Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জয় হোক ক্রিকেটের

মহাভারতের কালে যদি এ খেলার প্রচলন হত, তিরন্দাজি ছেড়ে অর্জুন হাতে ব্যাট তুলে নিতেন। লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদারমহাভারতের কালে যদি এ খেলার প্রচলন হত, তিরন্দাজি ছেড়ে অর্জুন হাতে ব্যাট তুলে নিতেন। লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৮
Share: Save:

কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের একতলায় ঢুকেছিলাম কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। মাঝেমধ্যেই যাই। বিশেষ করে মাসের গোড়ায় বহুবিধ দোকানবাজারে যাওয়া কবে থেকে যেন জীবনযাপনের অন্তর্গত হয়ে উঠেছে। আজ পথঘাট দোকানপাট সব খালি খালি। ভারত-ওয়েস্টইন্ডিজ খেলা চলছে। আপিসে সকলেই ছিল ভারী আনমনা। কারণ ধপাধপ পাকা তালের মতো ভারতের উইকেট পড়ছে। খুব বড় কিছু রান ধাওয়া করতে হচ্ছে এমনও নয়। কিন্তু ক্রিকেট হল অননুমেয় ক্রীড়া, অন্তত আমার তাই ধারণা। যত তার অনুমানযোগ্যতা বাড়ে ততই সে হারায় আকর্ষণ এবং বিশ্বস্ততা। ম্যাচ গড়াপেটার বিশ্রী সন্দেহ দর্শকের মনে ভিড় করে। ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রই গড়াপেটা ম্যাচ দেখে যে দুঃখ পান, যে হতাশা গ্রাস করে তাঁদের, অসাধু চক্র তার খোঁজ রাখে না।

আপিস থেকে বেরোবার সময় কিছুতেই মনের মধ্যে উদ্বেগ আসতে দিতে চাইনি। ভাবছিলাম যা হয় হোক। এই উদাসীনতার আরাধনা না করে আমার উপায় নেই, কারণ আরব্ধ একটি উপন্যাসে মন দিয়েছি। তাকে সুস্থির রাখা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মনোবাঞ্ছা আর কার কবে গোটাগুটি পূর্ণ হয়! আপিস, রাস্তা, দোকানপাট সর্বত্র উদ্বেগের চিহ্ন। যেন গোটা ভারত দাঁতে নখ কাটছে! অত যে বাজি কিনে জমিয়ে রাখা— পোড়াতে পারবে তো! ডাবের জল খেয়ে শান্ত হব কী, আমার সেই চিরচেনা ডাবওয়ালা পর্যন্ত আজ ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন এই বিকেলে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি চিনের সঙ্গে পাকাপাকি সীমান্ত নির্ণয় করতে বসতেন আজ, তা হলেও বুঝি এমত দৃশ্য তৈরি হত না! দোষ দেব কাকে? ভেবেছিলাম সচিনহীন এই বিশ্বকাপ হয়তো বা কিছু স্মৃতিমেদুর মনখারাপের। হয়তো বা লোভনীয় হবে না তেমন! কিন্তু ক’দিনেই বুঝে গেলাম, উত্তরসূরির প্রতি আস্থা হারায় না। বরং নতুন প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে জয় ও সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা প্রবলতর হয়। আমিও তাই উদাসীন থাকতে চেয়েও, বার বার লেখা থামিয়ে ছুটে গিয়েছি টিভির সামনে। শিখর ধাওয়ানের ব্যাটিং দেখতে দেখতে ভুলে গিয়েছি আমার হাতে কলম ধরা আছে! তাঁর কৃতিত্বের শিখরচূড়ায় ধাবমানতা মুগ্ধ করেছে আমাকে। বিশ্লেষণ করেছি, কতখানি ব্যাপকতা তাঁর যোগ্যতার? তাঁর প্রতিভা স্বল্পায়ু, না দীর্ঘায়ু? টেস্ট ক্রিকেটের ক্লাসিক ক্রীড়াকলা কি তাঁর আয়ত্তাধীন? মনে হল, এই তরুণ ধুমকেতু নন, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে থেকে যাবেন অনেক দিন! নতুন খেলোয়াড়, যাঁরা মুগ্ধ করেন, তাঁদের নিয়ে এমন ভাবনাও আমাদের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে আজ। কারণ, টেস্ট সিরিজ, ওয়ান ডে, আইপিএল, টি-২০ নিয়ে ক্রিকেট এখন বছরভর। শীতের মিঠে রোদ্দুর মাখা মরশুমি খেলা মোটেই নয়।


সুতরাং, মহাত্মা গাঁধী রোড-কলেজ স্ট্রিটের উত্তেজনা আমার আস্তিন ধরে ঝুলতে ঝুলতে চলল। প্রথমে গিয়েছিলাম একটি ধূপকাঠির দোকানে। টেমার লেনের মুখে। একেবারে বড় রাস্তার ধারে এই ত্রিভুজাকৃতি দোকানটি আমার এক পরম বিস্ময়। হরেক কিসিম পানমশলা অতি প্রাচীন কাচের জারে সাজানো। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধূপের সম্ভার। এরই মধ্যে জায়গা পেয়েছে চন্দনকাঠ, মোমবাতি। সেই মিশ্রিত আঘ্রাণের উপর ঝুঁকে পড়েছে সদ্য হাঁটতে শেখা ফুটফুটে বাচ্চাটা। টুলে বসে তার পিতামহ— ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনছেন। দোকানির নজর তাঁর দিকে। ‘ছ’ উইকেট পড়ে গেল। পারবে না। আজ আর পারবে না।’ বৃদ্ধের মন্তব্য। দোকানি হাল ছাড়ার লোক নন। আমার জিনিসগুলি গুছিয়ে দিয়ে মানসাঙ্ক কষে তিনি বললেন, “একশো উনসত্তর।” আমার উদ্দেশে। বৃদ্ধকে বললেন, “ভারত ঠিক পিটিয়ে দেবে। দেখুন না। আর তো গোটা কুড়ি।”

“হ্যাঃ! এই কি একটা বিশ্বকাপ?” বৃদ্ধ বিরক্তি ও তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলেন, “কে টিম দিচ্ছে? না, আরব এমিরেটস্, আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড! দুর দুর! বাপের জন্মে শুনিনি আফগানিরা ক্রিকেট খেলছে! আরে দেশটা যুদ্ধু করবে, মারামারি বোমাবাজি করবে না খেলবে!”

নাতিকে সবলে ক্রোড়ে নিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে সে দাদুর কোল ভিজিয়ে ফেলল। একেবারে ফুটপাথ পর্যন্ত। দাদুর ক্রোধ প্রশমিত করতেই তার এই প্রয়াস কিনা কে জানে! দোকানি বললেন, “আরে! মাঝে তো হিসি পেলে বলা শুরু করেছিল... সে যাই হোক... আয়ারল্যান্ড আগে বিশ্বকাপ খেলেছে কিন্তু। আগের নিয়ম তো আর নেই। আগের বার অ্যাসোসিয়েট কান্ট্রি সদস্য হিসেবে হল্যান্ড খেলল না? এখন হাই র্যাঙ্কাররাও খেলতে পারে।”

“আরে খেললেই হল? একটা আভিজাত্য থাকবে না? এর পর তো দেখতে হবে মায়ানমার, ভুটানও বিশ্বকাপ খেলছে। উগান্ডা, উজবেকিস্তান কেউ বাদ নেই।”

এই উন্নাসিকতার প্রতিবাদ করার জন্য আমার জিভ চুলবুল করছিল। বলে ফেললাম, “আভিজাত্য আবার কী! খেলা সবার জন্য। কোনও দেশ বেশি অভিজাত এমন নয় নাকি? খেলতে খেলতেই খেলার ঐতিহ্য তৈরি হয়। ভারতীয়রাও তো এ খেলা ব্রিটিশদের থেকে নিয়েছে।”

‘ছ ছ ছ ছ-অ-অ-অ-য়!’

বৃদ্ধ বিতর্ক ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমিও স্বপথে পা বাড়ালাম। ছোট শিশুটি হাততালি দিয়ে খলখল করে হেসে উঠল। বুঝলাম, তারও মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে ক্রিকেটীয় উন্মাদনা। আমি কে, এ বিষয়ে উদাসীন থাকব?

কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে ঢোকার আগে দেখলাম ট্রাফিক পুলিশের বুথে ধারাবিবরণী শোনা চলছে। একটা কী হয় কী হয় ভাব! আমিও সেই ভাব নিয়ে একেবারে ক্রেতাবিহীন বাজারে ঢুকতেই মুখচেনা ছেলেটি বলল, “দিদি, জিতে গেছে।” তার মুখে প্রসন্ন হাসি। আমিও হাসলাম। সে বলল, “কী মনে হয়? ভারত ফাইনালে যাবে?”

“নিশ্চয়ই।” আমি বলি, “ভরসা তো রাখতেই হবে।”

“বিরাট কোহলি কি সচিনের জায়গা নেবে?”

“কারও জায়গাই কেউ নেয় না। বিরাট তার মতো। তুমি কার সঙ্গে কার তুলনা করবে? অজিঙ্কা রাহানে, শিখর ধাওয়ান দারুণ ফর্মে আছে। এ বার তো ভারতের বোলিংও বেশ শক্তিশালী! শামি, অশ্বিন!”

নিজের বাক্যে নিজেই চমৎকৃত আমি। সাহিত্যের নিমগ্নতা থেকে এই সব তথ্য কখন আমার মস্তিষ্ক গ্রহণ করে বসে আছে! ছেলেটির সঙ্গী বলল, “এখনও একটা ম্যাচও ভারত হারেনি। মেলবোর্ন এবার ভারতের পক্ষে লাকি। নিউজিল্যান্ডে কী হবে কে জানে!”

“কেন? ধোনি অধিনায়ক হিসেবে এবার অত্যন্ত আত্মস্থ এবং পারদশীর্। লাক ফ্যাক্টর অতিক্রম করে যাবে।”

বললাম ঠিকই, কিন্তু ‘লাক ফ্যাক্টর’ ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলছিল। কিছুতেই একে আমি অস্বীকার করতে পারি না। আমার এক বন্ধু ছিল ক্রিকেটার। ক্লাব পর্যায়ে খেলতে খেলতে আর রাজ্য দলে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ত্রিশ ছুঁয়ে ফেলল। তার প্রতিভা নিয়ে আমাদের কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু, খেলার দুনিয়ায় রাজনীতি চক্র তাকে পিষে ফেলছিল। অবশেষে এক বার সে রাজ্য দলের অন্তর্ভুক্ত হল। সে দারুণ খুশি! আমরাও! অলরাউন্ডার হলেও তার মূল প্রতিভা ছিল বোলিংয়ে। প্রথম খেলা, সম্ভবত গুয়াহাটিতে। যাওয়ার দু’দিন আগে খেলার প্র্যাকটিসে একটি ক্যাচ লুফতে গিয়ে ডান হাতের মধ্যমা ভেঙে বসল সে। খেলতে যাওয়া হল না! রাজ্য খেলার সুযোগ আর তার হয়নি। সে এখন প্রোমোটারি করে। খেলার কথা তুললে এড়িয়ে যায়! লাক! ব্যাড লাক! আর কী বলব একে! ব্যাড লাক ছাড়া! তেমনি, সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে যে দিন ম্যাচ ছিল ভারতের, গুড লাক ছিল ভারতের পক্ষে। এবি ডেভিলিয়ার্সের যে জাদুকরী খেলা এ বার— তিনি রান আউট হয়ে না গেলে ভারত সে দিন জয়ী নাও হতে পারত!

কিন্তু ভাগ্যানুকূল্যর প্রত্যাশা নিয়ে মানুষের বসে থাকলে চলে না। তাকে চেষ্টা করতে হয়। লড়তে হয়। প্রতি দিন কোনও এক বা দুই দলই তার প্রমাণ রাখছে। জবরদস্ত লড়াই দিল পাকিস্তান সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। আজ, এই লেখার ঠিক এক দিন আগে, বৃদ্ধের সঙ্গে আভিজাত্য নিয়ে তর্ক করার পর যখন কেটে গিয়েছে আরও কয়েকটি খেলার দিন, আমি তৃপ্ত, ক্রিকেট জগতে ইতিহাস রচনা করেছে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে! এ যেন বাংলাদেশের নিজস্ব ‘লগন!’ শুধু ‘লাক ফ্যাক্টর’ বলে তাকে খাটো করলে আমার মহাপাপ হবে!

অচিরেই আরও বহু দেশ ক্রিকেট বিশ্বে যোগ দেবে বলে আমার মনে হয়। বর্তমান সভ্যতায় ক্রিকেট একটি সংযোজন। মহাভারতের কালে যদি এ খেলার প্রচলন হত, তিরন্দাজি ছেড়ে অর্জুন হাতে ব্যাট তুলে নিতেন, এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এবং তিনি ক্রিকেটরণের তুঙ্গে উঠে যেতেন আজকের অর্জুন রণতুঙ্গাকে ছাপিয়ে!

যতই উদাসীন থাকার চেষ্টা করি, শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব! গোয়ালা থেকে তেলওয়ালা, কলমবাজ থেকে ছবি আঁকিয়ে— সকলেই এতে মজেছে। শুনছি, জেলের বন্দি অপরাধীরাও খেলা দেখা বা ধারাভাষ্য শোনার সময় পবিত্রচিত্ত! আর যদি তার মধ্যে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠস্বর থাকে, তবে তো কথাই নেই! আর শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে, বাংলার গৌরব, আমাদের সৌরভ— এই প্রসঙ্গ তো উঠবেই।

জয় হোক ভারতের!

—নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tilottoma majumder cricket worldcup 2015
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE