আলো কোথা হতে পেলে’ গানটিতে সুবীর সেন এমন এক নরম আকুলতা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, যা আমার নবীন জীবনে রোমান্টিকতার প্রথম পাঠগুলির একটি, নিঃসন্দেহে।

কোনও কোনও গানে, যেমন ‘ওগো শকুন্তলা’ আর ‘রাত হলো নিঝুম’, আমার মনে হয়েছিল অন্যান্য শিল্পীদের গায়কিতে যে প্রত্যয় পেয়ে থাকি, তা যেন এখানে সামান্য মাত্রায় হলেও অনুপস্থিত। কিন্তু ‘তোমার হাসি লুকিয়ে হাসে’, ‘এত সুর আর এত গান’, আরও পরে ‘মোনালিসা’, ‘নগরজীবন ছবির মতন হয়তো’ ইত্যাদি গানে সুবীর সেনের গায়কিতে পেয়েছিলাম যুগোপযোগী গায়কি ও মেজাজ। তাঁর সময়ের অন্য বরেণ্য শিল্পীদের গায়কিতে যে নিশ্ছিদ্র মুনশিয়ানা আমরা পেয়েছিলাম, সুবীর সেনের গানে তা আমরা হয়তো সব সময়ে পাইনি। কিন্তু যা পেয়েছিলাম— সেই তাজা যৌবনের বেপরোয়া ভাব আর আদিখ্যেতাহীন, ছিমছাম, স্ফূর্তিময় সচলতা যে কত মূল্যবান ছিল, আজকের আধুনিক বাংলা গান শুনে তা মনে হয়। মন কেমন করে সুবীর সেনের জন্য।

kabir suman rabibasariya anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy