মার্চ, ১৯৮৬। কলকাতার মেট্রো রেল চালু হয়ে গেলেও, কাজ তখনও চলছে। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের বাইরে জোরদার চলছে ফিনিশিং টাচ।
সুধীরদা পাগল হওয়ার জন্য বটকা ছাগলের ব্যা ব্যা-র মতো ‘মা মা’ করত আর দু’হাত তুলে গাইত, ‘আমায় দে মা পাগল করে’। ওই পর্যন্তই, মা তার কথা কোনও দিন কানে নিল না, ফলে সুধীরদার আর বামাক্ষ্যাপা হয়ে ওঠা হয়নি। অথচ জগুবাজার থেকে সুধীরদার মিনতিকণ্ঠ মায়ের কানে না যাওয়ার কথা নয়, কালীঘাট তো ক’হাত তফাতে মাত্র! জগুবাজারে ভবানীপুরে হোটেলে আমরা জনাপঁচিশ বোর্ডার, সুধীরদা অন্যতম। পঁচিশ বোর্ডারের স্পেসিফিকেশন ছাব্বিশ রকমের। কেউ বিবাহিত কিন্তু স্ত্রী-তাড়িত। কেউ অবিবাহিত, কিন্তু (পর)স্ত্রী-জড়িত। কাউকে পাগলামির জন্য চাকরি থেকে করা হয়েছে বরখাস্ত, তো কেউ দরখাস্ত করে করে পাগল একটা চাকরির জন্য। এ সবই আশির দশকের শুরুয়াতের ঘটনা।
আশির দশক যেমন আসলে হাসির দশক ছিল সুভাষ চক্কোত্তিদের কাছে, তেমনই সে হাসি আমারও ছিল জীবনের জিয়নকাঠি প্রাপ্তির কারণে। অজ বাঁকুড়া জেলা থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির ডাক পেয়ে কলকাতায় এলাম আশির ফেব্রুয়ারিতে। বই-ম্যাগাজিন পড়া, টুকটাক লেখালিখি, নাটক দেখা, গানবাজনা শোনা বরাবরই নেশা। কলকাতা এসেই ইডেনে সুভাষবাবুদের যুব-উত্সব দেখার সৌভাগ্য হল। একটা স্টেজে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ‘খড়ির গণ্ডি’ তো একটা স্টেজে সতীনাথ-উত্পলা, খবর পেলাম আমার প্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস গাইবেন আর একটা স্টেজে। মানে এক বুভুক্ষুর কাছে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই অবস্থা আর কী। সে আনন্দপর্ব কাটল। ভাবলাম কলকাতার রাস্তাঘাট এ বার চিনতে হবে। কিনতে হবে ম্যাপ। তখন তো আর জিপিএস ছিল না যে ক্লিক করলেই টালা থেকে টালিগঞ্জ ভেসে উঠবে। ধর্মতলার বাসস্ট্যান্ড থেকে কেনা কলকাতা গাইড-ই অন্ধের যষ্টি। অফিসে কলিগদের বেশির ভাগই আবার কলকাত্তাইয়া। দু’এক জন কাঠবাঙাল। গা থেকে খামু-যামুর গন্ধ যায়নি। তারা ঘটি ঘটি করে কলার উলটে গলা ঢাকে। কলকাতা নিয়ে যাকেই কিছু জিজ্ঞেস করি অমনি ব্যাটাদের ন্যাজ মোটা হয়ে যায়। অগত্যা ‘একলা চলো রে’। এক দিন হেস্টিংস থেকে গঙ্গার পাড় বরাবর হাঁটি বাগবাজার পর্যন্ত। আর এক দিন ঘুরি আলিপুর থেকে গড়িয়া। ঘুরতে ঘুরতে মাতালের মদের ঠেক চেনার মতো মূল জায়গাগুলো হাতের চেটোতে সেঁটে গেল। মহাজাতি সদন, কলামন্দির, অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন, স্টার থিয়েটার, সব নখদর্পণে। এ বার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার পালা। কলকাতার বুক চিরে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়াই আর গুনগুন গাই, এ কী অপূর্ব শহর দিলে বিধাতা আমায়।
থিয়েটার দেখাটা আফিমের নেশার মতো রক্তে সেঁধিয়ে গেল। বহুরূপী, নান্দীকার, সুন্দরম, সায়ক, চেতনা, চেনামুখ সব চেনা হয়ে গেছে। মৃচ্ছকটিক, জগন্নাথের রথ, রাজদর্শন, পাপপুণ্য, গ্যালিলিও, এক এক করে গিলি এক এক রবিবার। মনে চাগাড় দিতে লাগল, আমিও অভিনয় করব। সুযোগ এল অফিসে। বিলকিস বেগম-এর চন্দ্রাণী হালদারের সঙ্গে অভিনয়। ভেবেছিলুম জুতো ছোড়া হবে আমাকে তাক করে। না, উতরেই শুধু গেলাম না, সেরা অভিনেতার পুরস্কারও পেলাম। ন্যাজ একটু মোটা হল।
আজ মানবেন্দ্র তো কাল শ্যামল-সন্ধ্যা, পরশু কলামন্দিরে আমজাদ আলির সরোদ। মাঝেমধ্যে সুভাষবাবুরা ‘চলছে না, চলবে না’র ফাঁকফোঁকরে বন্ধ প্রসব করেন। আমাদের হোটেলে আগের রাত থেকে শুরু হত পিকনিক। এক্স-ডিফেন্স কলিগরা ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সস্তায় দামি বোতল আনত। রাতে চলত পেগের পর পেগ। পর দিন পিটিএস-এর সামনে টেনে আনতাম ইডেনকে। ব্যাট-বল হাতে মস্তি করে খেলতাম ক্রিকেট। ভিক্টোরিয়ার সামনের ফাঁকা জায়গাতে (এখন ঘেরা) পেলে-মারাদোনা কারিকুরি চলত। বন্ধ মানে যে ফুর্তি তা আমাদের মতো সরকারি বাবুদের মতো কে আর জানত! সবাই মিলে বোতল গিলে চেঁচাতাম, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
মেট্রো রেলের কাজ প্রায় শেষের দিকে, দ্বিতীয় হুগলি সেতুও হাঁটি-হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন খবরের কাগজে পাঠকের কলমে আমার চিঠি প্রায়ই বেরোচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিবন্ধ, ছোটগল্প প্রকাশিত হচ্ছে। কখনও-সখনও ফ্রিল্যান্স রিপোর্টারি। প্রাণ খুলে গাই, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। হঠাত্ হোটেল ছাড়ার হুমকি এল। ম্যানেজার বললেন, হোটেল বিক্রি হবে। মুস্তাফিদা বলল, মগের মুলুক? বিয়ের পর বউ ছাড়তে পারি, কিন্তু প্রাণের এই হোটেল জান থাকতে ছাড়ছি না। মুস্তাফিদা জেদি মানুষ। বউ ভোকাট্টা হওয়ার পর গানবাজনা নিয়ে ভুলে আছেন। প্রথমে সেতার দিয়ে শুরু। বলতেন, এখন প্যাঁক দিচ্ছিস দে, যখন বেতারে সেতার বাজাব, তখন দেখবি... রবিশংকর হতে আর ক’হাত দূরে, সেতারের ইচ্ছে-তার কেটে গেল। গান শুরু করলেন। বলতেন, তুমি তো বিষ্ণুপুরের ছেলে। বিষ্ণুপুরের সংগীত তো খুব বিখ্যাত। কাকে ফলো করি বলো দেখি? আমি বলতাম, জ্ঞান গোঁসাইয়ের গান আমার খুব ভাল লাগে। ব্যস শুরু হল পর দিন থেকে শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়। ভীষ্মলোচন শর্মার ঠেলায় এক দিন বললাম, মুস্তাফিদা, পাখি আর ফিরবে কোথায়, পাখি সব ছেড়ে রব বেচারারা এখন তো জগুবাজার থেকেও হাওয়া। মুস্তাফিদা চারটে গালাগাল দিলেন। আমি চুপ করে থাকি। হোটেল ছাড়ার নোটিসে এমনিতেই মুষড়ে পড়েছি। আর এক বোর্ডার দিলীপদা গোছাগুছি শুরু করে দিয়েছেন। অ্যাদ্দিন গেয়ে এসেছেন ‘মরার আগে মরব না ভাই মরব না’, অথচ সবার আগে নিজেই ভাগলবা। মুস্তাফিদা বললেন, মানুষ চেনো, নন্দী।
এর পর নিজেই তত্পর হয়ে থানা-আদালত ঘুরে কিছু টাকা পকেটস্থ করে পাড়ি দিলাম সল্টলেকের নতুন কোয়ার্টার্সে। আশির দশকের সল্টলেক বেশ ফাঁকা। তখনও কাশবনে হেঁটেছি সল্টলেকে। নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে। অফিস যাওয়ার পথে ওয়েলিংটন নামতাম। পত্রিকা অফিসে লেখা জমা দিয়ে ডিউটিতে যেতাম। সে সুখও বেশি দিন সইল না। একটা বিদেশি প্রোজেক্টের কাজে বদলি হলাম খড়্গপুরে। বাজ পড়ল মাথায়। সব ছেড়ে যেতে হবে! ’৮৬-র জুনে অলবিদা বলে কলকাতা ছাড়লাম। জ্ঞান গোঁসাই এ বার মুস্তাফিদার গলা ছেড়ে আমার গলায়। শূন্য এ বুকে...
sudarsan_nandi@yahoo.com
আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়:
হ্যালো 80s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy