Advertisement
E-Paper

মৃতকে সমাধি দেওয়া আধুনিক মানুষ শুরু করেনি! আগুনের পর আর এক ভুল ধারণা ভেঙে গেল বিজ্ঞানীদের

এদের মস্তিষ্কের আকার ছিল অনেক ছোট। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। অনেকটা কমলালেবুর মাপের মস্তিষ্ক ছিল এদের। তবে উচ্চতা ছিল প্রায় পাঁচ ফুট। অন্তত দু’লক্ষ বছর আগে এই মানবপ্রজাতিই তৈরি করেছিল সমাধিস্থল।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৫
দক্ষিণ আফ্রিকায় দু’লক্ষ বছরের পুরনো সমাধিস্থল খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় দু’লক্ষ বছরের পুরনো সমাধিস্থল খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। —প্রতীকী চিত্র।

মস্তিষ্কের আকার ছোট না বড়, তার উপরেই নির্ভর করে বুদ্ধিমত্তা। প্রাণীজগৎ সম্পর্কে এটাই প্রচলিত ধারণা। কিন্তু সত্যিই কি তাই? বছরের পর বছর ধরে সেই প্রচলিত ধারণা নিয়েই এ বার প্রশ্ন তুলে দিল প্রত্নতাত্ত্বিকদের নতুন খোঁজ।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্‌সবার্গ থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে রয়েছে রাইজ়িং স্টার গুহা। দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম আলোচিত প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল এটি। সম্প্রতি এখানে বিশ্বের প্রাচীনতম সমাধিস্থলের নিদর্শন মিলেছে। তবে সেটি কোনও আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স)-এর তৈরি নয়। তা হলে কারা এই সমাধি দিয়েছিল? সেই প্রশ্নের উত্তরই ইঙ্গিত দিচ্ছে, মস্তিষ্কের আকার সম্ভবত বুদ্ধিমত্তার বিকাশের একমাত্র কারণ নয়।

সাম্প্রতিক কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজে প্রমাণিত হয়েছে, আধুনিক মানুষের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই আদিমানবেরা আগুন জ্বালাতে শিখে গিয়েছিল। আনুমানিক চার লক্ষ বছর আগে মানুষের কোনও এক আদিম প্রজাতি আগুন জ্বালাতে জানত। তা প্রয়োজন মতো নিয়ন্ত্রণ করতেও জানত। অনুমান করায় হয়, ওই আদিম প্রজাতি ছিল নিয়ানডারথালেরা। এ বার জানা গেল মৃতদেহ প্রথম সমাধিও দিয়েছিলেন আধুনিক মানুষ ভিন্ন অন্য এক প্রজাতি।

সমাধিস্থলটি অন্তত ২,০০,০০০ বছরের পুরনো। ওই সময়ে পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়ে গিয়েছিল। আজ থেকে প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশেই প্রথম আবির্ভাব হয় আধুনিক মানুষের। তবে তখন পৃথিবীতে তারাই একমাত্র মানবপ্রজাতি ছিল না। হোমো গণের অন্য আদিমানবেরাও ওই সময়ে ঘুরে বেড়াত পৃথিবীতে। তাদেরই মধ্যে একটি হল হোমা নালেদি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের দাবি, রাইজ়িং স্টার গুহায় ওই কবরগুলি দিয়েছিল হোমো নালেদিরাই। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এদের মস্তিষ্কের আকার আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় অনেক ছোট। প্রায় এক তৃতীয়াংশ। অনেকটা কমলালেবুর আকারের মস্তিষ্ক।

খননকার্য শুরু হয়েছিল এক দশকেরও বেশি সময় আগে। ২০১৩ সালে। জোহান্‌সবার্গের উইটওয়াটারস্ট্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক লি বার্জারের নেতৃত্বে একটি দল গুহায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। ওই খননকার্যের সময়েই প্রথম জানা যায়, হোমো নালেদি নামে এই আদিম মানবপ্রজাতির কথা। গুহা থেকে পাওয়া যায় দেড় হাজারেরও বেশি হাড়গোড়ের জীবাশ্ম। যেগুলি ছিল মানুষের মতো অন্তত ১৫টি প্রাণী। পরে গবেষকেরা ঘোষণা করেন, ওই হাড়গুলি হোমো নালেদির।

এই প্রজাতির আদিমানবদের উচ্চতা ছিল প্রায় পাঁচ ফুট। হাত এবং পায়ের আঙুলগুলি ঈষৎ বাঁকানো। হাতগুলির গড়ন ছিল এমন, যাতে তারা কোনও বস্তুকে ধরে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারে। তবে এদের মস্তিষ্কের আকার অনেক ছোট। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে ২০১৭-১৮ সালে ফের এক দফা খননকার্য শুরু হয় ওই গুহায়। সেই খননকার্যে সম্প্রতি ওই গুহার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছে আদিমানবদের সমাধি। গুহার কিছু চেম্বারের মধ্যে পাললিক শিলাস্তরের নীচে পাওয়া গিয়েছে হাড়গুলি।

ওই পাললিক শিলাগুলিও বিশ্লেষণ করে দেখেন গবেষকেরা। তবে ওই মাটি জলের তোড়ে বা কোনও জায়গা থেকে পিছলে দেহের উপর পড়েছে— এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি গবেষণায়। যা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা নিশ্চিত ওই দেহগুলি জেনেবুঝেই গুহার ওই অংশে রাখা হয়েছিল। তার পরে সেগুলিকে মাটি দিয়ে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি গুহার ওই অংশে কেউ বাস করত, এমন প্রমাণও মেলেনি। যা থেকে গবেষকেরা নিশ্চিত, ওই অংশটিকে একটি সমাধিস্থল হিসাবেই ব্যবহার করত আদিমানবদের এই প্রজাতি।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজ়িং স্টার হল বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা একটি গুহা অঞ্চল। এখান থেকেই এক দশক আগে পাওয়া গিয়েছিল হোমো নালেদির জীবাশ্ম। নতুন খুঁজে পাওয়া জীবাশ্মগুলিও ওই একই আদিম প্রজাতির। তা থেকেই গবেষকেরা আরও স্পষ্ট হয়েছেন, হোমো নালেদিদের মধ্যে সমাধি দেওয়ার চল ছিল। এই মানবপ্রজাতির কোন সময়ে আবির্ভাব হয়, কোন সময়ে পৃথিবী থেকে তারা হারিয়ে যায়— তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করা হয়, সাড়ে তিন থেকে আড়াই লক্ষ বছর আগে এরা বাস করত পৃথিবীতে।

হোমো নালেদিদের এই সমাধিগুলি আবিষ্কারই আরও ভাবিয়ে তুলেছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের। মানব বিবর্তনের ইতিহাসে মস্তিষ্কের আকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রচলিত ধারণায়, যে মানবপ্রজাতিগুলির মস্তিস্কের আকার বড়, তাদের বুদ্ধিমত্তাও তত উন্নত ছিল। কিন্তু মস্তিষ্কের আকারই কি এর একমাত্র কারণ? তা হলে আধুনিক মানুষের চেয়ে এত ছোট মাপের মস্তিষ্কের এই আদিমানবেরা কী ভাবে সমাধি বানাল!

দক্ষিণ আফ্রিকার গুহায় পাওয়া এই সমাধিগুলির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলি যত্ন সহকারে খনন করা হয়েছিল। তার পরে মাটি দিয়ে ভরাট করে, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গবেষকদের কথায়, এটি কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে এই সমাধিগুলি দেওয়া হয়েছিল বলে আভাস মিলেছে। শুধু তা-ই নয়, এই গুহার দেওয়ালে খোদাই করা কিছু জ্যামিতিক নকশাও মিলেছে। উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাবে মসৃণ করা পাথরের উপরে এই নকশাগুলি ইঙ্গিত করে হোমো নালেডিরা প্রতীকও তৈরি করতে পারত। তবে এ বিষয়ে আরও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন গবেষকদলের অন্যতম সদস্য প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অগাস্টিন ফুয়েন্তেস। তাঁর মতে, এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া গেলে এই খোঁজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রতীক আঁকা, শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের মতো সৃজনশীলতার উপরে যে শুধু আধুনিক মানুষেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিল না, তা প্রমাণ করতে আরও সাহায্য করবে এই গবেষণা।

Tomb Burial Ground Cave South Africa
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy