Advertisement
E-Paper

গ্যালাক্সি থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ব্ল্যাক হোল

সেই মুলুকে আইন থাকলেও, কোনও আদালত নেই! তাই রীতিমতো ঘাড় ধাক্কা খেয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডে তার ঘর-বাড়ি, তার গ্যালাক্সি ছেড়েছুড়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে! ভিটেছাড়া হয়ে সব খুইয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন হয়ে এখন সে দিশেহারা অবস্থায় ছুটে বেড়াচ্ছে। কল্পনাতীত- ঘণ্টায় ৫০ লক্ষ মাইল গতিবেগে।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৭ ১০:০০
ঘাড় ধাক্কা খাওয়া সেই ব্ল্যাক হোল।

ঘাড় ধাক্কা খাওয়া সেই ব্ল্যাক হোল।

সেই মুলুকে আইন থাকলেও, কোনও আদালত নেই! তাই রীতিমতো ঘাড় ধাক্কা খেয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডে তার ঘর-বাড়ি, তার গ্যালাক্সি ছেড়েছুড়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে! ভিটেছাড়া হয়ে সব খুইয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন হয়ে এখন সে দিশেহারা অবস্থায় ছুটে বেড়াচ্ছে। কল্পনাতীত- ঘণ্টায় ৫০ লক্ষ মাইল গতিবেগে।

এই অন্যায়ের বিচার করবে কে?

যার কথা বলছি, সে আদতে একটি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। প্রত্যেকটা গ্যালাক্সিরই একেবারে কেন্দ্রস্থলে যেমন থাকে খুব ভারী, রাক্ষুসে চেহারার (মনস্টার) সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল, এই বেচারারও তেমনই ভিটে ছিল খুব দূরের একটা গ্যালাক্সিতে। পৃথিবী থেকে প্রায় ৮০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। অত দূরে যখন, কেই-বা জানতে পারতো সেই হতভাগ্য রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের কথা, যদি না হালে তার এই দিশেহারা গতিবিধি ধরা পড়তো হাবল স্পেস টেলিস্কোপের নজরে।


যে ভাবে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে হয়েছে ব্ল্যাক হোলটিকে (কালো বৃত্তাকার)

মূল গবেষক, স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্কো শিয়াবার্জের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল ব্রহ্মাণ্ডে এই প্রথম এমন হতভাগ্য রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের হদিশ দিতে পারল। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ৩০ মার্চ, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এ। যে গবেষকদলের অন্যতম সদস্য এক জন বাঙালি। মেরিল্যান্ডের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়।

হাবলে কী ভাবে ধরা পড়েছে সেই ভিটেছাড়া’ ব্ল্যাক হোল: দেখুন ভিডিও

এই রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলটাকে ভিটেছাড়া হতে হয়েছে কেন? তা কী ভাবেই বা হল?

মেরিল্যান্ডের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা চমকে গিয়েছিলাম। এমন হতে পারে বলে আমাদের কোনও ধারণাই ছিল না। আমরা দেখেছি, ১০০ কোটি সূর্যের যতটা ভর হয়, প্রায় ততটাই ভারী ওই কোয়াসারটি (যা আদতে একটি কৃষ্ণগহ্বর) তার গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে। আর সেই দূরত্বটা খুব কম কিছু নয়। গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে সরে গিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আর তা ছুটছে ঘণ্টায় ৫০ লক্ষ মাইল গতিবেগে। এই বেগে ছুটলে ২ কোটি বছর পর ওই ‘3C-186’ নামের কোয়াসারটি গ্যালাক্সি থেকে পুরোপুরি উৎখাত হয়ে যাবে। তখন সে দিশেহারা হয়ে ছুটবে ব্রহ্মাণ্ডের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। ভাগ্য ভালই বলতে হবে, যেহেতু সেই ব্ল্যাক হোলটি পৃথিবী থেকে রয়েছে অনেক অনেক দূরে। এত দিন গ্যালাক্সি থেকে ভিটেছাড়া হয়ে যাওয়া ব্ল্যাক হোলও থাকতে পারে বলে খুব ভাসা ভাসা অনুমান ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। কিন্তু আগে কখনও এমন ‘বাস্তুচ্যুত’ ব্ল্যাক হোলের হদিশ পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, এত ভারী সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল, যাকে তাঁর ভিটে থেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে হয়েছে, এমন কিছুর সন্ধানও এর আগে মেলেনি।


(বাঁ দিক থেকে) প্রথম ছবি- দু’টি ব্ল্যাক হোল কাছাকাছি আসছে, দ্বিতীয় ছবি- আরও কাছে আসতেই তৈরি হচ্ছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, তৃতীয় ছবি- সংঘর্ষের পর জন্ম হল জোরালো তরঙ্গের, শেষ ছবি- কেন্দ্র থেকে ছিটকে দিল ব্ল্যাক হোলটিকে (তিরচিহ্নিত দিকে)

অত ভারী ব্ল্যাক হোলকে ঘাড় ধাক্কা দিয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্ম হল কী ভাবে? আমাদের অনুমান, ওই গ্যালাক্সিটি রয়েছে যে গ্যালাক্সি ক্লাস্টারে (গ্যালাক্সির ঝাঁকে), সেখানে তার আশপাশের আরও দু’টি গ্যালাক্সি এসে সজোরে ধাক্কা মেরেছে ওই গ্যালাক্সিটিকে। আমরা জানি, প্রত্যেকটি গ্যালাক্সিরই কেন্দ্রস্থলে থাকে একটি করে সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। ওই ধাক্কায় দুই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলিও একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ধুন্ধুমার সংঘর্ষে। তার ফলে জন্ম হয় অসম্ভব শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গের। একটা পুকুরের মাঝখানে খুব বড় একটা ঢিল বা পাথর ফেললে যেমন জলের ঢেউ ওঠে আর তা সেখানে থাকা যে কোনও বস্তুকেই ছিটকে দূরে পুকুরের পাড়ের দিকে সরিয়ে দেয়, ঠিক তেমন ভাবেই ওই অসম্ভব জোরালো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধাক্কা মেরে ওই সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটিকে তার ‘জন্মভিটে’ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আর পুকুরে বড় পাথর ফেললে যেমন তার তরঙ্গ উত্তরোত্তর ছড়িয়ে পড়তে থাকে পাড়ের দিকে, তেমনই ওই অসম্ভব শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গটিও ওই বাস্তুচ্যুত ব্ল্যাক হোলটিকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে গ্যালাক্সির পাঁচিলের দিকে। শুধুই হাবল স্পেস টেলিস্কোপ নয়, চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি ও স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভের মাধ্যমেও এক্স-রে, আল্ট্রা-ভায়োলেট ও নিয়ার-ইনফ্রারেড বর্ণালী পরীক্ষা করে আমরা এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে পেরেছি।’’

আরও পড়ুন- পৃথিবীর ২৫ হাজার গুণ বড় গ্রহের সন্ধান দিলেন বাঙালি বিজ্ঞানীরা

কতটা দিশেহারা হয়ে ছুটছে ওই ‘ভিটেছাড়া’ হওয়া ব্ল্যাক হোলটি?

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে মূল গবেষক, স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্কো শিয়াবার্জ ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘কল্পনার অতীত গতিবেগে ছুটে বেড়াচ্ছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে ঘাড় ধাক্কা খাওয়া (‘বুটেড আউট’) ওই ব্ল্যাক হোলটি। ঘণ্টায় ৫০ লক্ষ মাইল গতিবেগে। যে গতিতে ছুটলে পৃথিবী থেকে তিন মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যাবে চাঁদে। আর ওই গতিতে ছুটলে ২ কোটি বছর পর ওই গ্যালাক্সি থেকে পুরোপুরি ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে ওই বেচারি ব্ল্যাক হোলটাকে আজীবন মহাশূন্যে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। যতটা জোরে ওই ব্ল্যাক হোলটাকে তার ভিটে থেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে একটা অসম্ভব রকমের শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল, যে দু’টি ব্ল্যাক হোল একে অন্যকে ধাক্কা মেরেছিল, তাদের ভর ও ঘূর্ণনের গতিবেগ সমান না হওয়ায়। আমাদের ধারণা, ১০ কোটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ হলে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়, ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি প্রায় ততটাই।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: নাসা

Black Hole Galaxy Space
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy