Advertisement
E-Paper

রোগীর শরীরে ঢুকে এ বার অপারেশন চালাবে ব্যাকটেরিয়াই!

আমার-আপনার শরীরে ঢুকে পড়ে এ বার অপারেশন, সার্জারি করবে ‘ব্যাকটেরিয়া’! শরীরের ভেতর যে সব জায়গায় সরাসরি ওষুধ পৌঁছে দিলে দ্রুত আরোগ্য হয়, এ বার সেই সব ঠিকানায় ‘পোস্টম্যান’-এরও কাজ করবে ওই ‘ব্যাকটেরিয়া’! ওষুধ পৌঁছে দেবে দ্রুত। করে দেবে অনেক জটিল অস্ত্রোপচার। ধমনীগুলোর মধ্যে জট পাকিয়ে গেলে তা খুলে দিয়ে রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক করে তুলবে।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ১৬:১৬
কোষে গিয়ে অপারেশন চালাচ্ছে মাইক্রো-রোবট (সবুজ ক্যাপস্যুলের মতো)।

কোষে গিয়ে অপারেশন চালাচ্ছে মাইক্রো-রোবট (সবুজ ক্যাপস্যুলের মতো)।

আমার-আপনার শরীরে ঢুকে পড়ে এ বার অপারেশন, সার্জারি করবে ‘ব্যাকটেরিয়া’! শরীরের ভেতর যে সব জায়গায় সরাসরি ওষুধ পৌঁছে দিলে দ্রুত আরোগ্য হয়, এ বার সেই সব ঠিকানায় ‘পোস্টম্যান’-এরও কাজ করবে ওই ‘ব্যাকটেরিয়া’! ওষুধ পৌঁছে দেবে দ্রুত। করে দেবে অনেক জটিল অস্ত্রোপচার। ধমনীগুলোর মধ্যে জট পাকিয়ে গেলে তা খুলে দিয়ে রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক করে তুলবে।

যাদের জন্য দুশ্চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না আমরা, তারাই কি না হতে চলেছে আমাদের প্রাণ বাঁচানোর সার্জেন!

নরমসরম এই ‘সার্জেন’দের খুব সহজেই দোমড়ানো-মোচড়ানো যায়। আর তাদের চালাতে কোনও যন্ত্রেরও দরকার হয় না। ফলে, শরীরে ঢুকে সেই ‘সার্জেন’ যখন অসম্ভব দ্রুত গতিতে কোষ, কলাগুলোর কাটাছেঁড়া করবে, জুড়বে, বাদ দেবে, তখন তার শরীরের ভেতরে কোনও যন্ত্র না থাকায়, তাতে কোনও গলদের সম্ভাবনা থাকবে না। আর সেই গলদের জন্য কোনও বিপত্তি ঘটারও আশঙ্কা থাকবে না সার্জারিতে। যাদের ছাড়া ‘অপারেশন থিয়েটার’ চলে না, সেই ছুরি, কাঁচি, ফরসেপ, ট্রে’র কোনও দরকারই হবে না এই যন্ত্রহীন কিন্তু অসম্ভব রকমের যান্ত্রিক এই ‘সার্জেন’দের ‘থিয়েটার’-এ!

এই ‘স্মার্ট সার্জেন’দের আবিষ্কার করেছে সুইৎজারল্যান্ডের ‘ইকোলে পলিটেকনিক ফেডেরাল দে লসাঁ’র রোবোটিক সার্জারি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদার্থবিজ্ঞানী সেলমান সাকার ও নেদারল্যান্ডসের ‘ইউনিভার্সিটি অফ তোয়েন্তে’র পদার্থবিদ্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সার্থক মিশ্র সহ একটি গবেষক দল। তাঁদের গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-কমিউনিকেশন্স’-এর জুলাই সংখ্যায়। যার শিরোনাম- ‘সফ্‌ট মাইক্রোমেশিনস্‌ উইথ প্রোগ্রামেব্‌ল মোটিলিটি অ্যান্ড মরফোলজি’।

কেমন দেখতে হবে ওই ‘স্মার্ট সার্জেন’রা? শরীরের ভেতরে ঢুকে কী ভাবে চালাবে তারা ‘অপারেশন’?


না, এরা ব্যাকটেরিয়া নয়। এরাই মাইক্রো-রোবট!

অন্যতম প্রধান গবেষক বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সার্থক মিশ্র জানিয়েছেন, খুব সহজেই দোমড়ানো-মোচড়ানো যায়, অত্যন্ত নরম আর আদ্যন্ত যন্ত্রবিহীন এই ‘সার্জেন’রা আসলে মাইক্রো-রোবট। যাদের বানানো হয়েছে হাইড্রোজেল আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চৌম্বক (ম্যাগনেটিক) ন্যানো-পার্টিকল’ দিয়ে। এই ন্যানো-পার্টিকলগুলির কাজ হবে দু’রকম। ‘সার্জেন’ মানে মাইক্রো-রোবটদের চেহারা কেমন হবে, তা ঠিক করে দেবে এই ন্যানো-পার্টিকলরাই। যেহেতু ন্যানো-পার্টিকলদের চৌম্বক ধর্ম রয়েছে, তাই বাইরে থেকে তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র (ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড) প্রয়োগ করা হলে, তার টানেই এই ন্যানো-পার্টিকলরা নড়াচড়া করে। জলের মতো হাইড্রোজেলেরও কোনও নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি না থাকায়, তার ভেতরে থাকা ন্যানো-পার্টিকলগুলো ত়ড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের টানে যে ভাবে নড়াচড়া করবে, তার ওপরেই নির্ভর করবে মাইক্রো-রোবটের চেহারাটা কেমন হবে। তা কী ভাবে, কোন দিকে এগোবে। এমনকী, শরীরের ভেতরে প্রয়োজনে কী ভাবে তারা সাঁতারও কাটতে পারবে।’’


এই সেই মাইক্রো-রোবট। যেন ব্যাকটেরিয়াই!

কী ভাবে বানানো হয়েছে ব্যাকটেরিয়ার মতো চেহারার এই ‘সার্জেন’ মাইক্রো-রোবটদের?

গবেষণাপত্রে প্রধান গবেষক সেলমান সাকার লিখেছেন, ‘‘ওই ম্যাগনেটিক ন্যানো-পার্টিকলগুলিকে প্রথমে বসানো হয় অনেকটা জলের মতো পদার্থ হাইড্রোজেলের মধ্যে। তার পর বাইরে থেকে প্রয়োগ করা হয় তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র। যাতে হাইড্রোজেলের মধ্যে থেকেই ন্যানো-পার্টিকলগুলি তার বিভিন্ন অংশে ঘোরাফেরা করতে পারে। ওই তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের টানে। এর পর হাইড্রোজেলটাকে আর আগের মতো নমনীয় রাখা হবে না। তাকে ধীরে ধীরে ‘কঠিন’ করে তোলা হবে। সেটিকে বসিয়ে দেওয়া হবে জলের মধ্যে। তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের টানে ভেতরে থাকা ন্যানো-পার্টিকলগুলো যে ভাবে, যে দিকে নড়াচড়া করবে, জলে ভেসে থাকা হাইড্রোজেলটাও (মাইক্রো-রোবট) সে ভাবেই সে দিকে হেলে যাবে বা এগোবে অথবা সাঁতার কাটতে থাকবে। তার পরের ধাপে শরীরের ভেতর ওই মাইক্রো-রোবটের গতি বাড়াতে বাইরে থেকে প্রয়োগ করা ত়ড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি আরও বাড়ানো হবে। যাতে শরীরের ভেতর মাইক্রো-রোবটটি আরও দ্রুত ও অনায়াসে সাঁতার কাটতে পারে। পৌঁছে যেতে পারে শরীরের ভেতর তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। যেখানে সরাসরি ওষুধ প্রয়োগ করতে চাইছেন ডাক্তাররা। বা চাইছেন অস্ত্রোপচার করতে।’’

মাইক্রো-রোবটের সেই হাইড্রোজেল অংশটি।

আরও পড়ুন- আগামী সপ্তাহে আকাশে তাকান! ১৮ বছর পর মিলবে উল্কাবৃষ্টির দেখা

কী ভাবে এই মাইক্রো-রোবট বানানোর ভাবনাটা মাথায় এল তাঁদের?

সার্থকের কথায়, ‘‘আমরা ব্যাকটেরিয়াদের দেখেই শিখেছি। বিশেষ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ঠিক এই ভাবেই কাজ করে আমাদের দেহে। এই ব্যাকটেরিয়াদের জন্যই আমাদের একটি রোগ হয়। যার নাম- ‘আফ্রিকান ট্রাইপ্যানোসোমিয়াসিস’। যার অন্য নাম- ‘স্লিপিং সিকনেস’। এই ব্যাকটেরিয়ারা যখন আমাদের রক্তের মধ্যে চলাচল করে, তখন তারা তাদের ক্ষণপদ বা ফ্ল্যাজেলামকে এমন ভাবে গুটিয়ে রাখে, যাতে শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা তার হাল-হদিশ না জানতে পারে। কিন্তু যেখানে গিয়ে সে হানাদারি চালাবে, সেই কোষ, কলার মুলুকে পৌঁছেই ওই গুটিয়ে রাখা ক্ষণপদটাকে বের করেই কোষ, কলার যা ক্ষতি করার করে দেয় ওই ব্যাকটেরিয়া। আমরা ওই ব্যাকটেরিয়ার মতোই বানিয়েছি এই মাইক্রো-রোবটটিকে। ভেতরের ন্যানো-পার্টিকলগুলোর নড়াচড়া হাইড্রোজেলটাকে কী চেহারা দেবে, তা বোঝা যাবে যখন তার গন্তব্যে পৌঁছে মাইক্রো-রোবট ওষুধটা দিচ্ছে বা অস্ত্রোপচার করছে, তখনই।’’

তবে এই ধরনের ‘অপারেশন’-এর কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না, থাকলে সেগুলো কী কী, গবেষকরা জানাচ্ছেন, সে সবই এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক সার্থক মিশ্র, তোয়েন্তে বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস।

Bacteria Operation Micro-Robot Surgery
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy