Advertisement
E-Paper

সচিন, তোমার অপেক্ষায় রয়েছেন গুরমিত

গুরু গোবিন্দ সিংহের ছবির পাশে গুরমিত রেখে দেন সচিনের ছবি। পুজো করেন। এক কথায় অবিশ্বাস্য! লিখছেন শান্তনু মৈত্রগুরু গোবিন্দ সিংহের ছবির পাশে গুরমিত রেখে দেন সচিনের ছবি। পুজো করেন। এক কথায় অবিশ্বাস্য! লিখছেন শান্তনু মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৪০

গুরমিত সিংহের কথা আমার এখনও মনে পড়ে!

এত বছর কেটে গেল, তবু ক্রিকেটের কথা উঠলেই গুরমিতের অ-শরীরী প্রবেশ যেন অবশ্যম্ভাবী!

সেটা ২০০১ সাল। মে আর জুনে কাজের সূত্রে আমি ছিলাম মেলবোর্নে। দেশে ফেরার দিন হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলাম একটা ট্যাক্সিতে। চালক পঞ্জাবি। কিছুটা যেতেই আলাপ হয়ে গেল। নাম জানলাম, গুরমিত। গুরমুখীতে কথা বলছিলাম বলে অচিরেই সেই প্রৌঢ় চালকের সঙ্গে আলাপটা গাঢ় হল।

মনে আছে, তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেমন লাগে অস্ট্রেলিয়া? তিনি বলেছিলেন, “দেশটাকে বড় মিস করি। বিকেলবেলার আড্ডা...বন্ধুর দল...রবিবার রবিবার সকালে ক্রিকেট খেলতাম, সেটাও মিস করি। আর হারিয়েছি সর্ষে খেতে বসে মকাইয়ের রুটি আর সর্ষেশাক দিয়ে জমিয়ে লাঞ্চটাও।” কথায় কথায় ক্রিকেট এল। আসবেই। অস্ট্রেলিয়ায় বসে দেশীয় দুই আত্মজ ক্রিকেটের কথা বলবে না, তা কি হয়? ক্রিকেট এল, কিন্তু, তখনও জানতাম না, তার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাবে আমার জীবনদর্শনও!


সচিন

গাড়ি চালাচ্ছেন আর কথা বলে চলেছেন গুরমিত। “জানেন, এক বার আমার ট্যাক্সিতে দু’জন উঠেছিল। ওরা নিজেদের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করছিল। কথায় কথায় বলল, ‘সচিন তেন্ডুলকর ওভাররেটেড। শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারা।’ গাড়িটা তখন বেশ জোরেই চলছিল। মাথার মধ্যে কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল...মাঝরাস্তায় ব্রেক কষে বললাম, নেমে যান আমার গাড়ি থেকে। ওঁরা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, কেন? বললাম, এই গাড়িটা আসলে তেন্ডুলকরের বাড়ি। আমি সেই বাড়ির মালিক। এই বাড়িতে আমি কোনও ভাবেই তেন্ডুলকরের কোনও সমালোচনা সহ্য করব না। তোমরা অন্য গাড়িতে যাও।”

কি জানি কেন, মনে হল, যে ভারতবর্ষ মাঝে মাঝে আমার চোখে ঝাপসা হয়ে যায়, সেই ভারতবর্ষটাই কেমন করে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল! গুরু গোবিন্দ সিংহের ছবির পাশে গুরমিত তাই সচিনের ছবি রেখে দেন। পুজো করেন। এক কথায় অবিশ্বাস্য!

এখানেই শেষ নয় কিন্তু। এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম। ভাড়া হয়েছে ৭৫ অস্ট্রেলীয় ডলার। নেমে ভাড়া মেটাতে যাব, হাত চেপে ধরলেন প্রৌঢ়। করেন কী! “আরে, আপনার থেকে ভাড়া নেব কী করে? আপনি সচিনের কাছে ফিরবেন। হয়তো কোনও দিন সচিনের সঙ্গে আপনার দেখা হবে...ওকে বলবেন, এই এত দূরদেশেও ওর এক জন ভক্ত আছে, যে তার দেবতার অপমান কোনও দিন সহ্য করেনি। আপনি তো দূত, আপনার থেকে কী করে ভাড়া নিই বলুন তো?” হাত নেড়ে বিদায় নিলেন গুরমিত আর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

আর কখনও দেখা হয়নি গুরমিতের সঙ্গে, কিন্তু তিনি থেকে গিয়েছেন আমার মনে, তাঁর ক্রিকেটীয় ধর্ম নিয়ে, তাঁর বিশ্বাস নিয়ে। আমি নিজেও ক্রিকেট খুব ভালবাসি। আগে খেলেওছি। নিয়মিত চর্চাও করি। কিন্তু এই ঘটনার পরে ক্রিকেট সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেল।


গাওস্কর

এ বারের বিশ্বকাপেও নানা ম্যাচ দেখছি। এখন তো টান টান উত্তেজনা। নক আউট পর্যায়। তবে, যা কিছুই হোক, নিজেদের দলের প্রতি আমার সমর্থনটা একেবারেই শর্তহীন। জিতলেও পাশে আছি, হারলেও থাকব। সমর্থনে একটুও টাল খাবে না। তবে আশা রাখছি, ভালই হবে আমাদের।

মুম্বইতে যে কোনও জায়গায় যেতে ট্র্যাফিক জ্যাম একটা বড় সমস্যা। কিন্তু এ বার বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় দেখলাম, রাস্তা প্রায় শুনশান। চট করে গন্তব্যে পৌঁছলাম সে দিন। তখনই মনে হল, সপ্তাহে কেন একটা করে দু’দেশের ক্রিকেট ম্যাচ হয় না? এই ফাঁকে আমাদের মুম্বইয়ের একটা মজার কথা জানিয়ে রাখি। বিভিন্ন মহল্লায় মোবাইল ফোনের উপরে ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগিয়ে দর্শকদের খেলা দেখানো হয়। ‘পজিশন’ অনুযায়ী দর্শনী ৭৫ থেকে ১০০ টাকা। খুব বেশি লোক হয়ে গেলে তাদের ‘চয়েস’ দেওয়া হয়, মোবাইলের একেবারে সামনে কোন অর্ধে খেলা দেখবে, প্রথমার্ধ না দ্বিতীয়ার্ধ!

আসলে, আমাদের দেশে আলাদা করে কার্নিভাল করতে হয় না। ক্রিকেট ম্যাচের সময় টিভির দোকানের সামনে লোকজনের যা ভিড় হয় সেই ভিড়েই অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে এক একটা কার্নিভ্যাল হয়ে যায়!

ক্রিকেটের কথা লিখতে বসলেই আর একটা লোকের কথা বলতেই হয়। তাঁর কথা আমি ‘ফেরারি মন’-এ লিখেওছি। ’৭২ সাল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলার ম্যালকম মার্শাল সে বার ধুয়ে দিচ্ছেন ভারতকে। আমি তখন ছোট্ট। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে গিয়েছি খেলা দেখতে। দেখলাম, গাওস্কর হেঁটে যাচ্ছেন ক্রিজের দিকে। গোটা মাঠ করতালিতে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছে। বসেছিলাম স্কোয়্যার লেগ বাউন্ডারি পজিশনে। দেখলাম, লেগ গ্লান্স করে গাওস্কর ছয় মারলেন মার্শালকে। এবং এক বারের জন্যও চাইলেন না বাউন্ডারির দিকে! চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন মার্শালের প্রতি!

ওই ছোটখাটো চেহারার লোকটার উচ্চতা এক লহমায় যেন ছাপিয়ে গেল ফিরোজ শাহ কোটলার উচ্চতা! সে দিনই বুঝতে পেরেছিলাম, শরীরী ভাষা কাকে বলে! কাকে বলে ‘অ্যাটিটিউড’!

আসলে ক্রিকেট আমায় সে দিন জীবনের উচ্চতার মানে বুঝিয়েছিল! এ বারের বিশ্বকাপে সে কথাটাই আর একবার মনে করলাম মাত্র!

cricket worldcup 2015 Sachin Tendulkar Australia India melbourne airport taxi Sunil Gavaskar Shantanu Moitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy