গ্রিসের মানুষ ওদের নাম দিয়েছিল ‘প্লানেত’। অর্থাৎ পরিব্রাজক। সেই অন্তর্নিহিত অর্থকেই যেন সত্যি প্রমাণিত করে দিয়েছে পৃথিবী থেকে ২৪০ আলোকবর্ষ দূরের এক দানব গ্রহ। মহাজাগতিক অসঙ্গতির নজির তৈরি করে নিজের আয়তনের তুলনায় আনুপাতিক হিসেবে ক্ষুদ্র এক নক্ষত্রের কক্ষপথে নিরন্তর ঘুরে চলেছে সে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, ছোট নক্ষত্রের কক্ষপথে বিশাল গ্রহের প্রদক্ষিণের ঘটনা খুবই বিরল। তারই নবতম উদাহরণ এই ‘এক্সোপ্ল্যানেট’ (সৌরজগতের বাইরের সমস্ত গ্রহকে এই গোত্রে ফেলা হয়)। আকারে তা আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনির সমান। কিন্তু পৃথিবীর মতো কঠিন নয় মোটেই। আদতে জমাট ধূলিকণা এবং ঘনীভূত গ্যাসের পিণ্ড। অন্য দিকে, যে নক্ষত্রটিকে সে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, সেই টিওয়াই-৬৮৯৪-এর ভর সূর্যের মাত্র এক পঞ্চমাংশ! আয়তনে আমাদের সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির তুলনায় সামান্য বড়। অন্য দিকে, সূর্যের আয়তন বৃহস্পতির ১০ গুণের চেয়েও বেশি!
সাধারণ ভাবে এমন আয়তনের নক্ষত্রের উপগ্রহের আকার সৌরজগতের বুধ বা মঙ্গলের মতো হওয়া উচিত। কিন্তু মহাকর্ষজ বলের সাধারণ উদাহরণকে ভুল প্রমাণিত করেছে টিওয়াই-৬৮৯৪। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ‘ট্রানজিটিং এক্সোপ্ল্যানেট সার্ভে স্যাটেলাইট’ (টেস)-এর সন্ধানে ‘সিংহ ছায়াপথে’ মেলা এই নক্ষত্রটি মহাকাশবিজ্ঞানের ভাষায় ‘লাল বামন’। অর্থাৎ জ্বালানি ফুরিয়ে আসা নক্ষত্র। বস্তুত, এ যাবৎ কাল পর্যন্ত কোনও নক্ষত্র এবং তাকে প্রদক্ষিণ করা গ্রহের মধ্যে ভর ও আয়তনের এত সামান্য পার্থক্য খুঁজে পাননি মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন:
কিন্তু এত ছোট নক্ষত্র কী ভাবে বিশাল এক গ্রহকে মহাকর্ষীয় বলের মাধ্যমে ধরে রাখতে পারে? নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে বুধবার প্রকাশিত গবেষণপত্রে প্রধান লেখক ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ব্রায়ান্ট এবং তাঁর সহকারী ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের মুলার্ড স্পেস সায়েন্স ল্যাবরেটরির এক্সোপ্ল্যানেট বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট ভ্যান আইলেন তারই সদুত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ব্রায়ান্ট বলেছেন, আমরা এখনও সন্দেহাতীত ভাবে এ ক্ষেত্রে কোনও ‘কারণ চিহ্নিত করতে পারিনি।’’ তবে তাঁর মতে, সম্ভবত নক্ষত্রজগতের উৎপত্তি এবং গ্রহের অবস্থানের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্য।
কী সেই ‘রহস্য’? ব্রায়ান্ট জানিয়েছেন, নক্ষত্রজগতের জন্মের সূচনা হয় গ্যাস এবং ধুলোর একটি বৃহৎ মেঘ দিয়ে। যাকে আণবিক মেঘ বলা হয়। যা তার নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ভেঙে প্রথমে একটি কেন্দ্রীয় নক্ষত্র তৈরি করে। যাকে বলে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক। অবশিষ্ট উপাদানগুলি গ্রহ, গ্রহাণুপঞ্জ, উপগ্রহ ইত্যাদি তৈরি করে। স্বাভাবিক ভাবেই ছোট আণবিক মেঘগুলি ছোট নক্ষত্র তৈরি করে এবং ছোট প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কগুলিতে গ্রহ তৈরির জন্য কম উপাদান থাকে।
তিনি বলেন, ‘‘বিশাল গ্রহ তৈরি করতে, দ্রুত একটি বৃহৎ গ্রহকেন্দ্র তৈরি করতে হবে এবং তার পরে দ্রুত সেই কেন্দ্রের উপরে প্রচুর গ্যাস জমা করতে হবে। কিন্তু নক্ষত্রটি জ্বলতে শুরু করার আগে এবং প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে এই প্রক্রিয়ার জন্য খুব বেশি সময় থাকে না।’’ সাধারণ ভাবে ছোট নক্ষত্রগুলির ক্ষেত্রে, ডিস্কটি অদৃশ্য হওয়ার আগে দ্রুত ঘূর্ণায়মান কণাগুলি একটি বিশাল গ্রহ তৈরি করার জন্য পর্যাপ্ত ভর সংযোজিত করতে পারে না। কিন্তু পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব, ‘লাল বামনে’র থেকে এই বিশাল গ্রহ রয়েছে তার ৪০ ভাগের এক ভাগ দূরত্বে। সেটি তিন দিনে প্রদক্ষিণ করে সূর্যের চেয়ে অনেক হালকা টিওয়াই-৬৮৯৪-কে। এই অবস্থানজনিত সুবিধার কারণে ক্ষুদ্রতম নক্ষত্রটি মহাকাশের অন্যতম বৃহৎ গ্রহ গঠনে সহায়ক হয়েছে বলে দুই বিজ্ঞানীর অনুমান।