Advertisement
E-Paper

হুল্লোড়বাজ বিষণ্ণ উদাসীন কবি তিন

কখন যে বাস আমার স্টপ পেরিয়ে গেছে, কখন যে বাস গুমটিতে ঢুকে আমারই সঙ্গে গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর বাসটা আড়মোড়া ভেঙে কাঁপতে শুরু করল। গড়াতে গড়াতে সিঁথির মোড়ে আসা মাত্র আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০২
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

কখন যে বাস আমার স্টপ পেরিয়ে গেছে, কখন যে বাস গুমটিতে ঢুকে আমারই সঙ্গে গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর বাসটা আড়মোড়া ভেঙে কাঁপতে শুরু করল। গড়াতে গড়াতে সিঁথির মোড়ে আসা মাত্র আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে এই গলি ওই গলি সেই গলি পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম সেই চায়ের দোকানটার সামনে। পাশেই ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’র কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর বাড়ি। তিনতলায় ছোট্ট একটা ঘর ছিল ভাস্করের। সেখানেই পড়াশোনা করা, সেখানেই কবিতা লেখা, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়া, তার পর ঘুম থেকে বেরিয়ে এই স্বপ্ন ওই স্বপ্ন ঘুরে আরও কত স্বপ্নে যে ঢুকে পড়ত ভাস্কর, তার হিসেব ও নিজেই জানত না। কখনও ডাক্তারের চেম্বারে, ডাক্তারের আগে এসে বসে থাকত স্বপ্নের ভেতর। কখনও ছোট বোনের পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকত, কখনও এক দার্শনিক বেড়ালের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা চালিয়ে যেত— সব সেই স্বপ্নেরই ভেতর। একটা সময় ঘুম থেকে উঠে লিখত, ‘আমাদের স্বপ্ন নেই স্যারিডন আছে’। আমি বলতাম, এত বাজে কথা লেখেন কেন! আপনার তো স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নেই। ভাস্কর হাসত, তার পর জিজ্ঞেস করত, ‘খিদে পেয়েছে?’ আমি মাথা নাড়তাম। ভাস্কর তিনতলার জানলা থেকে চিৎকার করে কী সব বলত, আর নীচের দোকানটা থেকে একটা বাচ্চা ছেলে ঠোঙা-ভর্তি লেড়ো বিস্কুট দিয়ে যেত, সঙ্গে দু’কাপ চা। তার পর লেড়ো বিস্কুট আর চা খেতে খেতে, গেরুয়া পরা ভাস্করের বাবার খড়মের খটাখট শুনতে শুনতে কখন যে আমরা উড়তে উড়তে খালাসিটোলা চলে যেতাম! দরজা খুলে বেরনোর সময় ভাস্করের বাবা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকতেন আমাদের দিকে, যেন ঘোর অচেনা দুই মানুষ। ভাস্করকে কোনও দিন ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি।

খালাসিটোলা আলো করে তখন বসে আছেন কমলদা, মানে কমলকুমার মজুমদার, ইন্দ্রনাথ মজুমদার, শক্তিদা, সুনীলদা, সোনালি দাশগুপ্তর ফেলে যাওয়া শায়া পরে হরিদা। কে নেই? বর্ধমান থেকে সুব্রত চক্রবর্তী, পার্ক সার্কাস থেকে শামসের আনোয়ার। খালাসিটোলা জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অসামান্য মানুষ ছিল সুব্রত চক্রবর্তী। বইয়ের ভেতর উইপোকাদের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এ রকম বন্ধুবৎসল কবি আমি আর দেখিনি! এক বার সুব্রত ফোন করল, ‘বোয়াল মাছ খাও?’ আমি বললাম, কেমন খেতে? ‘ঠিক বোয়ালের মতো। কাল ফার্স্ট ট্রেন ধরে চলে এসো।’ গেলাম। গিয়ে দেখি, সুব্রত বাড়ি নেই। ওর বউ মালা বলল, হাসপাতালে। ছুটলাম। ব্যান্ডেজ বেঁধে বসে আছে সুব্রত। একটা বোয়াল নাকি বাজারের জলের গামলা থেকে লাফিয়ে উঠে সুব্রতর পায়ের কড়ে আঙুল কামড়ে দিয়েছিল। রক্তারক্তি কাণ্ড। এক এক দিন মাঝরাত্তিরে বর্ধমান শহর ছাড়িয়ে রিকশাওয়ালা তার দুই মাতাল সওয়ারিকে নিয়ে কোথাও না গিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিক এসে দাঁড়াত সুব্রতর বাড়ির সামনে। এক দিন হঠাৎ একটা মাঠের মাঝখানে রিকশা থামিয়ে দিল সুব্রত। আমাকে বলল, ‘দেখতে পাচ্ছ?’ বললাম, কী দেখতে পাব? ‘সতীদাহ হচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না? ওই যে দেখো আগুন জ্বলছে, ওই দেখো সতীকে নিয়ে আসছে। দেখতে পাচ্ছ না? কত ঢোল বাজছে, ঢাক বাজছে, দেখতে পাচ্ছ না?’ আমি তাকিয়ে থাকলাম ‘বালক জানে না’র কবি সুব্রতর মুখের দিকে। কবি সত্যিই সব দেখতে পাচ্ছে, বুঝতে পারলাম। পরে জেনেছিলাম, কোনও কালে ওখানে নাকি সত্যিই সতীদাহ হয়েছিল।

ইদের দিন দুপুরবেলা এক থলি মাংস নিয়ে হাজির হত শামসের। এক বার ইদে কলকাতা ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। ভিজে টইটম্বুর হয়ে শামসের এল। সেই মাংসের ঝোল রেঁধে খেয়ে নৌকো করে ভাসতে ভাসতে আমরা চলে গেলাম নিউ আলিপুরে অপর্ণার বাড়ির দোরগোড়ায়। দেখি, জলে পা ডুবিয়ে ছোট ছোট ঢেউ কাটছে অপর্ণা। যখনই শামসের আসত, কাকুতিমিনতি করে বলত, ‘এক বার আলাপ করিয়ে দে না অপর্ণা সেনের সঙ্গে... দে না... দে না...’ বলতাম, কী করবি, অপর্ণার সঙ্গে আলাপ করে? বলত, ‘কিছুই করব না। আমি আর কী করতে পারি বল? তবু এক বার আলাপ তো করিয়ে দে, অন্তত বাড়িতে তো নিয়ে চল।’ এর বেশ কিছু কাল পর এক দিন ফোন করলাম শামসেরকে: চল কাল অপর্ণার বাড়ি নিয়ে যাব তোকে। শামসের বলল, ‘না, যাব না।’ আমি বললাম, সে কী! কী হল? শামসের বলল, ‘ভাল লাগছে না। কী হবে?’— তা হলে কার কাছে যাবি, বল? ‘কারও কাছে যাব না।’

সেই সময় থেকেই ‘মা কিম্বা প্রেমিকা স্মরণে’র কবি শামসের ভাবতে শুরু করল, কবিতা-ফবিতা কিচ্ছু হচ্ছে না। কী একটা খেয়ে পিজি হাসপাতালের বেডে একটানা এক মাস ঘুমিয়ে থাকল, সেই ঘুম থেকে নীচে নামতে নামতে, নামতে নামতে এক্কেবারে মাটির তলায় পচে গেল।

সুব্রত, ভাস্কর, শামসের— আমরা কেউই কিছু হতে চাইনি। খবরকাগজগুলোর অফিসে তখন ম-ম করছে ডাকসাইটে কবি-লেখকদের দল। আর নীচের, আরও নীচের ছোট রাস্তা, মেজ রাস্তা, বড় রাস্তার ও-পারে সেই সব কবিরা দাঁড়িয়ে থেকেছে, যাদের কিছু হওয়ার কোনও বাসনাই নেই। এক দিন সেই রাস্তার ওপরেই ঝুপ করে নেমে এল ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে ভাস্কর বলল, ‘শীতকাল কবে আসবে’ আপনাকে উৎসর্গ করছি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, তাকিয়ে দেখি ভাস্কর নেই। দেখতে পেলাম, সিঁথির বাড়ির দরজার কড়া নাড়ছে ভাস্কর। খটাস খটাস করে এসে ওর বাবা দরজা খুলে দিচ্ছে। আবার তাকিয়ে আছে ভাস্করের দিকে, যেন অচেনা গ্রহের কোনও মানুষ।

সুব্রত, ভাস্কর, শামসেরের মতন হুল্লোড়বাজ, বিষণ্ণ আর উদাসীন কবি আমার এখনও দেখা হয়নি। চলে যাওয়ার আগে সুব্রত বলেছিল, থ্যাংক ইউ। কাকে থ্যাংকস জানিয়েছিল জানি না। শামসের কিছু বলতেই পারেনি। ভাস্কর এক প্যাকেট চারমিনারের সবগুলো সিগারেট একের পর এক জ্বালিয়ে নিয়ে উঠে পড়েছিল হাসপাতালের শেষ বিছানায়।

মাঝে মাঝে ঘুমের ভেতর খালাসিটোলার বিশাল কাঠের দরজা ঘরর-ঘরর করে খুলে যায়। দেখি, অদ্ভুত এক আলোর মধ্যে বসে আছে ভাস্কর, তার পাশে সুব্রত, তার পাশে শামসের।

কবে যেন লিখেছিলাম, ‘দেখা হবে—/ একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে অজস্র পাখির ভিড়ে,/ ছড়িয়ে বিশাল ডানা উড়ে যাচ্ছি/ তোমার ছায়ায়, পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাজার স্বপ্নেরা; সার বেঁধে/ তারা যাবে ঘুমের ভেতর এক দেশে,/ ঘুমের ভেতর দিয়ে নেমে যাবে দুঃস্বপ্নের ঘুমে।’

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy