Advertisement
E-Paper

হানাদার হাতি

গ্রামে গ্রামে তছনছিয়ে ভাঙছে বাড়ি, চুরি করছে ধান, মেরে ফেলছে মানুষ। আগুনকে আর ভয় পায় না, বরং আরও তেড়ে আসে।গাঁয়ের নামটাই শুধু যা বিক্রমপুর। বিক্রমের ছিটেফোঁটাও নেই। পুঁজি বলতে শুধু শরীরের তাকত। লোকের বাড়িতে মুনিশ খাটা বা খেতমজুরি। পাশাপাশি কিছু ইটের আর মাটির ঘর। ছড়ানো উঠোনে এক পাশে ইষ্টদেবতার থান। উঠোনের আর এক দিকে দুটো ধলা বাছুর ঘাস চিবুচ্ছে। ওদের ভাগে এনে পালা হচ্ছে। বাছুর যখন গাই হয়ে বাচ্চা দেবে, তখন সেটির মালিকানা মিলবে। গাই নিয়ে চলে যাবে আসল মালিক।

দেবাশিস দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

গাঁয়ের নামটাই শুধু যা বিক্রমপুর। বিক্রমের ছিটেফোঁটাও নেই। পুঁজি বলতে শুধু শরীরের তাকত। লোকের বাড়িতে মুনিশ খাটা বা খেতমজুরি। পাশাপাশি কিছু ইটের আর মাটির ঘর। ছড়ানো উঠোনে এক পাশে ইষ্টদেবতার থান। উঠোনের আর এক দিকে দুটো ধলা বাছুর ঘাস চিবুচ্ছে। ওদের ভাগে এনে পালা হচ্ছে। বাছুর যখন গাই হয়ে বাচ্চা দেবে, তখন সেটির মালিকানা মিলবে। গাই নিয়ে চলে যাবে আসল মালিক।

মেয়েটা জন্ম-খোঁড়া। তার বাপ মরে গেছে কবে। হাড়সর্বস্ব শরীর আর মোটা কাচের চশমা নিয়ে শ্বশুর আছেন ঠিকই, কিন্তু ওই আছেনই। তবু থাকুন। ঘরে তো একটা মরদ অন্তত রইল। এক জনের নিশ্বাস তো পড়ল। মায়া বাউড়ি, জয়ন্তী বাউড়ির কাছে তা-ই ঢের।

১৪ অগস্টের মাঝরাতে, যখন স্বাধীনতা উদ্যাপনের জন্য ম্যারাপ বেঁধে কলকাতা তৈরি, ত্রিফলা-সজ্জিত রাজপথ থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে এই গ্রামে হানা দিল হাতি। দাঁতাল। দলছুট। শেষ সম্বল দু’বস্তা ধান রাখা ছিল ঘরে। মাঝরাতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ঘর। খড়ের চালা তছনছ। পড়িমড়ি খোঁড়া মেয়েটাকে টেনে দালানে এসে দাঁড়ান মায়া বাউড়ি। ভয়ংকর দৃশ্যটা নিরুপায় চোখে দেখতে থাকেন। ভাঙা দেয়ালে শুঁড় সমেত মাথাটা সম্পূর্ণ ঢুকিয়ে দিয়েছে কালো দানবটা। শুঁড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেঙে-পড়া মাটির স্তূপ সরিয়ে আলগোছেই যেন তুলে নেয় শোলার মতো পলকা দু’বস্তা ধান। দালানে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ উঠে বসেন, কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন অন্ধকারে।

বিক্রমপুর জঙ্গল-লাগোয়া গ্রাম নয়। কিন্তু হাতির তাণ্ডবের এখন আর নির্দিষ্ট রুট নেই। নেই প্রথাসিদ্ধ করিডর। যেহেতু বিক্রমপুর জঙ্গল নয়, তাই এখানে বন-কমিটিও নেই। তাই বিক্রমপুরের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব বন দফতরে পৌঁছবে কী ভাবে? ভরসা পঞ্চায়েত সদস্য। তিনিই যাতে উদ্যোগ নিয়ে ধ্বংসলীলার কথা বন দফতরের বড়কর্তাদের জানান, তাই তাঁকেই আঁকড়ে ধরেন মায়া বাউড়ি। ‘জানো, শুঁড় লিয়ে বিছে বিছে আসতে লাগছে। দু’বস্তা ধান শুঁড়ে লিয়ে চলি গেল। যা বাবা যা, আমাদের আর কিছু করিস লাই। রাতে তেলিপাড়ায় শুতে যাই। সন্ধি হলি বসতে থাকতে লারি জানো?’ পঞ্চায়েত সদস্য সব শুনে গম্ভীর মুখে চলে যান। কিছু ক্ষণ আলোড়ন তুলে ফের নির্জনতায় ডুবে যায় গ্রাম। মনে আশা জাগিয়ে বাছুরটাকে ঘাস খাওয়াতে থাকেন মায়া জয়ন্তীরা। হয়তো এক দিন চলে আসবে বন দফতরের ক্ষতিপূরণের টাকা। আবার হয়তো আসবেও না।

শুধু বিক্রমপুর কেন, ১৪ তারিখ রাতে হাতির হামলায় ঘর ভেঙেছে শালকোয়া গ্রামের নারান রায়, বাসুদেব রায়, অশোক রায়, ঊর্মিলা রায়, কার্তিক রায়দের। শুধু বাড়ি ভাঙাই নয়, বস্তা-বস্তা ধান অবলীলায় তুলে নিয়ে ভূরিভোজ সেরেছে হাতিরা। পুরুষরা বেশির ভাগ দিনই বাড়ি থাকে না। মুনিশ খাটতে বাইরে যায়, সেখানেই থেকে যায়। সারা দিন খাটাখাটনির পর ফের রাত জাগতে হবে, হাতি খেদাতে হবে, অনেকে এই ভয়েই গ্রামে ফিরতে চায় না। পর দিন তো কাজে বেরোতে হবে, রোজগার তো করতে হবে। কাঁহাতক আর দিন-রাত এক করা যায়। ফলে অনেক দিনই এই সব গ্রাম রাতে প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। প্রাণ হাতে নিয়ে সম্পত্তি সামলায় ভগ্নস্বাস্থ্যের মহিলারাই।

দু-দুটো ঘর ভেঙে দিয়ে চলে গেছে দাঁতালটা। এই দাঁতালটাকে চিনেও গেছে গ্রামের মানুষ। ভাঙা ঘরটায় ঊর্মিলার চার বছরের নাতি দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে মাটির চাঁইগুলো দেখতে থাকে। ঊর্মিলা বলেন, ‘রাতে ভয়ে ঘুমই ধরে না আমাদের। আমরা ঘর-দোরান করতে না পারি, আমাদেরই ক্ষতি কইরে দিল!’

১৬ অগস্ট হাতি ঘর ভাঙল বিকো ভানোপুর গ্রামে। আদিবাসী গ্রামটায় দারিদ্র লেপ্টে রয়েছে। স্বামীহারা সরলা মুর্মুর জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ তাঁর রুগ্ণ অসুস্থ ছেলেটা। দিনকে দিন ক্ষয়াটে মেরে যাচ্ছে। কী যেন কঠিন রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা কল্পনার অতীত। একটুখানি জমি ছিল, অভাবের তাড়নায় তা-ও বন্ধক দিতে হয়েছে। সরলা ভাবেন, সব যায় যাক, শুধু ছেলে যেন তাঁর কাছ থেকে চলে না যায়। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে তো কিছু নেই। থাকার মধ্যে ছিল দুটো হাঁড়ি। ঘর ভেঙে দুটো হাঁড়িই শুঁড় দিয়ে তুলে আছড়েছে দাঁতালটা। কোনও রকমে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন সরলা। এখন ভাত খাওয়ার হাঁড়িও তাঁর কাছে নেই। নতুন কিনবেন, সে পয়সাও নেই।

কোদালিয়া গ্রামে পানের বরজ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল হাতি। বরজ ভেঙে গেলে দ্বিতীয় বার আর তা বোনা যায় না। টাকা কে টাকা সব জলে। পূর্ণিমা লোহারার অভিজ্ঞতাও কম কীসে? পাশের গ্রামে পরবে গিয়েছিলেন স্বামী। রাত কাবার করে ঘরে ফিরতে সকাল। আষাঢ় মাস। টিপটিপানি বৃষ্টিতে দুই ছেলেকে নিয়ে একা পূর্ণিমার গা একটু ছমছমই করে। ভিতরের ঘরে না শুয়ে ছেলেদের নিয়ে বাইরের বারান্দা-লাগোয়া ঘরে শুয়েছিলেন। ভিতরের ঘরটা হাতি ভেঙে তছনছ করে দিল। ঘটনার বিবরণ বন দফতরকে জানানো হয়েছিল, কিন্তু দু’মাস পার, মিলেছে কেবল একটি ত্রিপল।

বড়জোড়া-বেলিয়াতোড় অঞ্চলে, সন্ধে নামলেই গ্রামগুলোয় আতঙ্ক। নিঃসাড়ে ঘর-লাগোয়া ঝোপে অন্ধকারে মিশে মানুষের প্রতীক্ষায় হাতি ওত পাতছে। এখন আর আগুন বোমায় সে ভাবে ভয় পাচ্ছে না দামালরা। উলটে আগুন জ্বললে, বোমা ফাটলে সে দিকেই তেড়ে-তেড়ে আসছে। মানুষ বুঝতেই পারছে না, কী করে তাদের রুখবে।

বেলিয়াতোড়-দুর্গাপুর রাজ্য সড়কের দেজুড়ি মোড় থেকে বাঁ দিকে রাস্তা চলে গিয়েছে কোচকুণ্ডার দিকে। ডান দিকে সাহারজোড় জঙ্গল। কিছুটা পরেই মুক্তাতোড় গ্রাম। সেখানে দাঁতালের শিকার হল চার বছরের শিশু আশিস লোহারা। ঘরের দেয়াল ভাঙা হাতির শুঁড় খুঁজে পায় তাকে। তার পাশে আরও দুটি ছোট মেয়েকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন মা পূর্ণিমা লোহারা। তিনি কিছুই করে উঠতে পারেননি। তাঁর চোখের সামনে ক্ষিপ্ত হাতি শুঁড়ে তুলে নিয়ে যায় ছেলেকে। ভাঙা ইটের ঘায়ে পা ভাঙে এক মেয়ের। তার চিকিৎসা বাবদ অবশ্য সামান্য কিছু টাকা বন দফতর থেকে মিলেছে। আর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের এক লাখ টাকার পঞ্চাশ হাজার পাওয়া গিয়েছে। আশপাশের খাড়াড়ি, কাঞ্চনপুরের মতো গ্রামগুলোয় সব একই ছবি। নির্বাক পূর্ণিমা লোহারার গা ঘেঁষটে দাঁড়িয়ে থাকে দুটি শিশু। পড়ন্ত বিকেলে আশঙ্কার স্রোত তিরতির করে বইতে থাকে। ১৪ অগস্ট পঁচিশ-তিরিশের একটি দল গ্রামে হামলা চালিয়ে গেছে। কবে কী ঘটে যাবে কিচ্ছু বলা যায় না। সূর্য ডুবলেই গৃহবন্দি। রাত বাড়লেই কথা বলা বারণ, কারণ ঘাপটি-মারা দাঁতাল মানুষের আওয়াজ শুনলেই আক্রমণ চালাচ্ছে। পূর্ণিমা লোহারা, শংকর লোহারা, ভন্দি লোহারা, নির্মল লোহারার মতো কিছু মানুষ এখনও রয়ে গিয়েছেন, কিন্তু কত দিন থাকবেন বলা শক্ত। অনেকেই গাঁয়ের মায়া পাকাপাকি ত্যাগ করে বড়জোড়া, দেজুড়িতে ঘর বাঁধছেন। প্রাণের দায় বড় দায়।

প্রাণ অবশ্য বাঁচাতে পারেননি বরেন গড়াই। খেতের ধান ঠিকঠাক রয়েছে কি না দেখতে গিয়েছিলেন রাত সাড়ে বারোটায়। সংগ্রামপুরে সেটা অনেকটাই রাত। সাহসটাও কি একটু লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল সঙ্গে পাঁচ জন জোয়ান মরদ থাকায়? দুজন পালাতে পেরেছিল। এক জন অশ্বত্থ গাছে আশ্রয় নেওয়ার সময় পেয়েছিল। পড়শি সুনীল বাউড়ির পা ভাঙল। সেই ভাঙা পা নিয়ে গড়াতে গড়াতে হাতিদের নাগাল এড়াতে পেরেছিলেন তিনি। বরেন কিছুই করতে পারেননি। হাতিটা শুঁড়ে পেঁচিয়ে তাঁকে নিয়ে চলে যায় তার দলের কাছে। সেখানে সবাই উন্মত্তের মতো তাঁকে মাটিতে দলে পিষে দেয়। ঘরে ক্ষতিপূরণের টাকা এসেছে শুধু, কিন্তু চাষাবাদ মাঠেই মারা গেছে।

বরেনকে অবশ্য কতকটা বাধ্য হয়েই সে রাতে খেতে যেতে হয়েছিল। গত বছরে আট বিঘা জমিতে চাষ করে জুটেছিল মাত্র দশ বস্তা ধান। যেখানে বিঘা প্রতি অন্তত আট বস্তা ধান ঘরে ওঠার কথা। কিন্তু হাতি যদি খেত মাড়িয়ে যায়, তা হলে ধান ঘরে ওঠে কী করে? আর ক্ষতিপূরণের গল্পও তো ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো। বিঘা প্রতি রাসায়নিক সার, খেতমজুরি, ওষুধ, বীজ— সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় ৪০০০ টাকায়। সেখানে হাতি মাড়িয়ে গেলে দাগ নম্বর দিয়ে, ছবি তুলিয়ে বন দফতরে জমা দিতে হবে। এর পর মিলবে ক্ষতিপূরণের ২৫০ টাকা। তার আবার দিনক্ষণ ঠিক নেই।

সুনীল বাউড়ি কেমন আছেন এখন? ঘরের সামনে পাকাপাকি ভাবে জায়গা নিয়েছে বাঁশ চিরে তৈরি করা একটা ক্রাচ। পা ভাঙার পর দিন পনেরো বাঁকুড়া মেডিকাল কলেজে ভর্তি ছিলেন। ভর্তিই ছিলেন শুধু, চিকিৎসা হয়নি। তার পর সরকারি স্বাস্থ্যবিমার স্মার্ট কার্ড দেখিয়ে স্থানীয় নার্সিংহোমে ‘উপাশন’ করিয়েছেন সুনীল। তা ‘উপাশন’-এর পর পা এখন কি ঠিক আছে? না, তা নেই। পা এখনও ফুলে ঢোল। খেতমজুরির কাজ শিকেয়। রোজগার লাটে উঠেছে।

হাতি এ ভাবেই মানুষের প্রতি যেন জন্মক্রোধ নিয়ে জীবন তছনছ করছে গ্রামগুলোর। হয়তো তাকে এ অবস্থায় এনে ফেলার জন্য মানুষই দায়ী। হয়তো নয়। কিন্তু এখন সর্বহারা মানুষগুলোর সামনে পাঁচের পাতার চার লাইনের খবর হওয়ার বাইরে আর কোনও রাস্তাই কি খোলা নেই?

ddasgupta122@gmail.com

debashish dasgupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy