ডেঙ্গুর ভাইরাসকে (সবুজ) রোখার জন্য তৈরি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (লাল)।
যে কোনও হানাদারকে রোখার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিখুঁত করে তুলতে হয়।
তা সে কোনও দেশের ভৌগোলিক সীমান্ত হোক বা তার আকাশ-পথ বা জল-সীমা। অথবা তা হোক আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
প্রাথমিক ব্যবস্থাটা নিতে হয় সেই ‘ডিফেন্স’টাকে নিখুঁত করে তোলার জন্যই।
ডেঙ্গির টিকা আবিষ্কারের ঘটনা সেই লক্ষ্যের দিকে নিশ্চিত ভাবেই একটি বড়সড় পদক্ষেপ। বলা যেতে পারে, ‘রেড লেটার ইভেন্ট’!
কেন ডেঙ্গির টিকা আবিষ্কারের ঘটনা একটি সাড়াজাগানো পদক্ষেপ?
বিশ্বে মশার মাধ্যমে যে সব রোগের ভাইরাস ছড়ায়, তার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে ছড়ায় ডেঙ্গির ভাইরাস। ম্যালেরিয়ার চেয়েও তা ছড়ায় বেশি দ্রুত হারে। ফি-বছর বিশ্বে গড়ে ৩৯ কোটি মানুষ ‘ছোবল’ খান ডেঙ্গি ভাইরাসের। আর সেই অর্থে, এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গির কোনও সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। খুব ভয়াবহ ভাবে কেউ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে, তাঁকে সামান্য কিছু ওষুধবিষুধ দেওয়া ছাড়া চিকিৎসকদের আর কিছুই করার থাকে না।
ডেঙ্গির ভাইরাস বহন করে যারা, সেই ‘এডিস’ মশা।
আরও পড়ুন- এ বার ডেঙ্গির টিকাও বেরিয়ে গেল!
ডেঙ্গির দুই উপসর্গ- জ্বর আর ‘র্যাশ’-এর মাত্রাই বলে দেয়, ডেঙ্গির ভাইরাসের হানাদারি কতটা জোরালো বা তা আদৌ জোরালো কি না। এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গির সদ্য আবিষ্কৃত টিকা (টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গি ভ্যাকসিন) অবশ্যই নিতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হলে এই টিকা আগামী দিনে ডেঙ্গি প্রতিরোধ বা তার ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমানোর ক্ষেত্রে করতে পারে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ডেঙ্গির ভাইরাসের হানাদারি থেকে মানুষকে বাঁচাতে তাই আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে’র গবেষকরা সম্প্রতি যে টিকা আবিষ্কার করেছেন, তা একটি মনে রাখার মতো পদক্ষেপ।
কী ভাবে বানানো হয়েছে ডেঙ্গির টিকা?
এই বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলার দরকার আছে। ডেঙ্গি ভাইরাস আসলে চার রকমের হয়। ‘ডেন-১’, ‘ডেন-২’, ‘ডেন-৩’ আর ‘ডেন-৪’। এগুলোকে বলা হয় ‘সেরোটাইপ’। ডেঙ্গির ভাইরাসের চারটি ‘সেরোটাইপে’র কার্যকতী ক্ষমতা চার রকমের। তাদের আচার-আচরণ, আদবকায়দা, হাবভাব, চালচলনেও কিছুটা ফারাক রয়েছে। নতুন টিকা বানানোর জন্য ডেঙ্গির ভাইরাসের চারটি ‘সেরোটাইপে’র কার্যকরী ক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে নিয়ে একটি মিশ্রণ (মিকশ্চার) বানানো হয়েছিল। সেখান থেকেই বানানো হয়েছে ডেঙ্গির টিকা। যার নাম- ‘TV003’।
ডেঙ্গি ভাইরাসের একটি সেরোটাইপ- ‘ডেন-২’।
এগুলোকে কেন ‘সেরোটাইপ’ বলা হয়?
তার কারণ, আমাদের রক্তরসের (ব্লাড সিরাম) মধ্যে যে অ্যান্টিবডিগুলি রয়েছে, ডেঙ্গির চার রকমের ভাইরাস তাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে বিক্রিয়া (ইন্টারঅ্যাকশন) করে। আবার বিশেষ এক রকমের ডেঙ্গির ভাইরাসের মধ্যেও জিনের গঠনের তারতম্য রয়েছে। তাই তাদের আচার-আচরণ, শরীরে হানাদারির কায়দা-কসরতেও রয়েছে কিছুটা ফারাক। তবে যতই ফারাক থাক, সকলেরই হানাদারিতে ডেঙ্গিতে আক্রান্তদের ক্ষতিটা সমান ভাবেই হয়। উপসর্গগুলিও আলাদা হয় না।
এই টিকা নিয়ে আরও পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজনটা কেন থেকেই যাচ্ছে?
তার কারণ, টিকা আবিষ্কারের ঘটনা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলেও, তা এই সমস্যার কোনও স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। সেই টিকাকে যতই উন্নততর করে তোলা হোক না কেন।
কথাটা বলছি, তিনটি কারণে।
প্রথমত, এই টিকায় ডেঙ্গির ভাইরাসের প্রতিটি একটি বা গুটিকয়েক ‘স্ট্রেন’ বা প্রকারের হানাদারি রোখা যাবে। এর ফলে, ওই ভাইরাসের অন্যান্য প্রকারের জন্য এই টিকাটি কার্যকরী না-ও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাসগুলির জিনোমে থাকা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের (আরএনএ) খুব দ্রুত হারে ‘মিউটেশান’ হয় বলে ডেঙ্গির ভাইরাসগুলির আচার-আচরণ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যায়। বদলে যায় তাদের চালচলন। হাবভাব। হানাদারির কায়দা-কসরৎও। তাই দু’-তিন বছর পর হয়তো দেখা যাবে ওই টিকা আর কাজে লাগছে না। সেই টিকাকে উন্নততর করে তোলা হলেও। তখন আবার নতুন টিকা বানাতে হবে।
তৃতীয়ত, তার পরেও যদি অজানা কোনও হানাদার আসে, তখন তাকে রুখতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সেটাও তখন অজানাই থাকবে। তাই শুধু টিকাই ডেঙ্গি-প্রতিরোধে শেষ কথা হতে পারে না।’’
তা হলে কী করণীয়?
সম্প্রতি গবেষকরা একেবারেই একটি নতুন পদ্ধতিতে ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার পন্থা আবিষ্কার করেছেন। মানুষের আনুমানিক ২২ হাজার জিনের মধ্যে এমন কিছু ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ জিন রয়েছে, যারা কোষের মধ্যে ভাইরাসগুলোকে ঢুকতে আর নতুন নতুন ভাইরাস তৈরি করতে সাহায্য করে। যদি সেই জিনগুলির মধ্যে এমন কয়েকটি জিন খুঁজে পাওয়া যায়, যাদের সাময়িক ভাবে অকেজো করে দিলেও কোষের কাজকর্ম যেমন চলছে, তেমনই থাকে। কিন্তু সেই কোষ আর ভাইরাসদের ঢুকতে সাহায্য করতে পারবে না। পারবে না নতুন নতুন ভাইরাস তৈরি করতেও। তা হলে সেই জিনগুলিকে এখন খুঁজে বের করতে হবে। আর তার পর তাদের অকেজো করার ওযুধ আবিষ্কার করা যেতে পারে। ডেঙ্গির ভাইরাসের দ্রুত হারে ‘মিউটেশন’-এর জন্য তাকে রোখার ‘অস্ত্র’গুলি খুব বেশি বা খুব বেশি দিন ধরে কার্যকর হয় না। এই নতুন পদ্ধতিতে সেই সমস্যাও আর থাকবে না। কারণ, সেই কাজটা করা হবে মানুষের জিন নিয়ে। আর স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের শরীরে থাকা জিনগুলির ‘মিউটেশান’ হয় না বললেই চলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy