ক্যানসারের ইমিউনোথেরাপি (বাঁ দিকে)
আবার উল্টোটাও হয়। সেটা- ‘অটো-ইমিউনিটি’। ‘আত্মীয়’ হয়েও একে অন্যের শত্রু। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট ক্যানসারের কোনও নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন হয় না। একই অ্যান্টিজেন বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে দেখা যেতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, ওই অ্যান্টিজেনগুলি স্বাভাবিক কোষেও থাকে।
ইমিউনিটির ‘দু’টি হাত’!
একটা- কোষ-সংক্রান্ত ইমিউনিটি (‘লিম্ফোসাইট’)। অন্যটা হল, দেহরস-সংক্রান্ত ইমিউনিটি (‘অ্যান্টিবডি’)। ইমিউনিটির এই দ্বিতীয় ‘হাত’টা ক্যানসারের ক্ষতি করার বদলে তাকে নাকি আগলে রাখে! আর প্রথম ‘হাত’টা নাকি খুব সম্ভবত, ক্যানসারের জন্মে সাহায্য করে!
তাই ইমিউনিটি সম্পর্কে প্রথাগত ধারণাগুলিকে ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘অঙ্কের বাঁধা-ধরা নিয়ম’ মেনে প্রয়োগ করা যায় না। ক্যানসার টিকায় সারতে পারে, এই দাবি মেনে নিতে হলে ওই মূল বাস্তবতাকেই অস্বীকার করতে হবে!
ইমিউনোথেরাপি দিয়ে ক্যানসার ‘নিরাময়’-এর কথা যে অবান্তর, তা বিভিন্ন গবেষণায় বার বার বলা হয়েছে। তবু মাঝেমধ্যেই নতুন নতুন ওষুধ বাজারে আসে। তাদের নিয়ে নতুন জল্পনা শুরু হয়। আমরা ভাবতে বসি, এই বুঝি অন্ধকারের দিন কেটে গেল!
অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিক্যাল জার্নালগুলিতে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে যে সব নতুন ওষুধ বাজারে এসেছে তাতে কাজের কাজ যা হয় তা অতি সামান্যই। ওষুধের দামও অসম্ভব বেশি। ‘সামান্য কাজ’ বলতে এই টুকুই বোঝায়। ওই সব ওষুধ দিয়ে ক্যানসারের ‘মারমুখী’ ভাবটা হয়তো কিছু দিন একটু কমিয়ে রাখা যায়। সেটা দরকারও। কিন্তু তার জন্য রোগী ও তাঁর আত্মীয়-পরিজনদের যতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা যথেষ্টই।
এর কারণ, ক্যানসার কোনও ‘পরজীবী’ নয়। তাই পরজীবীর মতো তাকে আক্রমণ করে নিকেশ করা যায় না।
মানুষের মতো সব ধরনের ক্যানসারেরও (এখনও পর্যন্ত ৪০০ রকমের ক্যানসারের হদিশ মিলেছে, জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। তবু তারা প্রত্যেকেই একে অন্যের চেয়ে আলাদা। স্বতন্ত্র। একেবারে মানুষের মতোই। তার মানে, প্রতিটি ক্যানসারই আলাদা। নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে পরিচিত। কোনও একটি নির্দিষ্ট ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি সব রকমের ক্যানসারের উপর একই ভাবে খাটে না।
ক্যানসার টিকা: হালের গবেষণা, তর্কবিতর্ক...
ইমিউনোথেরাপি নিয়ে গবেষক বিজ্ঞানীরা এ বার (স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার টিকার হালের গবেষণা) ‘লিম্ফোমা’ নামে একটি বিশেষ ধরনের ক্যানসারের উপর তাঁদের ওষুধ প্রয়োগ করেছেন। দাবি করেছেন, তাতে ভাল ফল মিলেছে।
এখন শুরু হবে তর্ক-বিতর্ক। কী ধরনের লিম্ফোমা, রোগের কোন অবস্থায় ওই গবেষণা হয়েছে, সুফল মিলেছে কত দিন পর্যন্ত, কুফলই বা ঘটেছে কতটা। ইঁদুরের ওপর যা সত্যি তা কি মানুষের বেলাতেও সত্যি?
ক্যানসার: জিনের অদলবদল ঘটালেই কি ‘কিস্তিমাত’?
এটা ঠিকই, জিনের উপাদানগুলির অদলবদল ঘটিয়ে কোনও কোনও ক্যানসারের ধ্বংসাত্মক আচরণকে কিছুটা প্রশমিত করা যায়। কিন্তু সেই অদলবদল আবার অন্য দিকে তার ধ্বংসকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। তার ফলটা হয় এই যে, রোগী ক্যানসারে মারা যান না। মারা যান ক্যানসার চিকিৎসার অভিঘাতে!
সেই যে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন...
সেই ‘অভিঘাত’ কি কমিয়ে রাখা যায় না? তা হয়তো যায়। বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টা করেই থাকেন। কিন্তু তা হলে তো বার্ট্রান্ড রাসেলের সেই কথাটাই নতুন করে বলতে হয়। রাসেল বলেছিলেন, ‘‘আধুনিক বিজ্ঞানের চরিত্রই হল, সে একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরও পাঁচটা নতুন সমস্যা তৈরি করে ফেলে!’’
আমাদের ক্যানসার-চর্চার চরিত্রও আসলে তা-ই। এও একটি ‘বিজ্ঞান-দর্শন’। এই ‘দর্শন’ সম্বল করে ক্যানসারকে ধ্বংস করার স্বপ্নটা আসলে একেবারেই অবান্তর। তবে এই ‘দর্শন’ই তো আমাদের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। আরও গবেষণার প্রেরণা দেয়।
ইঁদুরের উপর পরীক্ষার সাফল্যে বুক ফোলালে ভুল হবে!
পুরনো পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন যা হয়, তা হল- প্রতিস্থাপিত (ট্রান্সপ্ল্যান্টেড), কৃত্রিম ক্যানসার নিয়ে গবেষণা। বিশেষ করে, ইঁদুরের দেহে ক্যানসার কোষ প্রতিস্থাপিত করে তার উপর গবেষণা। কিন্তু আমাদের শরীরে যে সব ক্যানসার হয়, সেগুলি একেবারেই প্রতিস্থাপিত নয়। সেগুলির জন্ম হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। সেগুলি সাধারণত, অ্যান্টিজেনের মতো আচরণ করে না। করলে, তার বিরুদ্ধে শরীরে ‘প্রতিক্রিয়া’ শুরু হয়ে যেত।
তাতে অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালই হত। কারণ, ক্যানসারের জন্মের আগেই তাকে জানা যেত। তাই গবেষণার পদ্ধতি বদলাতে হবে। সেটা কী ভাবে হবে, তা নিয়ে আরও বেশি করে ভাবতে হবে।
‘তোমার স্বপ্নে কোনও বাস্তব নেই...’
‘সেবা-কাতর’ বিজ্ঞানীরা একটা নিরঙ্কুশ বিশ্বাসে ভর করে থাকেন! সাধারণ মানুষজনকেও সেই বিশ্বাসে সামিল হতে বলেন। তা ভাল। কিন্তু বিশ্বাস যখন যুক্তির পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যায়, তখন আর সে তেমন বিশ্বাসযোগ্য থাকে না!
তখন মনে হয়, ‘তোমার স্বপ্নে কোনও বাস্তব নেই, বাস্তবে নেই কোনও স্বপ্ন’!