এই গবেষণার কৃতিত্ব, তা মহাকাশবিজ্ঞানের চালু মডেলকে একটি মস্ত বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে। কারণ, সেই মডেল এত দিন ধরে যে বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই গভীর বিশ্বাসের মর্মমূলেই সরাসরি আঘাত হেনেছেন সুবীর ও তাঁর সহযোগীরা।
চালু মডেলগুলির বিশ্বাসের ভিত্তিটা আদতে কী?
প্রথম বিশ্বাসটা হল, গোটা ব্রহ্মাণ্ডই ‘হোমোজিনিয়াস’। সমসত্ব। বালতির দুধে জল মেশালে যেমন হয়। বালতির যেখান থেকেই দুধ তুলবেন, সেখানেই দুধ আর জলের মিশেল দেখবেন একই রকম। তেমনই একই রকম ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র। একই ভাবে গড়ে উঠেছে। এলাকাভেদে তার যাবতীয় ‘সম্পদে’র ভাগ-বাঁটোয়ারায় কোনও বৈষম্য নেই। কেউ বলতে পারবেন না ব্রহ্মাণ্ড ‘একচক্ষু’!
তেমনই একই মানের ত্বরণে সব অভিমুখে এই ব্রহ্মাণ্ডকে ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে তুলছে যে, সেই অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জিও সর্বত্রই সমান। সেটা কোথাও একটু কম বা কোথাও একটু বেশি নয়। তার চরিত্র বা আচার, আচরণেও কোনও ফারাক নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বাসটা হল, আমাদের এই পরিচিত ব্রহ্মাণ্ডের পক্ষপাতও নেই কোনও দিকে। না ডান, না বাম। এমনকী, তার একটু বেশি পছন্দ ঈশান বা অন্য কোনও কোণ, তা-ও বলা যাবে না। যাকে ‘কসমোলজি’ বা মহাকাশবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘আইসোট্রপিক’।
কোনও একটি বস্তুকে উত্তর-দক্ষিণে কোণাকুণি ভাবে রাখলে তার যা ধর্ম হয়, তাকে পূর্ব-পশ্চিমে কোণাকুণি ভাবে রাখলেও যদি সেই একই ধর্ম দেখা যায়, তা হলে সেটাকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘আইসোট্রপিক’।
যেহেতু ডার্ক এনার্জিই সব দিকে ব্রহ্মাণ্ডকে সমান ভাবে উত্তরোত্তর আরও আরও বেশি গতিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চলেছে বলে ধরে নেওয়া হয় মহাকাশবিজ্ঞানের সবক’টি চালু মডেলেই, তাই এই অদৃশ্য শক্তিকেও ধরে নেওয়া হয় ব্রহ্মাণ্ডের মতোই হোমোজিনিয়াস ও আইসোট্রপিক। সমসত্ব ও দিক-নিরপেক্ষ।
ফুলে-ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়েছে গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সির ঝাঁক ও মহাঝাঁক, কোটি কোটি তারা ও নক্ষত্রমণ্ডল।
ডার্ক এনার্জি বলে কিছু নেই তা হলে...?
এই গবেষকরাই প্রথম মহাকাশবিজ্ঞানের সবক’টি চালু মডেলের বিশ্বাসের এই ভিতদু’টিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখালেন। পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া অভিনব তথ্যাদিকে বিশ্লেষণ করে।
সুবীরের বক্তব্য, ডার্ক এনার্জিকে যেহেতু সমসত্ব ও দিক-নিরপেক্ষ বলে ধরা হয়, তাই ব্রহ্মাণ্ডের একটি বিশাল অংশের কোনও একটি বিশেষ অভিমুখে এই ভাবে উত্তরোত্তর বেশি গতিতে ফুলে, ফেঁপে ওঠার পিছনে অন্তত ডার্ক এনার্জির কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।
কীসের ভিত্তিতে এটা বলছেন সুবীর?
তাঁরা মোট ৭৪০টি সুপারনোভা দেখেছেন। সুপারনোভা হল কোনও নক্ষত্রের মৃত্যুদৃশ্য। যখন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কোনও নক্ষত্র ফেটে যায়। তার ফলে, যে আলোটা বেরিয়ে আসে, সেটাই বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা।
সুপারনোভা হলে এই ব্রহ্মাণ্ডে তা দেখতে লাগে আলোর একটা বাল্বের মতো। সুবীরের দেখা সুপারনোভাগুলির আলো যেন কোনও বিশেষ একটি দিকেই উত্তরোত্তর বেশি গতিতে দূরে চলে যাচ্ছে। খুব অল্প ব্যাসের একটা এলাকায় এই পর্যবেক্ষণ হলে বলা যেত, এটা আপেক্ষিক ঘটনা। কিন্তু সুবীর আকাশের বিশাল একটা এলাকার উপর করা পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এটা ঘটতে দেখেছেন।
বিগ ব্যাংয়ের পর বেরিয়ে আসা বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। সেটাই ব্রহ্মাণ্ডের ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি)’। হঠাৎ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে টেলিভিশনের স্ক্রিনে যে ঝিরঝিরে ছবিটা ভেসে আসে।
আরও পড়ুন- মহাবিশ্বের ভাগ্যে কী আছে?
আরও পড়ুন- ‘ঈশ্বরের মন’ পড়তে পেরেছিলেন আইনস্টাইন!
সুবীর বলছেন, ‘‘এই সিএমবি-রও একদেশদর্শিতা রয়েছে! সিএমবি-ও দিক-নিরপেক্ষ নয়।’’ এটাই গবেষকদের কথায়, ‘ডাইপোল অ্যানাইসোট্রপি’।
গবেষকদের দাবি অভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার জন্য আরও অনেক তথ্যের প্রয়োজন, এটা স্বীকার করে নিয়েছেন সুবীর। তবে এও বলেছেন, ‘‘এই তথ্যের অপ্রতুলতা ছিল নোবেলজয়ীদের ক্ষেত্রেও। তাঁরা খুব বেশি হলে ৯০টি সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আর সেটাও করেছিলেন আকাশের একটি দিকেই। ঘটনাচক্রে, সেই অভিমুখেই ব্রহ্মাণ্ডের ত্বরণটা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। নোবেলজয়ীদের হাতে যদি আরও তথ্য থাকত, তাঁরা যদি গোটা আকাশ পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেতেন, তা হলে সম্ভবত ওঁরা বুঝতে পারতেন আকাশের সর্বত্র ত্বরণটা সমান ভাবে হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে হয়তো তাঁরা এই ত্বরণের দায়টা ডার্ক এনার্জির কাঁধেও চাপিয়ে দিতেন না।’’
খুবই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা: নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার কলকাতা)’-এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এটা সত্যি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। এর আগে এই দিক থেকে বিষয়টিকে দেখা হয়নি। এ বার ভেবে দেখতে হবে। এটা ঠিকই, কণাপদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় যতটা তথ্যাদি বা ডেটা পাওয়া যায় বিশ্লেষণের জন্য, মহাকাশবিজ্ঞানে ততটা তথ্যাদি মেলে না, যথেষ্ট পর্যবেক্ষণের অভাবে। তাই এই গবেষণার দাবিকে অভ্রান্ত হয়ে উঠতে গেলে আরও তথ্যাদির প্রয়োজন। তা সুবীরও স্বীকার করেছেন। তবে ওঁদের দাবি সত্য প্রমাণিত হলে ডার্ক এনার্জিকে নিয়ে আর অকূলপাথার ভাবতে হবে না পদার্থবিজ্ঞানীদের।’’
নোবেলজয়ী গবেষণা নিয়ে তো প্রশ্নটা উঠল অন্তত: অমিতাভ রায়চৌধুরী
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ‘পালিত অধ্যাপক’ কণাপদার্থবিজ্ঞানী অমিতাভ রায়চৌধুরীরও একই বক্তব্য। তাঁর কথায়, ‘‘ব্রহ্মাণ্ড আর অদৃশ্য শক্তি, দু’টিই সমসত্ত্ব এবং দিক-নিরপেক্ষ, গত আড়াই দশক ধরে এই ধারণাটাই বিজ্ঞানী মহলে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই নোবেলজয়ীরা এই ধারণায় পৌঁছেছিলেন বলে কেউ আর অন্য ভাবে ভাবা যায় বলে দাবি করেননি। সুবীরদের কৃতিত্ব, তিনি সেটা করতে পেরেছেন। এমনকী, এই প্রশ্নটাও তুলে দিতে পেরেছেন, সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য কি পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ আর তার থেকে পাওয়া তথ্যাদি যথেষ্ট ছিল নোবেলজয়ীদের হাতে?’’
আরও পড়ুন- প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ব্রহ্মাণ্ডে, তৈরি হল ১০০ কোটি সৌরমণ্ডলের আকারের গর্ত!
আরও পড়ুন- বিগ ব্যাংয়ের পর ৬০০ লক্ষ কোটি সূর্যের ঝলসানি দেখল নাসা
অমিতাভের বক্তব্য, জেনিভায় ‘সার্ন’-এ হিগস বোসন কণা আবিষ্কারের ঘটনার কথা এই সূত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই সময় ‘সার্ন’-এর দু’টি গবেষণাগার ‘সিএমএস’ এবং ‘অ্যাটলাস’-এর দুই গবেষকদল একেবারে স্বাধীন ভাবে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় না করেও। এ ক্ষেত্রেও তেমন একটি ঘটনা ঘটতে হবে। একেবারে নিরপেক্ষ ভাবে আরও বেশি পর্যবেক্ষণ ও সেখান থেকে পাওয়া আরও বেশি তথ্যাদি নিয়ে অন্য একদল বিজ্ঞানীর এ বার সুবীরদের বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত হতে হবে। তা হলেই আক্ষরিক অর্থে, জমি পেয়ে যাবে সুবীর ও তাঁর সহযোগীদের বক্তব্য।