সঠিক সময়ে রোগ ধরা না পড়লে, অন্ধও হয়ে যেতে পারেন রোগী। চিকিৎসা আছে বটে। রোগ চিহ্নিত হলে অধিকাংশ রোগী সুস্থও হয়ে যান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সময় থাকতে থাকতে রোগ ধরা পড়াটাই সবচেয়ে জরুরি। কেরাটোকোনাস নামে চোখের এই রোগের চিকিৎসায় সেই কাজটাই করে দিচ্ছে কৃত্রিম মেধা (এআই)। তা-ও আবার প্রথম দেখাতেই! যা করতে একজন চোখের ডাক্তারের এক-দু’বছরও লেগে যেতে পারে।
মানুষের কর্নিয়ার আকার প্রায় গোলাকার। সেটি শঙ্কু আকৃতির হয়ে গেলে চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, কেরাটোকোনাস হয়েছে। এটি এক ধরনের ‘এক্ট্যাটিক কর্নিয়াল ডিজ়িজ়’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অসুখের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এই অসুখ ধরা পড়ে সাধারণত কিশোর বয়সে। কেরাটোকোনাস মূলত জিনগত কারণে হয়ে থাকে। তবে অন্য কারণও থাকতে পারে। যেমন, চোখ বার বার ঘষা।
কেরাটোকোনাস প্রাথমিক বা সাব-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে ধরা পড়লে, রোগীদের চশমা সফ্ট লেন্স দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে ধরা না পড়লে, সমস্যা দ্রুত বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে কর্নিয়া ট্রান্সপ্ল্যান্টও জরুরি হয়ে পড়ে কখনও কখনও। সমস্যাটা এখানেই। অধিকাংশ সময়েই চিকিৎসকেরা বুঝে উঠতে পারেন না, কোন রোগীর দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। সে কারণে তাঁরা ঘন ঘন রোগীদের দেখেন। কর্নিয়ার আকৃতি বদলাচ্ছে কি না, তা নজরে রাখেন। কিন্তু যত ক্ষণে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, রোগের মাত্রা বাড়ছে, তত ক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়।
লন্ডনের ‘মুরফিল্ডস আই হসপিটাল এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ এবং ‘ইউনির্ভাসিটি কলেজ লন্ডন’-এর চিকিৎসক শফি বালাল ও তাঁর দল একটি এআই মডেল তৈরি করেছেন। এই এআই মডেলই বলে দিচ্ছে, কোন কেরাটোকোনাস রোগীর অবস্থা বিপজ্জনক! দ্রুত চিকিৎসা না হলে কোন রোগী অন্ধও হয়ে যেতে পারেন!
শফি জানান, কেরাটোকোনাসের মাত্রা যাতে দ্রুত বাড়তে না পারে, তার জন্য ‘কোলাজেন ক্রসলিঙ্কিং’ করা হয়ে থাকে অনেক সময়। এই চিকিৎসায় অতিবেগনি রশ্মি দিয়ে কর্নিয়ার কিছু অংশ রিজিড (দৃঢ়) করে দেওয়া হয়। ফলে কেরাটোকোনাস আর বা়ড়তে পারে না। কিন্তু কোন রোগীর ক্রসলিঙ্কিং দ্রুত প্রয়োজন, তা বুঝতে চিকিৎসকদের বেগ পেতে হয় বলেই নয়া এআই মডেল ভবিষ্যতে কাজে আসতে পারে বলেই মনে করছেন শফি।
আরও পড়ুন:
গবেষকেরা জানান, বিভিন্ন রোগীর চোখের ছবি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে এই মডেল তৈরি করা হয়েছে। সেই সব তথ্য বিচার করে কৃত্রিম মেধা জানিয়ে দিচ্ছে কোন রোগীর চোখের অবস্থা কী রকম। মুরফিল্ডসে চোখ দেখাতে যাওয়া ৬,৬৮৪ জন রোগীর উপর এই পরীক্ষা চালিয়েছেন চিকিৎসকেরা। চোখের মোট ৩৬,৬৭৩টি ছবি পরীক্ষা করেছে এআই। তার ভিত্তিতে এআই রোগীদের দু’টি ভাগে ভাগ করেছে। দেখা গিয়েছে, দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর অবস্থা কম ঝুঁকিপূর্ণ। আর এক-তৃতীয়াংশ রোগীকে ফেলা হয়েছে বেশি ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায়। এ ক্ষেত্রে কম ঝুঁকিপূর্ণ মানে যাঁদের এই মুহূর্তে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তাঁরা, যাঁদের দ্রুত ক্রসলিঙ্কিং প্রয়োজন।
শফি বলেন, ‘‘এই রোগের চিকিৎসায় ডাক্তারেরা নিয়মিত রোগীদের দেখতে যান। চোখ পরীক্ষা করে তাঁরা বুঝতে চান, চশমা বা কনট্যাক্ট লেন্স দিয়ে কাজ হবে না কি ক্রসলিঙ্কিং প্রয়োজন। কিন্তু এটা বুঝতে বুঝতে ডাক্তারদের ২-৩ বছর লেগে যেতে পারে। এই সময়টা কমিয়ে আনতে এই এআই মডেল ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।’’ চিকিৎসকের সংযোজন, ‘‘গবেষণায় যা ফল মিলল, তাতে কোন রোগীর দ্রুত চিকিৎসায় বেশি জোর দেওয়া উচিত, তা বোঝা যাচ্ছে। যাঁদের অবস্থা কম ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁদের ঘন ঘন ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই। এতে রোগী এবং ডাক্তার দু’জনেরই সুবিধা হবে।’’
বার্সেলোনার চক্ষুবিশেষজ্ঞ হোসে লুইস গুয়েল এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে এই রিপোর্টটি পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘এআই যদি এ ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ রোগ বেছে দিতে পারে, আমাদের সুবিধাই হবে। অযথা রোগীদের বার বার ডাকার কোনও মানে হয় না। বরং, যাঁদের দ্রুত চিকিৎসা দরকার, তাঁদের দিকে বেশি নজর দেওয়া যাবে।’’