Advertisement
E-Paper

আতঙ্কের স্মৃতি আর ফিরে আসবে না বহু দিন পর! পথ দেখালেন বাঙালি

জগত্সভায় আবার বাংলার জয়জয়কার! আবার বাজিমাত করলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী! নিউরো-সায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞানের কঠিনতম গবেষণায়। যা দেখিয়ে দিল অতীতের আতঙ্ককে পুরোপুরি মুছে ফেলার পথ।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ ১০:৫০
ইনসেটে নিউরো-সায়েন্টিস্ট সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

ইনসেটে নিউরো-সায়েন্টিস্ট সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

জগত্সভায় আবার বাংলার জয়জয়কার! আবার বাজিমাত করলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী! নিউরো-সায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞানের কঠিনতম গবেষণায়। যা দেখিয়ে দিল অতীতের আতঙ্ককে পুরোপুরি মুছে ফেলার পথ।

অতীতে যে ঘটনায় আপনি দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, সেই আতঙ্কের স্মৃতি আর আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে না আজীবন! রোজ রাতে কারণে-অকারণে সেই স্মৃতি আর ফিরে ফিরে এসে আমার-আপনার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারবে না! অতীতের সেই গায়ের লোম খাড়া করে দেওয়া আতঙ্ককে এ বার বাকি জীবনে আর বয়ে বেড়াতে হবে না। গা ছমছমে ভয়ের স্মৃতিকে এ বার ‘গুড বাই’ জানানো যাবে, চিরতরেই।

ভিজে ন্যাকরা দিয়ে ছোটবেলায় শ্লেটে আমরা যেমন মুছে ফেলতাম চকখড়ির দাগ, সেই শ্লেটকে চকখড়ির আঁচড় লাগার আগেকার মতো করে তুলতাম ঝকঝকে, ঠিক তেমন ভাবেই আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলা যাবে আতঙ্কের স্মৃতি।


যে স্নায়ুকোষে জমা হয় স্মৃতি। অণুবীক্ষণের নীচে।

অতীতের আতঙ্ককে একেবারে ‘মুছে ফেলা’র একটি অত্যাশ্চর্য পথ খুঁজে বের করে চমকে দিলেন এক বাঙালি নিউরো-সায়েন্টিস্ট। সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার সন্তান সুমন্ত্র বেঙ্গালুরুর ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিনে’র ‘সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার’-এর অধিকর্তা। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’ (এনসিবিএস)-এরও বিশিষ্ট অধ্যাপক। তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিওলজিক্যাল রিপোর্টস’-এ। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘দ্য ডিলেইড স্ট্রেংদেনিং অফ সিন্যাপটিক কানেক্টিভিটি ইন দ্য অ্যামিগডালা ডিপেন্ডস অন এনএমডিএ রিসেপ্টর অ্যাক্টিভেশন ডিওরিং অ্যাকিউট স্ট্রেস’।

আরও পড়ুন- বাজারে আসছে ইবোলার টিকা, কৃতিত্বের ভাগীদার এক ভারতীয় মহিলাও

২ ওষুধের মিশেল ঠেকাবে ক্যানসার, দাবি বিজ্ঞানীদের

বায়োটেকনোলজি মন্ত্রক ও পরমাণু শক্তি মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে ওই সাড়াজাগানো গবেষণায় সুমন্ত্র দেখিয়ে দিতে পেরেছেন, কোনও একটি ঘটনায় আতঙ্কে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু দিন পর কেন হঠাৎ করেই সেই স্মৃতি আমাদের মগজে ফিরে আসে। আর সেই স্মৃতি কেনই-বা আজীবন আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, কেনই-বা রাতের ঘুম কেড়ে নেয় আমাদের। সুমন্ত্রের কৃতিত্ব এটাই যে, সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। সেই আতঙ্কের স্মৃতিকে যাতে আর আজীবন বয়ে বেড়াতে না হয় আমাদের, তারও পথ খুঁজে বের করেছেন তিনি। যে পথ ধরে এক দিন এমন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের হাতে এসে যাবে, যাতে ভিজে ন্যাকরা দিয়ে শ্লেটে চকখড়ির দাগ মুছে ফেলার মতো অতীতের ফিরে ফিরে আসা আতঙ্কের স্মৃতিকে ‘মুছে ফেলা’ যাবে পুরোপুরি।


আনন্দবাজারের ‘সেরা বাঙালি’ পুরস্কারে সম্মানিত নিউরো-সায়েন্টিস্ট সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

মূল গবেষণাপত্রটি পড়ুন এই ঠিকানায়

http://physreports.physiology.org/content/4/20/e13002

----------------------------------

কোন ধরনের আতঙ্কের স্মৃতিকে পুরোপুরি মুছে ফেলার উপায় বাতলেছেন সুমন্ত্র?

তাঁর কাজটি বোঝাতে একটি গল্প বলেছেন সুমন্ত্র। তাঁর কথায়, ‘‘ধরুন, একটি জনবহুল রাস্তা দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছেন কোনও মহিলা। হঠাৎই পিছন থেকে ছুটে আসা বাইকে বসে থাকা এক দুষ্কৃতী হাত বাড়িয়ে ওই মহিলার গলার সোনার বড় চেন’টা ধরে টান মারলেন। আচমকা ঝটকায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে কিছুটা দূর পর্যন্ত ওই ছুটন্ত বাইকের সঙ্গে ঘষটাতে ঘষটাতে চললেন ওই মহিলা। ভয়ে জ্ঞানও হারিয়ে ফেললেন। ভাগ্যিস, দুষ্কৃতীটি তাঁর গলার সোনার চেন’টা টেনে-হিঁচড়ে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল! না হলে বাইকের সঙ্গে রাস্তায় ঘষটাতে ঘষটাতেই রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু হতো তাঁর। বা, মাথায় ভয়ঙ্কর চোট লেগে ‘কোমা’য় চলে যেতে পারতেন ওই মহিলা। তা হয়নি। সোনার চেন’টা টেনে-হিঁচড়ে খুলে নেওয়ার ফলে ওই মহিলার গলায় শুধু একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হল। আর রক্তে ভেসে গেল তাঁর শরীর। কিন্তু তার পর হাসপাতাল বা বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসার পর দিব্যি সুস্থ হয়ে গেলেন ওই মহিলা। বড়, ভারী সোনার চেন ছিনতাই হওয়ার দুঃখ আর গায়ে-কোমরে ব্যথা ছাড়া গোটা ঘটনাটাই যেন ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকলেন ওই মহিলা। বেশ কিছু দিন পর হঠাৎ সেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের দিনটার কথা, সেই সময়টার কথা, সেই ঘটনাটার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল এক দিন। তার পর প্রতি রাতেই কারণে-অকারণে যখন-তখন সেই আতঙ্কের দিনটির কথা মনে পড়তে লাগল মহিলাটির। তাঁর রাতের ঘুমের বারোটা বেজে গেল! এ ঘরে যাচ্ছেন বা ও ঘরে, ওই ঘটনার কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ায় গলায় হাত বুলিয়ে নিতে শুরু করলেন ওই মহিলা। মনে হতে লাগল, যেন আবার কেউ তাঁর গলার সোনার চেন’টা ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর তিনি রাস্তায় পড়ে গিয়ে বাইকের সঙ্গে ঘষটাতে ঘষটাতে চলছেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। যেন ভোঁ বাজানোর অনেক দিন পর জাহাজ ছাড়ল! আর তার পর মাসের পর মাস ধরে জলে সাঁতার কাটতে কাটতে জাহাজ এগিয়ে চলতে শুরু করল! যা আর কিছুতেই থামে না! অনেকটা সেই রকম।’’


কী ভাবে কাজ হয় অ্যামিগডালায়


মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ

কেন ঘটনার অত দিন পর হঠাৎ করে ফিরে এল মহিলার সেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের স্মৃতি?


মস্তিষ্কের যেখানে থাকে অ্যামিগডালা (লাল বৃত্ত)



মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস ও অ্যামিগডালা

বেঙ্গালুরু থেকে সুমন্ত্র বললেন, ‘‘আমাদের মস্তিষ্কে পাশপাশি দু’টি এলাকা রয়েছে। একটি- ‘হিপোক্যাম্পাস’। অন্যটি- ‘অ্যামিগডালা’। ভয়, আতঙ্ক, আনন্দ, দুঃখ, হতাশা- এমন নানা অনুভূতির জন্ম হয় ওই অ্যামিগডালায়। আর সেই সব কিছুর স্মৃতিকে আজীবন আগলে বাঁচিয়ে রাখে ওই অ্যামিগডালাই। কোনও স্মৃতিকেই সে চট করে মুছে ফেলতে চায় না। মুছে ফেলে না। আবার স্মৃতিতের ভারে খুব বেশি ‘ভারী’ হয়ে গেলে ওই অ্যামিগডালা নিজেই বেছে নেয়, কোন স্মৃতিকে সে বাঁচিয়ে রাখবে। আর কোন স্মৃতিটুকু সে মুছে ফেলবে। অনেকটা স্পুল সিস্টেমের টেপ রেকর্ডারের মতো। বাছাইটা সে নিজেই করে। প্রয়োজনে নিজেই মুছে ফেলে কিছু কিছু স্মৃতি, ‘ভারী’ হয়ে উঠতে হবে না বলে। আমরা পড়া মুখস্থ করি, এর-ওর নামধাম, টেলিফোন নাম্বার, ই-মেল অ্যাড্রেস যে মনে রাখতে পারি বহু দিন, তার জন্য কৃতিত্বটা দাবি করতে পারে ওই অ্যামিগডালাই। মস্তিষ্কের টেমপোরাল লোবের অত্যন্ত গভীরে থাকা ওই অ্যামিগডালাই আমাদের মস্তিষ্কের ‘ইমোশনাল হাব’।


মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস এলাকা

যা দেখতে খুব ছোট্ট স্নায়ুকোষ। কাঠবাদামের মতো। যত রকমের অনুভূতি রয়েছে আমাদের, তার সব কিছুরই ‘স্টোরেজ’ (জমা থাকে) হয় অ্যামিগডালায়। আমরা দেখেছি, কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনার পর আমাদের আতঙ্কের স্মৃতির ছিটেফোঁটাও থাকে না অ্যামিগডালায়। অমন আতঙ্কের ঘটনা যে ঘটেছে, তা ওই সময় যেন মনেই করতে পারে না আমাদের মস্তিষ্ক। কারণ, সেই ঘটনার ‘ফুটেজ’ অ্যামিগডালায় তখনও নেই। এই অবস্থাটা চলে ওই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ঘটনার ১০ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত। তার পরেই হঠাৎ করেই ‘বিগড়ে যেতে’ শুরু করে অ্যামিগডালা। তার মধ্যে নানা রকমের পরিবর্তন হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে। আতঙ্কের স্মৃতিতে একটু একটু করে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে অ্যামিগডালা। আর আমরা ‘আক্রান্ত’ হতে শুরু করি অতীতের ওই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের স্মৃতির হানাদারিতে! আমাদের মনে তখন প্রায় সব সময়ই হামলা চালাতে শুরু করে সেই আতঙ্কের স্মৃতি। ঘরে, বাইরে সর্বত্র। আচমকা। হঠাৎ হঠাৎ। সেই জন্যই ওই মহিলার গলার হার ছিনতাইয়ের ভয়ের স্মৃতি ফিরে আসে বেশ কিছু দিন পর, যখন আসলে তিনি গোটা ঘটনাটাই প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলেন।’’


সেই প্রোটিন এনএমডিএ

কেন হারিয়ে যাওয়া অতীতের কোনও আতঙ্কের স্মৃতি হঠাৎ করে এক দিন ফিরে আসে?


মস্তিষ্কের পিরামিডাল নিউরন

সুমন্ত্র বলছেন, ‘‘অ্যামিগডালার ওই ভুতুড়ে আচরণের জন্য দায়ী বিশেষ একটি প্রোটিন। যার নাম- ‘এন-মিথাইল-ডি-অ্যাসপারটেট রিসেপ্টর’ (এনএমডিএ-আর)। আমাদের স্মৃতিশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে স্নায়ুকোষের এই প্রোটিনের। ওই প্রোটিনের জন্য তখন অ্যামিগডালায় একটি স্নায়ুকোষের সঙ্গে অন্য স্নায়ুকোষের যোগাযোগ রাখার নতুন নতুন সাইন্যাপসের জন্ম হতে থাকে। সেই সাইন্যাপসগুলো গড়ে, বেড়ে উঠতে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তার ফলে অ্যামিগডালার ওই অংশগুলিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ আচমকা অনেকটা বেড়ে যায়। বাড়তি বিদ্যুৎ মানেই বাড়তি শক্তি। আর শক্তি যখন বেশি হয়ে যায়, তখন আপাত ভাবে হারিয়ে যাওয়া অতীতের আতঙ্কের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার ‘রসদ’টা জোগাড় করে নিতে আর অসুবিধা হয় না অ্যামিগডালার। তাই ওই সময় অতীতের আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে আসে অ্যামিগডালায়। আর তা রোজ ফিরে ফিরে এসে আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাদের। যাকে বলে- ‘পোস্ট ট্র্যমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (পিটিএসডি)।’’

সুমন্ত্র ও তাঁর সহযোগী ছাত্রদের গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?


সহযোগী গবেষক ফারহানা ইয়াসমিন

সহযোগী গবেষক বেঙ্গালুরুর এনসিবিএস-এর ছাত্রী ফারহানা ইয়াসমিন দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা। ফারহানের কথায়, ‘‘ঘটনার পর পরই আতঙ্কের কতটা ছাপ পড়ে অ্যামিগডালায়, এখনও পর্যন্ত স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণা শুধু সেই কারণটাই খুঁজে বেরিয়েছে। আমাদের গবেষণার অভিনবত্ব এখানেই যে, ঘটনার অত দিন পরেও কেন, কী ভাবে আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে আসে আমাদের আর তা আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তার কারণ খুঁজে বের করতে পেরেছি।’’

কী ভাবে ওই আতঙ্কের স্মৃতির বহু দিন পর ফিরে আসা বন্ধ করার পথ দেখিয়েছেন গবেষকরা?

সুমন্ত্র বলছেন, ‘‘আমরা ওই প্রোটিন (এনএমডিএ-আর) তৈরি হওয়ার পথটিকে বন্ধ করে দিতে পেরেছি। এই প্রথম। আর তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আতঙ্কের ঘটনার বহু দিন পর অ্যামিগডালায় নতুন নতুন সাইন্যাপস গজিয়ে ওঠাও বন্ধ করে দিতে পেরেছি। তার ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ শক্তির জন্মও হয়নি আর। তাই ঘটনার বহু দিন পর আর আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে আসেনি।’’

ছবি সৌজন্যে: ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, বেঙ্গালুরু।

NMDAR Receptors Sumantra Chatterjee on NMDAR delayed strengthening of synaptic connectivity
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy